সাহিত্য

সময়ের জন্ম

অভিন্নর মাথায় একটি উপন্যাসের চাষ চলছে বহুদিন ধরে। কিন্তু লেখার খাতায় গল্প কোনোভাবেই যেন এগোয় না। এজন্য বহুবার বসেছে। তাতে বরং সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের হিসাব মেলানোর কাজই হয়েছে বেশি। এত হিসাব মেলাতে গিয়ে অভিন্ন খেই হারিয়ে ফেলে। এবার লিখবই–এ প্রত্যয় নিয়ে সে বসেছে। কিন্তু শুরুটা করতে পারেনি। কেন পারেনি এর কোনো সদুত্তর তার নিজের কাছেই নেই। মনে হয়েছে লেখার সময় কলমের বিপরীতে সাদা কাগজের মাঝবরাবর অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি হয়। দেয়ালের ফাঁকফোকরে তাই কলম চালাতে হয়। খাতার পাতায় আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে সময় বয়ে যায়। একপর্যায়ে সে বিরক্ত হয়ে পড়ে। খাতাকলম ছুড়ে ঝট করে উঠে পড়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। এমনটি দেড় বছর ধরেই অভিন্নর জীবনে ঘটছে। কিছুতেই তার মাথায় চাষ করা উপন্যাসের আর প্রকাশ ঘটছিল না। উপরন্তু মাথায় আরও অনেক ভাবনা-জিজ্ঞাসা এসে জড়ো হয়। নিজেকে এ প্রশ্নও অনেকবারই করেছে–কোথা থেকে শুরু হবে কিংবা কোথায় শেষ হবে। কোনো প্রশ্নের উত্তর সে আজও পায়নি। নিজের অজান্তে কাজ করে নানা প্রশ্ন। গল্পের যেখানে শুরু সেখান থেকে সামনে কি আর কিছু অবশিষ্ট থাকে? উপন্যাসে নায়ক যেখানে পরিণতি পায় তারপর তার জীবনের গতির প্রতি আমাদের আর মনোযোগ থাকে না কেন? এমন অস্তিত্বসুলভ প্রশ্ন নিয়েই অভিন্নকে যন্ত্রণায় ভুগতে হয়।

Advertisement

অভিন্নর এ অস্থিরতা ওর প্রিয় বন্ধু আরম্ভের দৃষ্টি এড়ায় না। আরম্ভ আর অভিন্নকে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বললে ভুল হবে না। তার পরও আরম্ভ একটু বেশিই অন্য ধাঁচের মানুষ। বাস্তববাদী, অসম্ভব দৃঢ়চেতা। প্রত্যয়ী। কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলে করে ছাড়ে। কাজ জমিয়ে রাখার মতো অলসতা ওর নেই। দেশে গ্র্যাজুয়েশন করে চলে গেল কলকাতা। সেখানে মাস্টার্স সম্পন্ন করে।

দুই বন্ধুর জীবনে প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা হাজারো। তার পরও দুজন উজানমুখী। যদিও দুজন দুই মেরুর মানুষ কিন্তু যাপিত জীবনে দুজনের বৈসাদৃশ্য খুব কম, সাদৃশ্যই বরং চোখে বেশি ধরা পড়ে। বৈসাদৃশ্য বলতে এটুকুইÑঅভিন্ন খুব অন্তর্মুখী আর আরম্ভ বরাবরই নিজেকে মেলে ধরতে ভালোবাসে। বৈসাদৃশ্যের এ পার্থক্যটুকু ঘুচিয়েই তাদের বন্ধুত্বের ভিত মজবুত হয়েছে। একে অন্যের সহায়ক ও হৃদ্যতার আশ্রয় গড়ে উঠেছে এ বন্ধুত্বে। যে কাজই হোক পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে দুজনের কোনো দিন ঝামেলা হয় না।অভিন্ন যতবার কলকাতা গেছে, ততবারই গঙ্গার ধারে অনেক সময় কাটিয়েছে। গঙ্গা অভিন্নকে ভীষণ টানে। একবার শীতে অভিন্ন আর আরম্ভ কলকাতা বেড়াতে গিয়েছিল। কলকাতা যাওয়া মানেই অভিন্নর জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, শান্তিনিকেতনে একবার হলেও ঢুঁ মারা চাই। কলকাতায় ট্যুর দিতে হলে দুজন আগে দার্জিলিং ঘোরার পরিকল্পনা রাখে। তারপর না হয় অন্য কোনো জায়গা ঘোরা যেতে পাড়ে। সেবার দার্জিলিংয়ে শীতের দাপট একটু বেশিই ছিল। দিনরাত সবকিছুই কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকে। লেখালেখির অনেক রসদ আছে। এমন প্রেক্ষাপটে একটু নিবিড় মনোযোগ দিলে সহজেই গল্পের কাঠামো কল্পনায় গড়ে ওঠে। বহু লেখক তাই ঘুরতে গিয়েও শুধু তাকিয়ে দেখেছে সবকিছু। অভিন্নর অবশ্য তা লাগে না। আরম্ভ ভালোই জানে। আরম্ভ নিজে লেখক না হলেও বিদগ্ধ পাঠক হিসেবে বন্ধুমহলে পরিচিত।

