মতামত

সরকার চাইলেই কি জিনিসপত্রের দাম কমাতে পারে?

অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় অস্বস্তির নাম দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে নিত্যপণ্যের দাম কমার যে প্রত্যাশা জনমনে তৈরি হয়েছিল, সেটি পূরণ হওয়ার বদলে অনেক ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটছে।

Advertisement

জনপরিসরে এই ধারণা ও বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু নির্দলীয় এবং একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এমন কিছু মানুষকে নিয়ে এই সরকার গঠিত হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ নেই— ফলে তারা বাজারব্যবস্থায় বিদ্যমান সিন্ডিকেট ভেঙে চাঁদাবাজির মূলোৎপাটন করবেন; যার মধ্য দিয়ে জিনিসত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। কিন্তু সেই স্বস্তি এখনও ফেরেনি। বরং সবজি ও ডিমের দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে দারুণ অস্বস্তি বিরাজ করছে।

গত কয়েকদিনে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করলেও এটি টেকসই করা বিরাট চ্যালেঞ্জ। সে কারণেই এই প্রশ্নটির সুরাহা করা দরকার যে, সরকার চাইলেই নিত্যপণ্যের দাম কমাতে পারে কি না? শুধু সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজিই বাজারের প্রধান সমস্যা কি না?

সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি হচ্ছে বাজারের সবচেয়ে পপুলার ইস্যু। ফলে এটা নিয়ে কথা হয় বেশি। এর বাস্তবতাও আছে। কোন আমলে সিন্ডিকেট বেশি ছিল; কোন দলের লোকেরা কত বড় চাঁদাবাজ; কোন বাজার থেকে প্রতিদিন কত টাকার চাঁদাবাজি হয় এবং সেই টাকার ভাগ কোন মন্ত্রী-এমপি-মেয়র-কাউন্সিলর-পুলিশিং ও লোকাল মাস্তানদের পকেটে যায়, তা নিয়েও অনেক সংবাদ গুগলে সার্চ করলে পাওয়া যাবে। এছাড়া কোন কোন কোম্পানি মুরগি ও ডিমের বাজার অস্থিতিশীল করে রাখে; কোন কোন কোম্পানি তেল ও চিনির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে— তাও এখন আরও গোপন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এর বাইরেও জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষ তথা স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে পণ্যের উৎপাদন খরচ।

Advertisement

গত ৯ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠের একটি খবরের শিরোনাম: ভারত থেকে ডিম আমদানি, পিস ৬ টাকা। তার মানে ডজন ৭২ টাকা। এর সঙ্গে শুল্ক যুক্ত হয়, তাতেও ডজন কি একশ টাকার বেশি হওয়ার কথা? ভারতের ভেতরে ডিমের ডজন কীভাবে একশ টাকা হয়? একইরকম জলবায়ু-আবহাওয়ার পরেও ডিমের দামে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এত বেশি পার্থক্য কেন?

বাংলাদেশে ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও খামারিদের তরফে বলা হয়, ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কী পরিমাণ বেড়েছে এবং কেন বেড়েছে? ভারতের মুরগি বাংলাদেশি মুরগির চেয়ে বেশি খাবার খায় নাকি বাংলাদেশের মুরগিকে কলকাতার মুরগির চেয়ে উন্নত খাবার দিতে হয়?

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগির ডিমের ডজন দেড়শ বা তার আশেপাশে থাকে। কখনো দুইশও ছাড়িয়ে গেছে। আবার ‘ব্রাউন এগ’ নামে পরিচিত কিছু প্যাকেজাত ডিম পাওয়া যায়, যেগুলোর ডজন আড়াইশ টাকার বেশি। সেটিকে ব্যতিক্রম রেখে সাধারণ মানুষ যে ডিম কেনে, সেটির ডজন যদি দেড়শ টাকাও হয়, তাহলে প্রতিটা ডিমের খুচরা পর্যায়ে দাম হয় সাড়ে ১২ টাকা। অথচ সরকার সম্প্রতি প্রতি ডজন ডিমের দাম খুচরা পর্যায়ে ১৪২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

গত শুক্রবার রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি দোকান থেকে ১৭০ টাকায় ডজন কিনি। দোকানিকে বললাম, সরকার তো ১৪২ টাকায় বিক্রি করতে বলেছে। তিনি বলেন, ১৪২ টাকায় বিক্রি করতে হলে আমাকে ১৩০ টাকায় কিনতে হবে। কিন্তু কিনতে হয়েছে ১৫৭ টাকায়। এই দামে কিনে ১৪২ টাকায় বিক্রি করব কীভাবে? জিজ্ঞেস করলাম, কেন এত দাম? দোকানি বললেন, দেশে ডিমের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বড় কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট অত্যন্ত শক্তিশালী। তাদের সিন্ডিকেটের কারণে অনেক ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাও ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। যদি এই অভিযোগ সত্য হয় তাহলে সরকারের উচিত হবে এ বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান করা।

