দেশজুড়ে

তিন কোটি টাকার নতুন টেন্ডারে পুরোনো সিন্ডিকেটের কারসাজি

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সর্বনিম্ন দরদাতাকে পিপিআর বহির্ভূত শর্তের অজুহাতে বাদ দিয়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নেওয়ার পায়াতারা চালাচ্ছে আওয়ামী আমলের সেই পুরনো মাফিয়া সিন্ডিকেট। ৩৭ লাখ টাকায় কেনা পর্দাকাণ্ডের মতো দুর্নীতির ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচিত এই হাসপাতালটিতে বর্তমান সরকারের আমলেও নানা মহলকে ম্যানেজ করে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থ বছরের পথ্য সরবরাহ কাজের জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় বারের মতো রি-টেন্ডার (পুনঃদরপত্র) আহ্বান করে। টেন্ডার প্যাকেজ নং-২। সতেরটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিডিউল কিনলেও টেন্ডার জমা দেয় ৬টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মেসার্স ছিদ্দিকী এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২ কোটি ১৮ লাখ টাকার দর দাখিল করে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজের জন্য নিবার্চিত না করে আরও ৪০ লাখ টাকা বেশি দরে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ওই কাজের ঠিকাদার হিসেবে নির্বাচিত করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি।

গত ৪ নভেম্বর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভার সারসংক্ষেপে বলা হয়, পথ্য সামগ্রী সরবরাহের ওই টেন্ডারে মেসার্স ছিদ্দিকী এন্টারপ্রাইজ তাদের দাখিলকৃত দরপত্রের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা সনদপত্রের মূল কপি দাখিল না করায় এবং দরপত্রের সঙ্গে দাখিলকৃত দুটি অভিজ্ঞতা সনদপত্রদাতার স্বাক্ষর একই ব্যক্তির হওয়া সত্ত্বেও স্বাক্ষরের সুস্পষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। বিষয়টি স্বাক্ষর জালিয়াতি বলে প্রতিয়মান হয়েছে।

জানা গেছে, পথ্য সরবরাহের কাজের এই পুনঃদরপত্রের আগে গত জুলাই মাসে পথ্য সরবরাহ কাজের প্রথম টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল। আর ওই টেন্ডারেও সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল মেসার্স ছিদ্দিকী এন্টারপ্রাইজ। তবে একই কায়দায় অভিজ্ঞতা সনদপত্রের অসঙ্গতির অভিযোগে তাদের ওই কাজ দেওয়া হয়নি। যদিও সেসময়ে ওই অভিজ্ঞতা সনদ যাচাইয়ের জন্য সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের নিকট লিখিতপত্র দেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক। স্মারক নং- পরিঃ/বিএসএমএমসিএইচ/ফরিদপুর/২০২৪/২৪২, তারিখ- ২৯ জুলাই ২০২৪। ফিরতিপত্রে স্মারক নং- পরিঃ/শঃতাজঃআঃমেঃকঃহাসঃ/গাজীঃ/২০২৪/১৭৭৩ নং এক পত্রে শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আমিনুল ইসলাম ওই অভিজ্ঞতা সনদ যাচাইবাছাই করে সঠিক বলে জানান।

Advertisement

অন্যদিকে প্রথম টেন্ডার ডকুমেন্টসে অভিজ্ঞতা সনদের বিষয়ে কোনো শর্ত ছিল না। তবে পুনঃটেন্ডারে অতিরিক্ত ওই অভিজ্ঞতা সনদের মূল কপি দাখিলের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সিন্ডিকেট ভুক্তদের কাজ পাইয়ে দিতে পুনঃটেন্ডারের দরও বৃদ্ধি করা হয় যাতে অন্যরা অভিজ্ঞতার শর্তে আটকে যায়।

এ ব্যাপারে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ছিদ্দিকী এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী গত ১৩ নভেম্বর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের নিকট একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।

তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী অভিযোগে বলেন, টেন্ডারের সঙ্গে দাখিলকৃত কাগজপত্রের মূল কপি দাখিল করাটাই পিপিআরের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কোনো প্রকার অনুসন্ধান না করেই রেজুলেশনে তার কাজের অভিজ্ঞতা সনদপত্রকে জাল হিসেবে উল্লেখ করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি তার ব্যবসায়ীক সুনাম নষ্ট করেছে। তার ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে কিছু অসৎ কর্মচারীর যোগসাজশে তারা এই অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। তিনি দাখিলকৃত টেন্ডার ডকুমেন্টস সঠিকভাবে যাচাইবাছাই করে তার দরপত্র গ্রহণের দাবি জানান।

প্রাপ্ত অভিযোগে জানা গেছে, গত প্রায় ১৫ বছর ধরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেন্ডারবাণিজ্য ঘিরে একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই টেন্ডারবাজীর নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ছোট ভাই। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে ফমেক হাসপাতাল ছাড়াও ফরিদপুরের এলজিইডি ও বিএডিসিসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র টেন্ডারবাজি চালিয়ে গেছে এই সিন্ডিকেট।

Advertisement

অভিযোগ রয়েছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই সিন্ডিকেটের হয়ে দাপ্তরিকভাবে নানা মহলের সঙ্গে যোগাযোগের কাজ করেন প্রধান সহকারী ও বর্তমানে প্রধান হিসাবরক্ষকের দায়িত্বরত মহিউদ্দিন চৌধুরী সোহান। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে পর্দা কেলেঙ্কারী মামলার আসামি ও তৎকালীন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দন্ত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. গণপতি বিশ্বাস শুভ’র ভাই একই হাসপাতালের আরেক অফিস সহকারী প্রকাশ বিশ্বাস ও মো. মোবাশ্বের হোসেন।

নিজেদের কোনো সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে মহিউদ্দিন চৌধুরী সোহান দাবি করেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো সব উপরের স্যারেরা দেখভাল করেন। তারা এসব বিষয়ে কিছু জানেন না।

তবে মোবাশ্বের হোসেন ও প্রকাশ বিশ্বাসের বক্তব্য জানা যায়নি।

জানতে চাইলে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ডা. আব্দুল গনি আহসান বলেন, দরপত্রে দাখিলকৃত ডকুমেন্টস যাচাইবাছাইয়ের জন্য অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ হয়। এজন্য অভিজ্ঞতা সনদের মূল কপি দিতে বলা হয়েছিল। আর অভিজ্ঞতা সনদের স্বাক্ষরে মিল না থাকায় তাদের কাছে সেটি জালিয়াতি মনে হয়েছে। এ কারণে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে রেসপনসিভ বিবেচনা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. হুমায়ন কবীর বলেন, নিয়ম অনুযায়ী পিপিআর মেনেই টেন্ডার ডকুমেন্টসে মূল কপি যুক্ত করতে বলা হয়। তবে মেসার্স ছিদ্দিকী এন্টারপ্রাইজ মূল কপির পরিবর্তে সত্যায়িত সনদপত্র দাখিল করেন। সেটি আসল না জাল তা জানার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমরা মূল কপি চেয়েছি। তিনি দেননি।

তিনি মেসার্স ছিদ্দিকী এন্টারপ্রাইজের লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন জানিয়ে বলেন, নির্বাচিত ঠিকাদারকে নোয়া (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) দেওয়ার পরে আমরা তাকে লিখিতভাবে অভিযোগের জবাব জানিয়ে দিবো।

এছাড়া ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ঘিরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উল্টো আরও সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করে বলেন, এখানে এসেই তিনি এরইমধ্যে নার্সদের একটি সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছেন।

এফএ/এমএস