সেবারই অভিন্ন আরম্ভকে প্রথম জানাল, ‘ঐশীর সম্পর্কে আমি অনেকবার ভুল করেছি। এখনও যে করি না তা নয়। স্বপ্নবান মানুষের যেমন কখনও কখনও খুব বড় ভুল হয়ে যায়, তেমনই ভুল হয়ে চলেছে আমার ঐশীর ক্ষেত্রে। আমার ধারণা ছিল, ঐশী রিয়াজ মাহমুদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। আরম্ভ, তুই জানিস আমি ঐশীকে চাই। খুব করে চাই। কিন্তু ঐশীকে কেন যেন বুঝতে পারি না। যখন জানলাম ঐশীর সঙ্গে রিয়াজের সম্পর্কটা নিছক বন্ধুত্বের সীমানার বাইরের নয়, তখন আমার ব্যাকুলতা বেড়ে গেল। ওইতো একদিন একজন আমাকে ঠাট্টা করে বলছিল, “তুমি খুব ভেতরমুখী”। গতবার একটি ঈদ ম্যাগাজিনে সুবর্ণরেখা নামে গল্পটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল মুখ্য দুটি চরিত্র তুমি ও ঐশী। কেনই বা গল্পটার কাহিনী এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিলাম তা-ও জানতে চেয়েছিল। সেদিন ওর এসব প্রশ্নের কোনো উত্তরই আমি দিইনি। ওই নিরুত্তর থাকাটা আমার ইচ্ছাকৃত ছিল না। আসলে কেন জানি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারছিলাম না। আমার ভাবনাগুলো তখন মনে হয়েছিল মিছিলের পেছনে ফেলে যাওয়া ধুলা। পথেই শুরু, মিছিলের পেছনে শেষ।’

Advertisement

অভিন্ন আনমনা হলে তা আরম্ভের নজর এড়ায় না। অন্তর্মুখী এ মানুষটাকে আবেগ যখন প্রচণ্ডভাবে জাপটে ধরে, তখন ক্ষণিকের জন্য যেন সে নীরব হয়ে যায়। এখনও তেমনি এক মুহূর্ত সামনে। আরম্ভ অবশ্য অভিন্নকে তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতে চায় না।

আরম্ভের প্রস্তাব, ‘চল তাহলে আমরা এবার শান্তিনিকেতনে কিছুটা বেশি সময় কাটিয়ে যাই। ঐশীর সঙ্গে আমি কথা বলব। ও তো আরও প্রায় দুই বছর ওখানেই থাকবে।’আরম্ভের কথায় অভিন্ন কোনো সায় দেয়নি। ওর কাছে উত্তর নেই হয়তো। আরম্ভ অভিন্নর কাতরতা বাইরের অভিজ্ঞতার নিরিখে বুঝতে পারে। যতবার এ প্রসঙ্গ তাদের মাঝে এসেছে, ততবারই অভিন্ন আড়ষ্টতার গণ্ডিবদ্ধ হয়ে গেছে। আরম্ভ ওর এ আচরণের কারণ বুঝতে পারলেও কীভাবে ওকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বের করবে বুঝতে পারে না। ঐশী রবীন্দ্রসংগীতের ওপর স্কলারশিপ নিয়ে দেড় বছর আগে শান্তিনিকেতনে আসে। ও ছোটবেলা থেকেই গান করে। স্কুলের গণ্ডি পেরোবার আগে দেশের কয়েকজন নামকরা ওস্তাদের কাছে তালিম নিতে শুরু করে। গানের গলা ভালো, তাই অনেক অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ে। ওরা তিনজন ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত একই কলেজে পড়েছে। ঐশী ও রিয়াজ ইকোনমিকসে অনার্স করে ওই কলেজ থেকেই। আরম্ভ আর অভিন্ন ছিল পাস কোর্সে। একই কলেজে পড়ায় চেনাশোনাও ছিল। রিয়াজ আর ঐশীর সঙ্গে তাদের পরিচয় অনেক পরে। অভিন্ন-আরম্ভের গাঢ় সম্পর্ক থাকলেও রিয়াজ ও ঐশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব আর গাঢ় হয়নি।

হ্যাঁ, ঐশীর সঙ্গে অভিন্নর ভালো চেনাজানা ছিল। আর অভিন্নর সত্তায় ঐশী যেন টান দিয়েছিল খুব জোরে। কোনো কথা না বলে আকর্ষণের রশিটুকুই টান দিয়েছিল। বাম সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অভিন্ন ধরেই নিয়েছিল শিকল ছাড়া আর কিছু হারাবার ভয় নেই তার। যেকোনো ত্যাগই তুচ্ছ। আরম্ভের কাছে জীবনটা ও রকম ছিল না কখনোই। বহুবার আরম্ভ অভিন্নকে শুনিয়েছে, ‘অভিন্ন, তুই যে সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন দেখিস, সাম্যের স্পৃহা লালন করিস তা সমাজ ও রাজনীতির চলমান বাস্তবতায় অলীক স্বপ্ন মাত্র। তোরা যে আদর্শ সামনে রেখে এগোনোর চেষ্টা করছিস, তা বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে তোদের কপ্পনার চিত্র বাস্তবে প্রতিফলিত হয়ে কাঙ্ক্ষিত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আমার ভয়ও একই হয়, তোরা কজন এ আদর্শ-চেতনা ধারণ করতে পেরেছিস? আর যা-ই হোক স্ববিরোধিতা জিইয়ে রেখে বিপ্লব হয় না। তোদের নেতাদের সিংহভাগই ভোগবাদী ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত থেকে রাজপথ কাঁপাচ্ছেন। অস্ত্রের ঝনঝনে সত্যিই কাঁপছে, কিন্তু অস্ত্রই যদি মুক্তির পথ বাতলে দিতে পারত, তাহলে কি সাম্যের আকাঙ্ক্ষা বৈষম্যের চাপে হাঁসফাঁস করত?

