পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে টাঙ্গাইলের ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে ছোট-বড় ৪১১টি চালকল। এরমধ্যে ৩৪৮টির নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। সরকারের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগও দেওয়া হচ্ছে এসব চালকলগুলোতে। ফলে এসব (মেজর/অটো/সেমি অটো রাইস মিল) চালকলের বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, দূষিত হচ্ছে নদীনালা আর খালবিল।
Advertisement
স্থানীয়রা জানান, খাদ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স ব্যতীত চালকল চালানোর সুযোগ নেই। অটোমেটিক রাইস মিল স্থাপন করতে হলে কারখানা স্থাপনের দলিলের কপি, বিদ্যুৎ বিলের কপি, পরিবেশের ছাড়পত্র, আর্থিক সচ্ছলতার সনদসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত প্রকৌশলীর কাছে আবেদন করতে হয়। এরপর বয়লার পরিদর্শকের সনদ পেলে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে চালকলের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। কারখানা চালাতে এসটি (উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন) বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন হয়। এজন্য বিদ্যুৎ বিলের কপি ও পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোনোক্রমে চালকলের লাইসেন্স দেওয়ার বিধান নেই। এরমধ্যেও জেলায় দিনদিন বাড়ছে অটোমেটিক চালকলের সংখ্যা। অন্যদিকে সঠিক কাগজপত্র না থাকা এবং বছর বছর লাইসেন্স ফি দেওয়া সাশ্রয় করতে লাইসেন্স ব্যতীত চালকল চালাচ্ছেন অনেকে। অন্যদিকে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটির সভায় (২০২৪ সালের দ্বিতীয় সভা) বিবিধ আলোচনায় বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট কিছু সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এর মধ্যে ইকোনমিক জোন বা সরকার নির্ধারিত শিল্প এলাকা ছাড়া অন্য কোনো স্থানে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হলে বিদ্যুৎ সংযোগ ও গ্যাস সরবরাহ প্রদান না করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ সংক্রান্ত নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউ কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ মর্মে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ (উন্নয়ন-১ অধিশাখা) থেকে উপ-সচিব সাইফুল ইসলাম আজাদ স্বাক্ষরিত একটি পত্র গত ১০ মার্চ বিভিন্ন জেলাসহ বিদ্যুৎ বিভাগের সব দপ্তরে পাঠানো হয়। টাঙ্গাইলে নির্ধারিত স্থানের বাইরে লোকালয় ঘেঁষে ফসলি জমিতে গড়ে ওঠা নতুন নতুন চালকলে সরকারের মন্ত্রীসভার ওই সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। খাদ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, জেলার সদর উপজেলায় একটি অটোমেটিক ও একটি আতপসহ ১৮টি, সখীপুর উপজেলায় একটি অটোমেটিকসহ ১৬টি, মির্জাপুরে সাতটি, বাসাইলে সাতটি, দেলদুয়ারে ১টি, নাগরপুরে ২টি, কালিহাতী উপজেলায় একটি অটোমেটিকসহ ১২৮টি, ঘাটাইলে একটি অটোমেটিকসহ ১০৫টি, মধুপুরে দুটি মেজর ও চারটি অটোমেটিকসহ ৫০টি, ধনবাড়ীতে ১৩টি অটোমেটিকসহ ৩৩টি, গোপালপুরে একটি অটোমেটিকসহ ২৭টি এবং ভূঞাপুর উপজেলায় ১৭টি চালকল রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৬৩টির। ৩৪৮টি চালকলের পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র নেই।
Advertisement
জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৫৭টি চালকলের নবায়ন করা হালনাগাদ তালিকা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে মেজর ক্যাটাগরির চালকল দুটি, অটোমেটিক ৫৭টি এবং সেমি অটোমেটিক বা হাস্কিং বা চাতাল ৯৮টি চালকল রয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের দেওয়া চালকলের সংখ্যা ও ক্যাটাগরির মধ্যে গরমিলের বিষয়ে ব্যাখায় জানানো হয়েছে- অধিকাংশ সেমিঅটোমেটিক বা হাস্কিং বা চাতাল চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। আবার চাতাল চালকলের মালিকরা কেউ কেউ কারখানা বন্ধ করে ১০-১২ জন একত্র হয়ে অটোমেটিক চালকল স্থাপন করেছেন।
অভিযোগে জানা গেছে, নতুন নির্মিত মেসার্স এশিয়া মাল্টি এগ্রো ফুড নামক অটোমেটিক চালকলে গত ১৩ জুন (বৃহস্পতিবার) মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত না মেনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এর আগে চালকলটির বিপরীতে মধ্যম চাপের (এমটি-৩) বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য ২৫ এপ্রিল অনুমোদন দেওয়া হয়। অথচ মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য গত ১০ মার্চ বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিটি দপ্তর/অধিদপ্তরে পত্র দেওয়া হয়। অভিযুক্ত মেসার্স এশিয়া মাল্টি এগ্রো ফুড নামক চালকলের ম্যানেজিং পার্টনার মো. নজরুল ইসলাম জানান, এমটি-৩ সংযোগ দেওয়া যাবে না বা সংযোগ দিতে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে-এমন কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ তাদেরকে কিছু বলেননি। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ওবায়দুল ইসলাম বলেন, চালকলগুলো শিল্পের আওতায় পড়ে কী-না তা জানতে বিউবোর উপর মহলে যোগাযোগ করছেন তিনি। চালকল চালাতে এসটি লাইনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন হয়।
আরিফুর রহমান টগর/আরএইচ/এএসএম
Advertisement