Advertisement

সুতরাং, সরকার ডিমের দাম কমাতে পারে কি না—সে প্রশ্নের উত্তর হলো, পারে। তবে তার আগে অসুখ চিহ্নিত করে কার্যকর ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। শুধু ভয়ভীতি, ভর্তুকি আর পুলিশ দিয়ে বাজার ঠিক করা যায় না। যায় না তার প্রমাণ ১৪২ টাকায় ডিম বিক্রি হচ্ছে না।

বাগেরহাটের একজন সাংবাদিক তার মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন: ডিম উৎপাদনের জন্য প্রথমে মুরগির বাচ্চা কিনতে হয়। তার দাম অনেক বেড়েছে। এরপর সেই মুরগি লালন-পালনের জন্য যে খাবার দিতে হয়, তার দামও অনেক বেড়েছে। অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ খরচও অনেক। সব মিলিয়ে একটা ডিম উৎপাদনে ১১ থেকে ১২ টাকা খরচ হয়। তার কাছ থেকে পাইকাররা কিনে নেন। তাদের কাছ থেকে আড়তদার। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতা। খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে অনেক ধরন আছে। যেমন রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মতো বড় বাজারে যে দাম, একটু দূরে পাড়া-মহল্লার বাজারে তার চেয়ে কিছুটা বেশি হয়। এভাবে প্রতিটা ডিমে এক টাকা করে লাভ করতে হলেও খুচরা পর্যায়ে দেড়শ টাকার কমে ডজন বিক্রি করা কঠিন।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পরে অনেকেরই আয় কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বসে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের আয় কমে গেছে। সুতরাং দাম কমলেও এই শ্রেণির মানুষের খেয়েপরে টিকে থাকা কঠিন। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি অভ্যুত্থানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার ব্যাপারেও সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।

রাষ্ট্র বা সরকার এখানে কী করবে? তার কাজ হচ্ছে, মুরগি উৎপাদনের খাবারের দাম কেন বাড়লো— তা খতিয়ে দেখা। যদি কোনো ফিড আমদানিনির্ভর হয়, সেখানে কোনো জটিলতা আছে কি না। ডলারের দামের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। পোল্ট্রি ফিডের দাম নিয়ে কোনো কারসাজি বা অতি মুনাফার ব্যাপার থাকলে সেটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শোনা যায়, মূল সিন্ডিকেটটা এখানেই। আবার আমদানি প্রক্রিয়ায় জটিলতা থাকলে সেটিও দূর করা দরকার।

অতি মুনাফার প্রমাণ পেলে মোটা অংকের জরিমানাই শুধু নয়, প্রতীকী অর্থে হলেও বড় ব্যবসায়ীদের দু-তিনদিনের জন্য জেল দেওয়া দরকার। কেননা বড় ব্যবসায়ীদের জন্য মোটা অংকের জরিমানা দেওয়া খুব অসুবিধার ব্যাপার নয়। কারণ তারা পরবর্তী চালানে ওই জরিমানার চেয়ে বেশি মুনাফা তুলে নেন। কিন্তু তাকে যদি দু-তিনদিন জেলে রাখা যায়, এটি তার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। দশ লাখ টাকা জরিমানার চেয়েও এর প্রভাব বেশি। এই ধরনের শাস্তি ব্যবসায়ীদের মনে সত্যিই ভয় তৈরি করবে। তবে তার আগে এটা নিশ্চিত হতে হবে যে, তারা সত্যিই কারসাজি করছেন।

অনেকে মনে করেন, ভারত থেকে আমদানি করা ডিমের চেয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত ডিমের দাম যদি প্রায় দ্বিগুণ হয়, তাহলে দেশীয় উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে ডিম কেনার দরকার কী? চাহিদার শত ভাগ আমদানি করা হোক। তাহলেই সব সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। কেননা দেশীয় খামারিদের সুরক্ষার অজুহাতে গরুর মাংসের কেজি ৮০০-তে গিয়ে ঠেকেছে। প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ যদি কিনতেই না পারে, তাহলে দেশীয় খামারি ও উৎপাদকদের সুরক্ষা দেওয়া হবে কার স্বার্থে?