আরম্ভর সব কথাই অভিন্ন মনোযোগ দিয়ে শুনত কিন্তু কোনো উত্তর দিত না। যতবার রাজনীতি নিয়ে অভিন্ন আরম্ভের ব্যাখ্যা শুনত, তা উড়িয়ে দিতে পারত না। অবশ্য এ ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না। দার্জিলিং থেকে দুজন কলকাতায় ফেরে। তারপর শান্তিনিকেতনে অনেক দিন থাকার পরিকল্পনা নেয়। বিমলেন্দু বিকাশ রায়চৌধুরীর সঙ্গে দুজনেরই পারিবারিক সম্পর্ক। বিমলেন্দুবাবু রাশভারী মানুষ। আদি নিবাস মুন্সীগঞ্জে। শান্তিনিকেতনে প্রশাসনিক বিভাগে চাকরি করেন। তাই সেখানে গেলে বিমলেন্দুবাবুর ওখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়।

Advertisement

এবারও দুজন গিয়ে উঠল বিমলেন্দুবাবুর ওখানে। আরম্ভ এ প্রথম শান্তিনিকেতনে এলো। বিমলেন্দু বাবুর আতিথেয়তায় তাকে মুগ্ধ হতেই হয়। ব্যক্তিত্ব রাশভারী হলেও আপ্যায়নে তিনি আন্তরিক। অভিন্ন আগে থেকেই ঐশীর সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিল। পরদিন দুজন মিলে উপাসনাগৃহ দেখতে যায়। আরম্ভ অপলক চেয়ে থাকে মন্দিরের দিকে। স্থানীয়দের কাছে এটি কাচের মন্দির নামেও পরিচিত। পাঠভবন, বিদ্যাভবন, শান্তিনিকেতন আশ্রম হয়ে ছাতিমতলা। অন্যরকম জায়গা ছাতিমতলা। ওখানে বসে চোখ বন্ধ করলে রবীন্দ্রনাথের যেন স্পর্শ মেলে। কলকাতা থেকে অনেক ট্রেনই বোলপুর হয়ে যায়। তবে এর মধ্যে ‘শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস’ অন্যতম। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চেপে যখন ওরা দুপুরের রোদ মেখে বোলপুর স্টেশনে নেমেছিল, তখন আরম্ভর মেনে হয়েছিল বোলপুরের দেহজুড়েই যেন রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব।

দুই দিন পর ঐশীর সঙ্গে দেখা শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের সামনে। কোনো কথা হয়নি। কিন্তু চোখের দেখাতেই যেন অনেক কথা হয়ে যায়। ঐশীর সঙ্গে তার আরও দুজন বন্ধু ছিল। কেউ বুঝতেই পারল না এ মুহূর্তে কত কিছু ঘটে গেছে। ঐশী বান্ধবীদের বলে, ‘তোরা পাঠভবনে গিয়ে তোদের কাজ কর। আমি ওদের সময় দেব। ওরা আমার দেশের বন্ধু। ও হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দিই।’ এ বলেই ঐশী ওর বন্ধু সাথি আর নির্মলাকে অভিন্ন ও আরম্ভের সামনে নিয়ে আসে। ঐশীর এমন সহজ আচরণ ওদের দুজনের কাছেই খুব অচেনা ঠেকে। ঐশীর সারল্যের প্রকাশ দেখে ওরা হতবাক।

অভিন্ন আর আরম্ভ তখনও নির্বাক। অভিন্ন মনে মনে ভাবছিল, এ ঐশী তো তার চেনা ঐশী নয়! এমন বহির্মুখী আচরণ তো ঐশীর নয়! সময় এভাবেই সব পাল্টে দেয়! যাকে উদ্দেশ করে তাদের শান্তিনিকেতনে আসা, যাকে অনুসন্ধান করে খুঁজে পাওয়ার কথা আচমকা তার সঙ্গে এভাবে দেখা তো বিস্ময়েরই।

ঐশী বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের বিদায় জানায়। ঐশীর পরনে গরদের লালডোরা শাড়িটা যেন সাপের মতো তাকে পেঁচিয়ে রেখেছিল। ওখানেই হাঁটু গেড়ে ঐশী বসে পড়ল এবং অভিন্ন আর আরম্ভকে বসতে বলল। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল।

ঐশী প্রশ্ন রাখেÑ‘হঠাৎ তোমরা দুই অন্তপ্রাণ বন্ধু একসঙ্গে শান্তিনিকেতনে? অভিন্ন মাঝেমধ্যে এখানে আসে জানি, কিন্তু কোনো দিন দেখা মেলেনি। আরম্ভ তুমি কি আর কখনও এখানে এসেছো? এবার শান্তিনিকেতনে তোমাদের যুগল ভ্রমণে কি কোনো বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে?‘না ঐশী, এই প্রথম।…’ কথাটা আরম্ভ পুরো শেষ করতে পারেনি। তার আগেই অভিন্নর তীর্থদর্শন শব্দযুগল মৃদুস্বরে উচ্চারণ ঐশীর কানে পৌঁছে গেল।

ঐশী বলল, ‘অভিন্ন তুমি খুব অন্তর্মুখী জানি। আবার এও জানি, কখনও কখনও আবেগে তুমি খুব উন্মুখ হয়ে পড় নিজের অজান্তেই। আজও তারই ছায়া দেখলাম। আচ্ছা অভিন্ন, রিয়াজকে নিয়ে আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কি আজও সেভাবেই আছে? আমি জানি, তুমি আমাকে খুব পছন্দ করো। হয়তো জীবনের অংশও করতে চাও। কিন্তু রিয়াজ তোমার সে ভাবনায় একটা দেয়াল উঠিয়ে দিত। রিয়াজ আমাকে বহুবার বলেছে, তুই অভিন্নকে তোর জীবনের অংশ করে নে। আমি অনুভূতির সব তন্ত্রীতেও খুব করেই টের পেয়েছিলাম তোমার অন্তর্ভেদী পদচারণ। কিন্তু সাড়া দিইনি। কারণ তোমার ভেতরে সন্দেহের যে পোকাটা জিইয়ে আছে, তা যদি আমি মারতে চাই তাহলে এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ হবে না। তার চেয়ে তুমি এটাকে নিজেই নিঃশেষ করতে পারলে সেটাই হবে ভালো।’

