দেশের উত্তরাঞ্চলে মিঠা পানির মাছের সবচেয়ে বড় উৎস চলনবিলে দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের সুবিশাল এই জলাভূমিতে মাছের সরবরাহ কম থাকায় জীবিকা নির্বাহের জন্য হিমশিম খাচ্ছেন স্থানীয় জেলেরা। দখল দূষণে চলনবিলের পরিসর কমে যাওয়া, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে অনাবৃষ্টিতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় দিন দিন মাছের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে বলে মত জেলেদের। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন মৎস কর্মকর্তারাও।
Advertisement
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে জেলেরা চলনবিল এলাকার বিভিন্ন জলাশয় থেকে মোট ৪,০৮৫ টন মাছ ধরেছিলেন। এ বছর বিলে পানি শূন্যতায় মাছের প্রজনন হয়নি। ফলে উৎপাদন অনেক কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বছরের শেষে মোট উৎপাদন হিসেব করা হবে।
চলনবিলের জেলেরা জানান, বর্ষার পানি চলনবিলে প্রতিবছরের মতো প্রবেশ করলেও এবার এক মাসও পানি থাকেনি। ফলে জলাভূমির মৎস্য উৎপাদন কমে গেছে।
চাটমোহর উপজেলার চিনাভাতকুড় গ্রামের জেলে ফনীন্দ্রনাথ হালদার জানান, আগে অক্টোবর-নভেম্বরে পানির স্তর নিচে নেমে গেলে আমরা সহজেই দিনে ২-৩ হাজার টাকার মাছ ধরতে পারতাম। এখন এক হাজার টাকা আয়ের মতো মাছও নেই।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ১০ বছর আগেও চলনবিলে ছয় মাস ও নদীতে সারা বছর পানি থাকতো। সারা বছরই পর্যাপ্ত মাছ ও পাখি থাকতো। বর্তমানে বিলে দুই মাস ও নদীতে তিন মাস পানি থাকে। ছয়টি বড় নদীতে হাঁটুর নিচ পরিমাণ পানি থাকায় মাছ শূন্য হয়ে যাচ্ছে চলনবিল। গত ১০ বছরে চাঁন্দা ও পাবদাসহ নানা ধরনের মাছ বিল থেকে হারিয়ে গেছে।
চাটমোহর উপজেলার বিশ্বনাথপুর জেলে সমিতির সভাপতি স্বপন কুমার হালদার জানান, চলনবিলের ১০৮ একর জমি তিন বছরের জন্য ২০ লাখ টাকা খরচ করে লিজ নিয়েছি। কিন্তু এ বছর পর্যাপ্ত মাছ পাচ্ছি না। সমিতির মোট ২২ জেলে দিনে ১.৫ মণ মাছও ধরতে পারে না, যা গত বছর প্রাপ্ত মাছের অর্ধেকেরও কম।
চাটমোহর উপজেলার ঊর্ধ্বতন মৎস্য কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন জানান, সাধারণত শীতকালে পানির স্তর নেমে যাওয়ার আগে চলনবিলে বর্ষার পানি প্রায় তিন মাস থাকতো। এই সময়ে মাছের পোনা পরিপক্ক হয়ে ওঠে এবং আহরণের জন্য প্রস্তুত হয়। এই বছর পানি বেশি সময় থাকেনি। ফলে মাছ বৃদ্ধির সুযোগ পায়নি। পোনা অবস্থায়ই মাছ গভীর জলে চলে বা জলাভূমির সঙ্গে সংযোগকারী নদীতে স্থানান্তরিত হয়েছে, তাই মাছের মজুদ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পরিসংখ্যান মতে, পাবনা-সিরাজগঞ্জ-নাটোর জেলার ৮ উপজেলা বেষ্টিত চলনবিলের (বর্তমান) দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০০ কিলোমিটার। আর বিলের ভেতরে রয়েছে ১ হাজার ৫৭০ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তনের ১৬টি ছোটবড় নদ ও নদী এবং ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৩২টি খাল। চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত বড়াল, গুমানী, করতোয়া, আত্রাই, নন্দকুঞ্জা, তুলশি, পদ্মাবতী, চিকনাই, বানগঙ্গা নদীর গড় প্রশস্থতা ছিলো দেড় হাজার ফুট।
Advertisement
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল হোসেন বলেন, দীর্ঘকাল খনন বা সংস্কার না করা এবং পানির স্রোত না থাকায় অধিকাংশ খাল-বিল আর নদ-নদী ভরাট হয়ে গেছে। নদীর নাব্য হারিয়ে গেছে। বড়াল নদীটি এখন মৃতপ্রায়। চলনবিলের মাঝ দিয়ে নির্মাণ হয়েছে বনপাড়া-হাটিকুমরুল সংযোগ মহাসড়ক। এটারও একটি প্রভাব এখন স্পষ্ট চলনবিলের পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর।
তিনি আরও বলেন, চলনবিলে পানি না থাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে গেছে মারাত্মকভাবে। দেশী মাছের প্রজনন ক্ষেত্র এখন নেই বললেই চলে। বর্ষায় চলে অবাধে মাছ শিকার। মা মাছ, পোনা মাছ নিধন থামানোর কেউ নেই। অন্যদিকে জমিতে উচ্চ দ্রবণীয় কীটনাশক ব্যবহার বাড়ছেই। এই কীটনাশক মাছের বংশ ধংস করছে।
চলনবিল উদ্ধার আন্দোলনের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, শুধু মাছই না, চলনবিল পানিশূন্য হয়ে পড়ায় ব্যাঙ, শামুক ও কাঁকড়া অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। চলনবিলে অবাধে পুকুর খনন ও রাস্তা নির্মাণের ফলে এই পরিস্থিতি। চলনবিল রক্ষা করতে সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সরকারকে নজর দিতে হবে।
এএইচ/এমএস