সাহিত্য

ডাবলু লস্কারের গল্প: পাতাললোক

‘কথা কইবি না। কাছে ফোন, মানিব্যাগ যেডি আছে তাড়াতাড়ি বাইর কর। নাহলি প্যাডের মইধ্যে ছুরিডি হান্দাই যাইবে।’ দুপাশ থেকে দুজন দুহাত শক্ত করে ধরে আছে। সামনে থেকে লম্বা মতো একজন পেটের ওপর চাকু রেখে ধমক দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভালোই লাগে মনোজের। অনেক দিন হলো কেউ এত শক্ত করে তার হাত ধরে না। বিয়ের সময় মনিকা অনেক শক্ত করে হাত ধরে রেখেছিল। মনিকার কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিল মনোজ, ‘ব্যথা লাগে এত জোরে ধরলে।’ ‘আরও জোরে ধরবো। সারাজীবন ছাড়বো না এই হাত।’ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল মনিকা।কিন্তু অভাবের কাছে হার মেনেছে বাস্তবতা। মনিকা অনেক আগেই ছেড়েছে মনোজের হাত। অথচ কত স্বপ্ন ছিল দুজনের। কুঁড়েঘর, মোটা কাপড়, মোটা ভাত এসব হলেই মনিকা সুখী হবে।

Advertisement

মনোজ বুয়েটে সিভিলে পড়তো। এলাকায় সবাই জানতো মনোজ বুলেট ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল ব্যাপার! মনোজের মা আর বাবা বিশাল একটা গর্ব অনুভব করতেন সব সময়। ছেলে বুলেট ইঞ্জিনিয়ার! অনেক স্বপ্ন ছিল মনোজকে নিয়ে। লাখ লাখ টাকা ইনকাম করবে। একতলা দালান বাড়িতে হয়তো একদিন প্রাসাদ হবে। কিন্তু সব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ। তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় টার্ম পরীক্ষা আর পাস করা হয় না মনোজের।

অনেক চেষ্টা করে। এর মধ্যে কয়েকবার পরীক্ষা দেওয়ার পর ডিসকোয়ালিফাই হয়ে ছাত্রত্ব বাতিল। এলাকার সব থেকে ভালো ছাত্র ছিল সে। অ্যাডমিশন কোচিংয়ে ভালো ক্লাস নিতো। কিন্তু সার্টিফিকেট নিয়ে বের হতে পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই অবস্থা খারাপ তার।

এর কয়েক বছর আগে থেকেই মনিকার সাথে পরিচয়। মনিকা বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী। মনিকার কাছে মনোজ ছিল স্বপ্নের মতো। মনিকা স্বপ্ন দেখতো, একদিন মনোজ অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাদের আর কোনো কষ্ট থাকবে না। কিন্তু মনোজ প্রচণ্ড হতাশায় পড়ে। দিন দিন সে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বাসা থেকে বিয়ে দিয়ে দেয় মনিকার সাথে।

Advertisement

এক সময় মনোজের বাবা-মা জানতে পারেন, সে সার্টিফিকেট নিয়ে বের হতে পারেনি। মনিকাও বুঝতে পারে মনোজকে দিয়ে কিছু হবে না। সেই শুরু। শুরু হয় এক নতুন অভিজ্ঞতা। যেখানে শুধু ছিল হতাশা আর না পাওয়ার যন্ত্রণা।

গত তিন বছর যাবত সে সূত্রাপুরের রজনীকান্ত লেনের পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনের চিলেকোঠার একটা রুমে ভাড়া আছে। বাবা-মা গত হয়েছেন দুবছর আগে। মনিকা তাকে ছেড়ে গেছে একবছর আগে। আপন বলতে পাশে দাঁড়ানোর মতো আর কেউ নেই। ছাত্রাবস্থা থেকেই ক্লাস নিতো বিভিন্ন কোচিংয়ে। এখন নাকি তার ক্লাসে আনন্দ পায় না স্টুডেন্টরা। তাই অধিকাংশ কোচিং তাকে আর ডাকে না।

কয়েক বছর আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন সেক্টরে সাইট সুপারভাইজার হিসেবে কাজ নিয়েছিল।বেতন তেমন নেই বললেই চলে। কারণ চাকরিটা তার ইন্টারমিডিয়েট পাসের সার্টিফিকেটে হয়েছিল। বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা যখন তাকে ঝাড়ি মারতো, তখন বুক ফেটে যায়। মনে হয় আবার যদি সুযোগ থাকতো বুয়েটে গিয়ে যেভাবেই হোক রাত-দিন পড়ে বিএসসিটা পাস করে ব্যাটাদের ঝাড়ির জবাব দিতো। কিন্তু কপাল যে খারাপ হতে শুরু করেছে। কিছুই আর করার নেই।

সূত্রাপুরের রজনীকান্ত লেনের চিলেকোঠার এক চিলতে মুরগির খোপের মত ঘরটায় ওঠার পর প্রথম কয়েক দিন মনিকা কিছু বলেনি। কিন্তু ওর তো স্বপ্ন ছিল গুলশান-বনানী না হোক, কমপক্ষে মালিবাগের মতো জায়গায় থাকবে। বারান্দায় বাগান করবে। টিভি, ফ্রিজ, ওভেন হবে। বিকেলে এলোচুলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খাবে। বুয়েটপড়ুয়া ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ারের বউয়ের এমন স্বপ্ন থাকতেই পারে! কিন্তু মনোজের ক্ষেত্রে যে এমন হবে তা কি মনিকা জানতো? নাকি আবেগে?