অভিন্ন আর আরম্ভ কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। তাদের কাছে চেনা ঐশী যেন আরও অচেনা হয়ে উঠছিল। দুজনের মৌনতা ভাঙতে ঐশী আবারও অন্তর্মায়া দেখাল। তাতে স্পষ্ট হলো, ঐশীর মাঝে কোনো ভণিতা নেই।

ঐশী ফের শুরু করল, ‘লেখকদের মধ্যে একটা নির্মল সত্তা থাকে। এ সত্তা একজন লেখককে অনেক বেশি উৎকর্ষ করে এবং অভিন্ন সে রকমই একজন এটা আমার ধারণা। তবে এও মনে করি, লেখকদের একজন ছায়াসঙ্গী খুব দরকার।’

ঐশী শিক্ষাজীবন শেষ করতে না করতেই রিয়াজের চাকরি হয়ে যায় এবং সে সূত্রেই তার যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়া। একপর্যায়ে তার আগেই রিয়াজের পারিবারিক পছন্দে সেতুর সঙ্গে বিয়ে। সেতু একদিন ঐশীকে বলেছিল, ‘আমার ধারণা ছিল ছেলে আর মেয়ের মাঝে বন্ধুত্বের নামে যা হয় সেটা আসলে মেকি। বন্ধুত্বের আড়ালে প্রেমই অদৃশ্যভাবে জীবনে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু আমার ধারণা কত বড় ভুল তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃতই তোমরা দুজনই বড় মাপের মানুষ। তোমরা দুজনই আমার কাছে আজীবন অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।’সেতুর কথাগুলো ঐশীর আজ খুব মনে পড়ছে। রিয়াজ ও সেতু আজ অনেক দূরে। কোথায় বোলপুর শান্তিনিকেতন আর কোথায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক! কিন্তু রিয়াজ, সেতু, ঐশী একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে জীবনে।

সেই কবে ছাত্রজীবনে প্রথম সাক্ষাতে ঐশীর মাঝে যে অভিন্ন ঝড় তুলেছিল, আজ আবার তা-ই মনে হলো। নীরবতা ভেঙে ঐশী বলল, ‘আরম্ভকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে আসা কিংবা অভিন্নর শান্তিনিকেতন দর্শন সবই যেন কৌতূহলের!’আরম্ভ বলল, ‘অভিন্নর সঙ্গী হওয়ার বিষয়টি যেভাবেই ব্যাখ্যা করো, এর মুখ্য কারণ তুমি।’ঐশী আরম্ভের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, ‘আমি!’হ্যাঁ, ‘তুমিই’। এটুকু বলে আরম্ভ থেমে যায়।

এবার অভিন্ন মুখ খোলে। ‘একদিন তোমার চোখে আমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি খুব করে তোমাকে চাই তা কোনো দিন সেভাবে প্রকাশ পায়নি। কিন্তু তুমি যে বুঝে গিয়েছিলে তা আমি টের পেয়েছিলাম। সত্যি বলতে আর দ্বিধা নেই, রিয়াজকে নিয়ে তোমার সম্পর্কে আমার যে ধারণা ছিল তা শুধু ভুল নয়, আমার অন্যায়ও। অন্যায় হলেও তা স্বীকার করি ধারণাটা ভাঙতে খুব সময় লাগেনি। তার পরও আমি সেভাবে তোমার কাছে নিজেকে প্রকাশ করিনি। আমি জানি রিয়াজ আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তোমার আমার মাঝে সম্পর্কের সেতু গড়তে সেভাবে এগিয়ে আসেনি কেন তা যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে আমাকে স্পষ্ট করেছিল। বলেছিল আমি জানি, তোমরা একে অন্যকে গভীরভাবেই চাও। তোমার দিক থেকে নানাভাবে তার কিছুটা প্রকাশ ঘটলেও ঐশীর দিক থেকে বিষয়টা ছিল একেবারে অপ্রকাশিত। কিন্তু আমি ঠিকই ঐশীর অন্তর্গত ভাবনার দর্শনটা পাঠ করেছিলাম। আমি চেয়েছি তোমরা পরস্পরের কাছে প্রকাশ হও এবং আমি এও জানি, একদিন তা হবেও। ঐশী জানো, রিয়াজের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, সম্মানবোধ যা-ই বলো তা সেদিনই অনেক বেড়ে গিয়েছিল।’

ঐশী মাথা নিচু করে বসে রইল। তার চিবুক বেয়ে চোখের জল টপ টপ করে ঘাসের ডগায় পড়ছিল। ঘাসের ডগায় চিবুক গড়িয়ে পড়া নোনাজল জমে নুইয়ে পড়ছিল। অভিন্ন হাত বাড়িয়ে ঐশীর চিবুক মুছতে যাচ্ছিল। ঐশী দুই হাত বাড়িয়ে অভিন্নকে থামিয়ে দিল। অভিন্নর হাতজোড়া ভালোবাসার অবিকল স্পর্শ দিতে ব্যাকুল হয়ে রইল।

ঐশী মৃদুস্বরে বলতে লাগল, ‘ভালোবাসার মায়ায় স্নিগ্ধ ছায়াকীর্ণ সড়কে আমরা দুজনে পা রেখেছিলাম অনুচ্চারিত এক আশ্চর্য ভাবনার হাত ধরে। হয়তো কেউই জানতাম না এ পথের শেষে কী অপেক্ষা করছে। তবে এটুকু জানতাম, বন্ধন ছিন্ন করাই যে বয়সের স্বভাব, সে বয়সে দাঁড়িয়েও আমরা খুব নীরবে বন্ধনের সেতু নির্মাণের ভাবনায় একে অন্যের অজান্তে নিমগ্ন। অভিন্ন, আমি এও জানতাম, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেকি ভালোবাসার এ সংসারে যা ক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে এর মধ্যেও আমাদের অনুচ্চারিত প্ৰত্যাশা জিইয়ে থাকবে।’