এখানে সমস্যা হলো, যে কোনো পণ্য শত ভাগ আমদানিনির্ভর হলে রপ্তানিকারক দেশের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয় এবং যে কোনো সময় যে কোনো অজুহাতে তারা জিম্মি করতে পারে। দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে শতভাগ আমদানিনির্ভরতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য যাতে আমদানির্ভর না হয়, সেই চেষ্টা করাই যুক্তিযুক্ত। রাষ্ট্রকে এখানে বড় ভূমিকা নিতে হয়। নিত্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কাঁচামালের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং দাম যাতে না বাড়ে এবং সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা যাতে কাঁচামালের দাম অনেক বাড়তে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখা দরকার। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়ায় গলদ বের করা জরুরি।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ সব পর্যায়ে এক নয়। বড় কোম্পানিগুলো কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ ১৩০-৪০ টাকা হলেও প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ ১৭৫ টাকার মতো। যে কারণে পোল্ট্রি শিল্প এখন আর প্রান্তিক খামারিদের কাছে নেই। চলে গেছে করপোরেট হাউজগুলোর দখলে। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং সরকারেন উচিত হবে এখানে সুশাসন নিশ্চিত করা।

সবজির দামের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাম্প্রতিক বন্যায় শত শত একর জমির সবজি নষ্ট হয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। এখন শীতের আগাম সবজিতে বাজার সয়লাব থাকার কথা ছিল। কিন্তু হচ্ছে উল্টো। এর বাইরে সার ও কীটনাশকের দাম বেড়েছে অনেক। কেন সার ও কীটনাশকের দাম এত বাড়লো, কারা এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তারা অতিরিক্ত মুনাফা করে কি না, আমদানি পর্যায়ে জটিলতা আছে কি না—তা খতিয়ে দেখে সুরাহা করা দরকার।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিও একটা বড় কারণ। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনও বড় ইস্যু। কেননা অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা ও খরায়ও প্রচুর ফসলহানি হয়। এক্ষেত্রে সরকারের কৃষি বিভাগ প্রান্তিক কৃষকদের পাশে কতটা শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছে—সেটি বিরাট প্রশ্ন।

নিত্যপণ্যের দাম বেশি বাড়লে তার প্রথম শিকার হয় সাধারণ মানুষ। কেননা জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও সচ্ছল মানুষেরা তা কিনতে পারেন। সম্প্রতি ইউএনডিপির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যসীমায় বাস করছেন ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর। সুতরাং এই শ্রেণির মানুষ কী করে দেড়শ বা তার চেয়ে বেশি দামে ডিম কিনবেন? এই মানুষেরা কি একশ টাকা কেজিতে সবজি কিনতে পারেন?

সরকার চাল-ডাল-তেল-চিনির মতো এখন খোলাবাজারে সবজি ও ডিমও বিক্রি করছে, সেই সুবিধা কতজন মানুষ পাচ্ছেন? প্রয়োজনের তুলনায় খোলাবাজারে পণ্যের সরবরাহ বরাবরই যথেষ্ট কম থাকে। এখানে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো দরকার। কিন্তু পণ্যের উৎপাদন কম হলে খোলাবাজারে সরবরাহ বাড়ানো কঠিন। অর্থাৎ সরকার যে ব্যবস্থাই নিক না কেন, আগে উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং উৎপাদনের প্রতিটি চেইনে নজরদারি করতে হবে যে কোথাও ঘাপলা আছে কি না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে গিয়ে জরিমানা করবে এটি একটি উদ্যোগ। কিন্তু পণ্যের উৎপাদন যদি পর্যাপ্ত থাকে, তখন দাম এমনিতেই সাধারণের নাগালে চলে আসে। উৎপাদন কম হলে শুধু পুলিশিং ও ভয়ভীতি দেখিয়ে লাভ নেই।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পরে অনেকেরই আয় কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বসে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের আয় কমে গেছে। সুতরাং দাম কমলেও এই শ্রেণির মানুষের খেয়েপরে টিকে থাকা কঠিন। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি অভ্যুত্থানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার ব্যাপারেও সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।

আগের সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অনেক ব্যবসায়ী গ্রুপ ও গ্রুপের মালিকরা হয় কারাগারে, না হলে পলাতক। তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ কর্মীদের চাকরি অনিশ্চিত। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাদের বিচার হতে হবে। কিন্তু তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মীরা যাতে চাকরিচ্যুত না হন বা তাদের বেতন যাতে বন্ধ না হয়, সেদিকেও সরকারের খেয়াল রাখা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস