দিন বদল ও আধুনিকতার আশীর্বাদে হারিয়ে যেতে বসেছে পালপাড়ার সেই রমরমা অবস্থা। এক সময় মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, ঘটি, মটকা, সরা, কাসা, কলস, ব্যাংক, প্রদীপ, পুতুল, কলকি ও ঝাঝরের বিকল্প ছিল না। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া আর মানুষের রুচির পরিবর্তনে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের নানা সামগ্রী। তাই বাজারে চাহিদা কম এবং কাঁচামালের চড়া মূল্য আর পুঁজির অভাবে টিকতে না পারায় সংকটে পড়েছে পাবনার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পীরা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাঁচতে পারে এ শিল্প।
Advertisement
মৃৎশিল্পীরা জানান, ব্যবহারিক জীবনে এখন মৃৎশিল্পের তেমন আর ভূমিকা নেই। এ শিল্পে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত না হওয়ায় বর্তমানে এই পেশায় টিকে থাকা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের গৌড়িপুর পালপাড়ায় গেলে দেখা যায়, ভোরের আলো ফুটতেই মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে রোদে শুকাতে দিচ্ছে কুমাররা, কেউ বা ব্যস্ত সময় পার করছেন বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে, কেউ বা করছেন রং এভাবেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলছে তাদের কর্মব্যস্ততা।
পালপাড়ার মায়া রাণী বলেন, দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এ কাজ করি। আগে মাটির সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা থাকলেও এখন আর তেমন নেই। শীত মৌসুমে পিঠাপুলির সামগ্রী তৈরি করেই কোনোমতে চলে সংসার।
Advertisement
তিনি জানান, এমনিতেই ব্যবসা চলে কম তার ওপর নেই রাস্তাঘাট তাই গৌড়িপুর পালপাড়া থেকে নিমাইচড়া বাজার পর্যন্ত পাকা সড়কের দাবি জানান তিনি।
কাঁচামাটির পাত্র পুড়িয়ে পরিণত করতে ব্যস্ত দুলাল পাল। এ ব্যস্ততার ফাঁকে তিনি বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে বাপ-দাদার শেখানো পেশায় কাজ করছি। আগের দিনে বাজারে মৃৎপাত্রের প্রচুর চাহিদা থাকলেও এখন অনেকটাই কম। অন্য কাজ জানা নেই তাই এ পেশাই আঁকড়ে ধরে আছি।
দুলাল পাল জানান, পেশাগত প্রয়োজনে ব্যাংক ঋণ পান না তারা। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর যাবে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ খুবই প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিকাশ পাল, সম্বল পাল, দরদী পাল ও সুবর্ণা পাল জানান, এক সময়ে এই গ্রামে মৃৎশিল্পের রমরমা ব্যবসা ছিল। আগে গৌড়িপুর গ্রামে প্রায় ১১০ ঘর মৃৎশিল্পের কাজ করতো। কিন্তু এখন ১০-১৫ ঘরে প্রায় ৩০-৩৫ জন পাল এ কাজের জড়িত।
Advertisement
তারা বলেন, এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
এ ব্যাপারে গোপাল চন্দ্রপাল বলেন, আগের দিনে মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন এঁটেল মাটি, রং, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি ছিল সহজলভ্য। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাড়ির উঠোনে পাত্রগুলোতে রং করতে করতে উজ্জ্বল কুমার পাল জানান, সাধারণত মৃৎপাত্রগুলো কুমার পরিবারের নারী-পুরুষ উভয়ে মিলেমিশে তৈরি করে। এই তৈরিকৃত সামগ্রী বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এসে কিনে নিয়ে যান। অনেকে আবার বাড়ি বাড়ি ফেরি করেও বিক্রি করেন।
তিনি বলেন, শুধু পাবনা নয়, গোটা দেশে এ পেশায় নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কারও যেন মাথাব্যথাই নেই।
অনিতা ও প্রার্থনা পাল বলেন, আগের দিনে ব্যবসা অনেক ভালো চলতো বর্তমানে মানুষ প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করায় এখন কম চলে। আগে কলসিসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করলেও বর্তমানে তা ব্যবহার কম হওয়ায় এখন শুধু ঝাঁঝর, কাসা, হাঁড়ি পাতিল তৈরি করি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পাবনা জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের এখন দুর্দিন চলছে। বিশেষ করে মৃৎশিল্প অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে আমরা কারিগরদের সঙ্গে ছিলাম এবং থাকবো। তাদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তার ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ ব্যবস্থা রয়েছে। তারা যোগাযোগ করলে অবশ্যই সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া স্থানীয় কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে চাইলে সে ব্যাপারেও আমরা সহযোগিতা করা হবে।
আলমগীর হোসাইন নাবিল/এএইচ/জিকেএস