দুইঅভিন্ন ও আরম্ভ প্রায় দেড় মাস পর ফিরে এলো ঢাকায়। চাকরিটা অভিন্নর আর সইছিল না। তার মনে হচ্ছিল, যে কাজ কিংবা দায়িত্ব তাকে আর টানছে না, সেখানে আঁকড়ে থাকাই বা কেন? সব্যসাচী সাংবাদিক যার খ্যাতি রয়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়েও, সেই মাসুদ আলী খানের মাধ্যমেই তার সংবাদমাধ্যমে পথচলার শুরু। মাসুদ সাহেবের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে অনুশীলন আর নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে যে শিক্ষা দীর্ঘদিন তার কাছ থেকে অভিন্ন নিয়েছে, তাতে তার জীবন-অধ্যায় অনেকটাই সফল বলা যায়। তবু তার এ জগৎটা এখন আর ভালো লাগছে না। ঈর্ষা, কদর্যতা, অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় আজকের সংবাদমাধ্যম জগৎটা অভিন্নর পেশাগত জীবনের শুরুর প্রায় ৩০ বছর আগের মতো নয়। বিগত তিন দশকে অনেক বদলে গেছে সংবাদমাধ্যমের ভেতর-বাইর। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সংবাদমাধ্যমের অনেক বিকাশ ঘটেছে সত্য, কিন্তু কাজের পরিবেশের অবনতি ঘটেছে।

শিল্পমাধ্যমে অভিন্নর সংযুক্তি ঘটে শিক্ষাজীবনেই। মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেখান থেকেই লেখালেখির জগতে। গত তিন দশকে সব মিলিয়ে ছয়টি বইয়ের স্রষ্টা অভিন্ন। মূলত ছোটগল্প ও কবিতার প্রতি ঝোঁক তার। আর পেশাগত কারণে কলাম লিখতে হয়। পত্রিকায় কাজ শুরু করলেও এরই মাঝে কয়েকটি টিভি চ্যানেলেও কাজ করেছে অভিন্ন। খবরের পেছনের খবর সন্ধানও কম করেনি। রিপোর্টিং দিয়ে সংবাদমাধ্যমে অভিন্নর কাজ শুরু হলেও সেখানে বেশি দিন স্থিত হয়নি। চলে আসে পত্রিকার নীতিনির্ধারণী সম্পাদকীয় বিভাগে। আরম্ভর শিক্ষাজীবন শেষে শুরুটা ভালোই হয়েছিল। ব্যবসার প্রতি ঝোঁক ছিল আগে থেকেই। তার বাবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাডেমিক সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এসে শুরু করেছিলেন আড়তদারি ব্যবসা। আরম্ভর রাশভারী বাবা পারভেজ আলম খান চাইতেন উত্তরাধিকারসূত্রে ব্যবসার হাল ধরুক আরম্ভ। তার বড় ভই প্রারম্ভ শিক্ষাজীবন শেষে আগেই যুক্ত হয়েছিল ব্যবসায়। ব্যবসার প্রয়োজনে আরম্ভকে প্রায়ই চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া এবং দেশের বাইরেও যেতে হয়। পারভেজ সাহেব দুই ছেলের ওপর ক্রমান্বয়ে ব্যবসার ভার ছেড়ে দিচ্ছিলেন। আরম্ভ আর প্রারম্ভ দুই ভাই মিলে যখন ক্রমান্বয়ে ব্যবসা আরও জমিয়ে তুলেছিল তখন পারভেজ সাহেব আরম্ভর বিয়ের কথা ভাবলেন। প্রারম্ভ বিয়ে করবে না তা আগেই স্থির করেছিল। পারভেজ সাহেব ও প্রারম্ভর মা বিনীতা খান এ নিয়ে আর তাকে চাপও দেননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করা সেঁজুতি পারভেজ সাহেবের বন্ধু মহসীন চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। দুই বন্ধুর মাঝে একটা গোপন সমঝোতা ছিল আরম্ভ আর সেঁজুতির দ্বৈতজীবন নিয়ে, সেই তাদের কলেজ জীবন থেকেই। তাদের নীরব এ সমঝোতার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে যখন দুজনই স্থির করলেন, তখন আরম্ভর দিক থেকে খানিকটা অনীহার প্রকাশ। সেঁজুতি অপরূপা। আরম্ভকে তার বরাবরই খুব পছন্দ। কিন্তু আরম্ভ সেভাবে কখনও ভাবেনি। কলেজ জীবনে আরম্ভ জড়িয়ে পড়েছিল পরকীয়ায়। শেষ পর্যন্ত তা বেশি দূর গড়ায়নি বন্ধু অভিন্নর আরম্ভকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার প্রাণান্ত চেষ্টায়। আরম্ভ এজন্য অভিন্নর কাছে কৃতজ্ঞতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আরম্ভকে যখন অভিন্ন বোঝাতে সক্ষম হলো, অনুচিতের কাদাজলে একজন সচেতন মানুষের জীবন ডুবে যেতে পারে না, তখনই তার দিশা ফিরল। রূপ মানুষের মনের সৌন্দর্যের প্রকাশ করে না, দেহের বহিরাবরণ মাত্র, অর্থাৎ অঙ্গশোভা। এ সত্যটাও আরম্ভর অভিন্নর কাছ থেকেই জানা। আরম্ভ আর সেঁজুতির যুগল জীবনযাত্রার আনুষ্ঠানিক পথরেখা যখন টানা হচ্ছিল, তখনই ঐশী ফিরল শান্তিনিকেতন থেকে তার আরাধ্য সাধন করে।