Advertisement

চিলেকোঠার এই ঘরে পড়ে মরার মতো মেয়ে মনিকা না। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে বিবাহবিচ্ছেদের। নিজের মতো বাঁচতে চায় সে। পাল্টে যায় মনিকার আচরণ। আসলে অভাবের সঙ্গী কেউ হতে চায় না। চলে যায় মনিকা। মনিকাকে হারিয়ে অনেক ভেঙে পড়ে মনোজ। বাবা-মাকে হারানোর পর পাশে থাকার মতো শুধুই মনিকাই ছিল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে অনেক হাতেপায়ে ধরেছে মনিকার। কিন্তু গলেনি মন একবিন্দু। মনোজ আশা করেছিল সম্পর্কের বিয়ে তাদের। হয়তো একদিন মনিকা ফিরে আসবে। কিন্তু হতাশার আর নিরাশার শেষ পেরেক বিঁধেছে সেদিন। মনিকা আবার বিয়ে করেছে অন্য ছেলেকে।

রজনীকান্ত লেনের এই চিলেকোঠার বাসাটাকে পাতালপুরী মনে হয় মনোজের। চারপাশে এত মানুষ অথচ তার সাথে কথা বলার জন্য একজনও নেই। এলোমেলো ঘরটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরাতন জামাকাপড়। ভাতের হাঁড়িতে পান্তাভাত পচে কেমন যেন একটা মাদকীয় গন্ধ ছড়াচ্ছে। কিছুদিন আগে একটা ইঁদুর আসতো খাবারের খোঁজে। ইদানীং তাকেও আর পাওয়া যায় না। ইঁদুরটা বুঝতে পেরেছে, এখানে যে বসবাস করে; সে হয়তো জীবিত নয়।

অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে মনোজকে। কাজে মনোযোগী নয়। আসলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের চক্রান্ত। সাদাসিধা মানুষ সে। ইট-পাথর আর সিমেন্টের মারপ্যাঁচ সে বুঝতে চাইতো না। তাই তো সে থাকলে বিল্ডিংয়ের গাঁথুনিতে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে হয়তো তাকে সরানো হয়।

ঘর ছাড়তে বলা হয়েছে মনোজকে। কোথায় যাবে সে? রাতে কারেন্ট আসে না। অন্ধকারে আর কান্না করে না মনোজ। রাতে ঘুম নেই। ঘুমালেই স্বপ্ন দেখে বুয়েটের সিভিল ভবনে পরীক্ষা দিচ্ছে। অনেক ভালো ছাত্র। অনেক স্বপ্ন তার। বড় বড় ভবন বানাবে। কিন্তু নিজেই দাঁড়াতে পারেনি ঠিক করে। ভবন দাঁড়াবে কী করে। বুয়েটে পড়ার সময় বুকটা ছাতার মতো ফুলে থাকতো গর্বে। কিন্তু এখন বুকের মাঝখানে একটা বিশাল হতাশার গর্ত। মনে হয় সেই গর্তে একদিন সে বিলীন হয়ে যাবে।

মনোজ এখন আর কিছু আশা করে না। রংচটা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাবে, মৃত্যু হলে হয়তো মুক্তি হবে তার। সে মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে তিন ধরনের লোকের বসবাস। যারা অনেক সুখী, সব কিছু আছে; তারা স্বর্গলোকের বাসিন্দা। যাদের কিছুটা অভাব আছে, তারা মর্তলোকের বাসিন্দা আর তার মতো যাদের কেউ নেই কিছু নেই, তারা পাতাললোকের বাসিন্দা। এই পাতাললোকের বাসিন্দাদের দৈহিক মৃত্যু হয় না কিন্তু মানসিকভাবে তারা অনেক আগেই মারা যায়।

সেদিন সন্ধ্যায় ক্ষুধার কষ্টে আর থাকতে পারে না মনোজ। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। বেরিয়ে পড়ে কোনো দোকান থেকে একটা কিছু বাকি করে খাওয়ার জন্য। অনেকক্ষণ ধরে ঘোরাঘুরি করে কিন্তু লজ্জায় আত্মসম্মানবোধে বাকি চাইতে পারে না কোনো দোকানে।

অবশেষে রাতের দিকে বাসায় ফেরার পথে অন্ধকার ঘুপচির এই গলির মধ্যে তিনজন ছিনতাইকারী পথ অবরোধ করে দাঁড়ায় সামনে। ‘দেন ভাই চাকুটা ভিতরে ঢুকায়া দেন। এই পেটে অনেক ক্ষিধা। কিছু একটা পেটে গেলেই ক্ষিধা মিটবে।’বলেই সামনের চাকু ধরে রাখা ছিনতাইকারীর হাত থেকে চাকুটা নিজের পেটের দিকে চাপ দিতে যায়। ‘ধ্যাৎ শালা পাগল।’ বলে ছিনতাইকারী দ্রুত চাকু সরিয়ে নেয় মনোজের পেটের সামনে থেকে। ‘ছাড় শালারে।’ বলে তিনজন মনোজকে ছেড়ে দিয়ে গলির দিকে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

এসইউ/এএসএম