তিনশেষ পর্যন্ত অভিন্ন চাকরিটা ছেড়েই দিল। মনোযোগ বাড়াল লেখালেখিতে। সাহিত্যচর্চার পরিসর বিস্তৃত করার পাশাপাশি টেলিভিশনের টকশো। একধারে কয়েকটি পত্রিকায় কলাম লেখা চলল সমান্তরালে। পেশাগত জীবনের কিছুকাল যেতে না যেতেই অভিন্ন সংবাদমাধ্যমে একটা আলাদা পরিচিতি পায়। সবার সঙ্গে খুব সহজে মিশে যাওয়া, যেকোনো শুভবোধসম্পন্ন মানুষের হৃৎপিণ্ডজুড়ে স্থান করে নেওয়া, দিগন্তবিস্তৃত সম্পর্কে ইন্দ্রজাল তৈরি করা অভিন্নর নিজস্বতায় গড়া। এর সুফল তার জীবনে বহুমুখী হয়ে ওঠে। অভিন্নর আর্থিক অনটন নেই। তার প্রয়াত বাবার সঞ্চিত অর্থ ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ তার জন্য সহায়ক হলেও নিতান্ত তার প্রযোজন ছাড়া এসবের প্রতি তার বাড়তি কোনো মোহ ছিল না। ছোট ভাই প্রসন্নই সব দেখাশোনা করত। সময়ে সময়ে অভিন্ন প্রসন্নর কাছে সহযোগিতা চাইত এবং যা পেত তাতেই সে তুষ্ট। তবে ব্যক্তিজীবনে অনেক ভুলের মাশুল তাকে গুনতে হয়েছে। এসব নিয়ে অভিন্ন এখন আর ভাবে না বটে, তবে ওই সব ভুলের কারণে সৃষ্ট ক্ষতের অদৃশ্য দাগ তার যাপিত জীবনে কখনও কখনও প্রতিকূলতার স্রোত বয়েই দেয়। তার পরও তার জীবন সে উজানমুখীই রেখেছে।

ঐশীর বাবা প্রয়াত হন তার কলেজের গণ্ডি পেরোবার আগেই। ঐশীর বাবার মৃত্যুর পর তার মা সরোজিনী রায় ছেলে সামন্ত আর মেয়ে ঐশীকে নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। তার সামনে তখন দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকার। ঐশীর বয়স তখন মাত্র বারো। ঐশীর দাদা সামন্ত সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। সরোজিনী রায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে সেবিকা হিসেবে কাজ করতেন। ঐশীর বাবা স্ত্রী-সন্তানদের জন্য কিছুউ গুছিয়ে যেতে পারেননি। তা ছাড়া তিনি তেমন বৈষয়িকও ছিলেন না। সরোজিনী রায়ই সব সামলাতেন। জীবনের নতুন কঠিন অধ্যায়। দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয়টা তিনি মনে গভীরভাবে ধারণ করেই এগোচ্ছিলেন। সামন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার সুযোগ পায়।

বাংলায় ভর্তি হয়ে একদিকে নিজের অন্যদিকে ঐশীর পড়াশোনা চালিয়ে নিতে আরও কঠোর শ্রমে ব্রতী হলো। টিউশনির পাশাপাশি একটি প্রাইভেট ফার্মে খণ্ডকালীন কাজ নেয়। সামন্ত সাফল্যের সঙ্গে মাস্টার্সও সম্পন্ন করে। এর পরই তাদের জীবন আলোকিত হতে থাকে। সামন্তর সংকল্প ছিল শিক্ষকতাই সে তার ব্রত হিসেবে নেবে। বেশি দিন লাগেনি তার ইচ্ছা পূরণ হতে। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পায়। কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হয় ঐশীর এক বান্ধবীর বড় বোনের সঙ্গে। যোগসূত্রটা ঘটিয়ে দিয়েছিল ঐশীই। আর এজন্যই বউদি মনোরমার ঐশীর প্রতি এক বিশেষ টান জন্মে। ঐশীর দাদাও মনোরমার মতো জীবনসঙ্গী পেয়ে পারিবারিক জীবনটা অন্যরকমভাবে সাজানোর প্রয়াস পায়। তাদের দুজনের কাছেই ঐশী ক্রমেই স্থান করে নিতে থাকে অন্যরকমভাবে। বাবা- মায়ের শূন্যতা সামন্ত বোনকে বুঝতেই দেয়নি। পরে মনোরমা এ ক্ষেত্রে আরও বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক সামন্ত রায় ও বউদি শল্য চিকিৎসক মনোরমা রায়ের নিঃসন্তান জীবনে ঐশী তাদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ। ঐশীকে দাদা-বউদির কাছে কোনো কিছু চাইতে হয় না কখনও। তারা সবকিছু ঐশীকে উজাড় করে দেয়। এত ভালোবাসা-মহত্ত্বের ভার বইবার সাধ্যি যেন ঐশীর নেই। ঐশী তার সাধনা সাধন করে দেশে ফেরার পর ফের যুক্ত হয় ছায়ানটে। আগেও সে ছায়ানটের সতীর্থদের কাছে ছিল খুব প্রিয়জন।

ঐশীর দাদা একদিন তাকে ডেকে বলল, ‘তোর কোনো কিছুতে আমরা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দিইনি। এখনও তা-ই হবে। তুই যা করতে চাস তা-ই কর। আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে।’

পুরান ঢাকার নারিন্দার পৈতৃক তিন তলা দুই ইউনিটের বাড়িটার দোতলার একটি ইউনিটে সামন্তবাবুরা থাকে। বাকিগুলোয় নিজেদেরই পরিচিতজনেরা ভাড়াটে।

ঐশী তার দাদাকে বলল, আপাতত সে একটি গানের স্কুল করতে চায়। এজন্য বাড়ির যেকোনো একটি ইউনিট তার দরকার।

সামন্তবাবু সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিয়ে বললেন, ‘তুই প্রস্তুতি নে। ভাড়াটিয়াকে তো তার বিকল্প ব্যবস্থার জন্য কিছুদিন সময় দিতে হবে। আমার মনে হয়, আমাদের পাশের ইউনিটটিই তোর জন্য ভলো হবে।’

ঐশী সম্মতি দিল। দুই মাসের মধ্যেই ঐশী গানের স্কুল খুলে বসল এবং আরও তিনজনকে তার সহযোগী হিসেবে যুক্ত করল। দেখতে দেখতে ঐশীর গানের স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়ে গেল, যদিও তার লক্ষ্য ছিল ৫০ জনের বেশি নেবে না। তাতেই সে-সহ তার বাকি তিন সহকর্মীর ভালোই চলে যাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল থেকে প্রায়ই ঐশীর ডাক পড়ে। সব মিলিয়ে একটা নতুন জগতের সন্ধান পেল ঐশী।

ওদিকে অভিন্নরও ভালোই চলছে। আরম্ভ পৈতৃক ব্যবসায় অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ঐশীর সঙ্গে তার নৈকট্যে কোনো ভাটা পড়ল না। ওদিকে সেঁজুতিও একটা প্রাইভেট কলেজে যুক্ত হলো শিক্ষকতায়।

অভিন্নকে ঐশীর দাদা-বউদি চিনত বটে তবে খুব একটা জানত না। তবে অভিন্নর বন্ধু আরম্ভর কাছে অভিন্ন ও ঐশীর একে অন্যকে পছন্দের কথা শুনেছে। এ ব্যাপারে ঐশীর কাছে তারা কোনো দিন কিছু জানতে চায়নি। তাদের স্থির বিশ্বাস, তেমন কোনো কিছু করতে গেলে ঐশীই তাদের জানাবে। তা ছাড়া অভিন্নকে তারা খুব একটা না জানলেও যেটুকু চেনে, তাতে সায় না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। এ হলো সামন্তবাবু ও তার চিকিৎসক স্ত্রীর অন্তর্গত ভাবনা।

ঐশীর বাবা-মা গত হওয়ার পর তার দাদা-বউদি স্থির করেছিল তার চলার পথে তারা সবসময় অনুপ্রেরণাদায়ক হয়ে থাকবে। ঐশী তার মতো জীবন গড়ুক তা তারা উভয়েই চাইত। তাদের এ চাওয়ার প্রতি ঐশীরও গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। ঐশী কোনো দিন ভাবেনি তার বাবা-মা নেই। দাদা-বউদিকেই মনে হয় তার সে রকম। ঐশীর এও মনে হতো, সময়ই সবকিছু বড় নির্ধারক।

চারগানের স্কুল পরিচালনা আর টেলিভিশনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রোগ্রাম করতে গিয়ে ঐশী যে নতুন জগতের সন্ধান পেল তাতে তার মানসিক উৎকর্ষতা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু এর মধ্যেও যেন তার একটা ক্ষীণ শূন্যতাবোধ মনে খোঁচা দেয় সব সময়। তবে এ শূন্যতা ঘোচানো সাধ্যের বাইরে তা কখনও ঐশীর মনে হয়নি।

একদিন শ্রাবণসন্ধ্যায় অভিন্ন তার দোতলার বারান্দায় কার্নিশে মাথা ঠেস দিয়ে কী যেন ভাবছিল। হঠাৎ নিচের দিকে দৃষ্টি পড়ল। দেখল ঐশী একটা স্কুটার থেকে কাকভেজা অবস্থায় নামছে। সেই দুপুর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। অভিন্ন খানিকটা অবাক। কোনো কথা নেই, বার্তা নেই ঐশী হঠাৎ এভাবে! ঐশীর পেছন পেছন নামছিল আরম্ভও। অভিন্নর বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। সিঁড়ি ভেঙে অভিন্ন নিচে নেমে এসে গেট খুলে দিল। দুজনের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত প্রশ্নÑ‘তোমরা ...?’

ঐশী চুপ করে ওড়না দিয়ে ছাড়া চুল পেঁচিয়ে জল মুছে নিতে নিতে বলল, ‘এ কেমন ভদ্রতা। দুটা মানুষ এভাবে ভিজে এলাম আর তুমি পথ আগলে প্রশ্ন করছ! আগে অন্তত ঘরে যেতে দাও।’

অভিন্ন খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে থতমত খেয়ে বলল, ‘ও হ্যাঁ, তাই তো!’

সবাই দোতলার বারান্দায় গেল। অভিন্ন দুটা তোয়ালে নিয়ে এলো। ঐশী ও আরম্ভ নিজেদের শরীর, মাথায় তোয়ালে চেপে বৃষ্টির জল শুষে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

অভিন্ন কাজের ছেলেটাকে ডেকে বলল, ‘বেশি করে ম্যাট ও চিনি দিয়ে খুব গরম কফি নিয়ে আয়।’

অভিন্নর বারান্দাজুড়ে সারিবদ্ধ ফুলের টব। ঐশী চুপ করে ছিল। পাশের টবে সাদা গোলাপের তীক্ষ্ণ কাঁটায় আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল, ‘অভিন্ন অনেক বিলম্বে আমার মনে হচ্ছে, আমার জীবনে তুমিই প্রথম এবং তুমিই শেষ সত্যিকারের ডাক দিয়েছিলে। আমি বোকা, ভীষণ বোকা। হয়তো আমার ভুলের জন্যই এতটা সময় গড়িয়ে গেল।’

অভিন্নর গলা জড়িয়ে আসছিল। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আরম্ভ তখনও তোয়ালে দিয়ে বৃষ্টির জল সরাচ্ছিল চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে । হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। খুব বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। অভিন্নর কাজের ছেলে আলিম চার্জ লাইটা দিয়ে গেল বারান্দায়। মনে হলো, সন্ধ্যায়ই যেন অনেক রাত নেমে এসেছে। আরম্ভ এগিয়ে এলো। আরম্ভ ঐশী আর অভিন্নকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বিশ্বাসের চোখে অপলক তাকিয়ে রইল। তারপর শুধু ঐশীর দিকে আরম্ভ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফিসফিস করে বলল, ‘এ লোকটা শুধু মানুষ নয়, অতিমানব; তা কি তুমি জানো ঐশী?’

ঐশী অশ্রুরুদ্ধ স্বরে বলল, ‘মানুষ। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও নিবেদিত মানুষ। আমি জানি না মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ আছে কি না। যদি না থাকে তাহলে অভিন্নকে আমি আর কী শব্দ বা উপমায় আখ্যায়িত করব জানি না। আমি যখন ওকে প্রথম দেখি তখন ওর আপাদমস্তক নয়, শুধু অন্তর্জগৎটা দেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন বিদ্যুৎস্পর্শিত হলাম। তারপর খুব সতর্কভাবে অভিন্নকে এড়িয়ে গেছি তার ভেতরে যে ভুলের দানা বাসা বেঁধেছিল তা যেন অভিন্নই তার বুঝ-বিবেচনা-নিরীক্ষা দিয়ে সরিয়ে ফেলে। আমি ততক্ষণ অপেক্ষা করব। যদি তাতে জীবন গড়িয়ে যায় তবু আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। তোমরা দুজন যখন সেবার শান্তিনিকেতন গেলে আমি পাঠভবনের বেশ দূর থেকেই দেখছিলাম তোমরা দাঁড়িয়ে আছো। আমার ভেতরে তখন কী তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল! ওদিকে আসার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমি না এসে পারছিলাম না। বন্ধু দুটোকে জোর করে নিয়ে এসেছিলাম। ওরা তো জানত না কী অসম্ভব সীমারেখার দাগটা মুছে গেছে। ওরা তো বুঝতে পারার কথা নয় কী প্লাবন আমার ভেতরে।

অন্তর্গত ভাবনায় উথালপাথাল সৃষ্টি করেছিল। আমি ভেবেছিলাম এই তো সময়কে জন্মাতে দেখা। তোমরা এভাবে শান্তিনিকেতন যাবে কিংবা আমার সঙ্গে দেখা হবে, এটা তো কোনো দিন ভাবতেই পারিনি। জানো, তারপর আমি কত রাত বিনিদ্র কাটিয়েছি! তখন থেকেইÑমাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই নাÑরবিঠাকুরের এ গানটা আমার মনের অজান্তেই গীত হতো। অদ্ভুত ভালো লাগা আরও গভীরভাবে আমাকে নাড়া দিতে থাকল।’ স্যাঁতসেঁতে অন্তর্বাসের ভেতর থেকে ঐশী একটি পত্রিকার কিছু কাটা অংশ বের করল। আধো আলো আধো ছায়ায় কিছুটা ওই কাগজের দিকে তাকিয়ে কিছুটা না তাকিয়ে একটা শারদীয় সংখ্যায় অভিন্নর ছাপা হওয়া ‘তুই যে আমার কী’ কবিতার পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারণ করতে থাকল। কলেজ জীবন থেকেই ঐশী খুব ভালো আবৃত্তি করে। কিন্তু ওইদিন তাও ছাপিয়ে গেল ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। চোখ বন্ধ করে ঐশী দরাজ কণ্ঠে উচ্চারণ করতে থাকলÑ‘তুই আমার সকাল বেলার কাঁচা রোদ/তুই আমার দুপুর বেলার সূর্যপোড়া স্পর্শ/তুই আমার সন্ধ্যা বেলার রুপালি চাঁদ/তুই আমার মধ্যরাতের নীলাভ লন্ডভন্ড সময়/তুই আমার সরষে ইলিশের ঝোলমাখা ভাতের সৌরভ/তুই আমার পৌষসংক্রান্তির নগর কীর্তন/তুই আমার সিঁড়িঘাটের বিকেলের তুমুল আড্ডা/তুই আমার রূপসাগরের অপরূপ রতন।/তুই আমার পৌষের কুয়াশাভেজা কবিতা/তুই আমার চৈত্রের প্রচণ্ড ধুলোঝড়/তুই আমার অনাবিল সুখের আউলা যাবজ্জীবন/তুই আমার বিস্তীর্ণ সড়ক ধরে বিরামহীন হেঁটে চলা।/তুই আমার নকশিকাঁথার মতো বোনা চিঠি/তুই আমর শ্রাবণের অঝোর বৃষ্টি/বৃষ্টি নামলে বারান্দা দিয়ে হাত বাড়িয়ে/তোকে আমি ছুঁই, অফুরন্ত আনন্দে শুধুই ছুই।’

কবিতাটা শেষ করে ঐশী দুজনের সামনে মাথা নুইয়ে বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অভিন্ন দেখতে পায় ফের তার চিবুক গড়িয়ে নামছে জল । এগিয়ে এলো আরম্ভ। অভিন্ন-ঐশী দুজনই আরম্ভর কাছে বহুবার পড়া বইয়ের পাণ্ডুলিপি। আরম্ভর অস্থিমজ্জায় তাদের দুজনের উপস্থিতি। আরম্ভ এমন পরিস্থিতিতে দুজনকে লক্ষ করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার বক্তব্য থেকে গেল অনুচ্চারিতই। অভিন্ন মনের অজান্তেই ঐশীর আঙুল স্পর্শ করল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বারান্দার চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের দিকে। দুজনকেই প্রবল আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল আরম্ভর।

এইচআর/এএসএম