সাহিত্য

অনুবাদের ভূমিকা: ভালো অনুবাদ এবং খণ্ডিত অনুবাদ

বাংলা সাহিত্য বিদেশি প্রভাবকে গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের অনেক কবি পাশ্চাত্য, রাশান প্রভৃতি ভাষার সাহিত্য থেকে গ্রহণ করেছেন। একটি রূপান্তরিত কাঠামো সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ‘Forms have to be broken and remade (The Music of Poetry)’-T.S. Eliot—এর ভাবনার সঙ্গে যথেষ্ট মিলে গেছে। Les Fleurs du Mal (১৮৫৭) বোদলেয়ার রচিত একটি গদ্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থেই আধুনিক কবিতার মৌলিক লক্ষণগুলো তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়। তাই এ গ্রন্থকেই আধুনিক কবিতার প্রথম উৎস ও উদাহরণ হিসেবে অনেকেই উপস্থাপন করেন।

Advertisement

বাংলাদেশের কবিরা রাশিয়ান বাস্তববাদ, ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ, মার্কসবাদী তত্ত্ব, ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ এবং আরও অনেক কিছু গ্রহণ করে রূপান্তরিত করেছেন নিজস্ব ভাষা ও পরিবেশে। রূপান্তরিত হয়ে নতুন মাত্রা পাওয়া এ কবিতা বেশ শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে এবং পাঠকের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়েছে বলে মনে করি। কিন্তু যথাযথ অনুবাদের অভাবে বিশ্বপাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না এ অমূল্য রতন। বিলম্বে হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বিশ্বপাঠকের কাছে কিছুটা মনোযোগ পেয়েছেন বা সমীহ আদায় করতে পেরেছেন। এর প্রধান কারণ ভালো অনুবাদকের ভালো অনুবাদ এবং নন্দিত প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হওয়া।

বাংলাদেশের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (উপন্যাস), হাসান আজিজুল হক (গল্প), শামসুর রাহমান (কবিতা), আল মাহমুদ (কবিতা) প্রমুখ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হওয়ার যোগ্য; কিন্তু হচ্ছেন না। তাদের সাহিত্যকর্ম ল্যাটিন আমেরিকার অনেকের চেয়ে উন্নত বলে মনে করি; অনেক পরিচিত বা পঠিত প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অনেকের চেয়ে বেটার। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, হোর্হে লুইস বোর্হেস, অক্টাভিও পাজ প্রমুখের মতো আলোচক ও অনুবাদক বিশ্বপাঠকের কাছে আমাদের সাহিত্যের কিছু অংশ অনুবাদের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। এমন ভালো মানের ও পরিচিত সাহিত্যিক যদি আমাদের সাহিত্য বিভিন্ন ভাষায় রূপান্তর করেন, তাহলে তা সমাধানের প্রধান উপায় হতে পারে। বিকল্প উপায় হচ্ছে ভারতীয় ইংরেজি বাদে আমেরিকান বা ব্রিটিশ ইংরেজিতে ও তাদের আবহে ভালো অনুবাদ করতে পারেন দেশীয় অনুবাদকরা। কিন্তু এ শাখায় আমরা অনেক পিছিয়ে।

এটি করতে পারলে হাসান আজিজুল হক বা আল মাহমুদ অথবা আখতারুজ্জামানের সাহিত্য আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার অনেক পরিচিত সাহিত্যিকের চেয়ে উজ্জ্বলতর হবে। রবীন্দ্রনাথ ভালো অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন। এ কাজ (নিজের সাহিত্যের অনুবাদ) প্রথমে তাকেই করতে হয়েছে। এ দুর্ভাগ্য এখনো বিরাজমান। উইলিয়াম র্যাডিস, কেতকী কুশারী ডাইসন কর্তৃক দুর্বল অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের মূল রচনায় যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জেতার পরে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ম্যাকমিলান কবিতা এবং গদ্য কথাসাহিত্যের অনেক অনুবাদ ভালো বলে পাঠক মনে করে না। দুর্বল রূপান্তর বা মানহীন বা খণ্ডিত অনুবাদের ফলে ঠাকুরের সাহিত্য সাধারণ লেখা হিসেবেই উপস্থাপিত হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর কথাসাহিত্য: আত্মজীবনী থেকে নয়াচীন

উইলিয়াম র্যাডিস এবং ক্লিনটন বি সিলি উভয়েই মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য, সিলি জীবনানন্দ দাশকে এবং ডাইসন বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বপাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্পের একটি সংকলন অনুবাদ করেছেন। এগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল ভালো অনুবাদের জন্য এবং একই সঙ্গে বিখ্যাত হাউজ দ্বারা প্রকাশিত হওয়ার কারণে।

অনুবাদের কাজ বা প্রচেষ্টা বাংলাদেশে খুব কমই হচ্ছে। কায়সার হক শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ ও শহীদ কাদরীর সাহিত্য অনুবাদ, জীবনানন্দ দাশকে ফকরুল আলম, জাকারিয়া সিরাজী আল মাহমুদের উপস্থাপন ভালো কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। তারপরেও আমরা বলতে পারি যে, খণ্ডিত অনুবাদের পরেও ঠাকুর ব্যতীত অন্যান্য অর্জনগুলো উল্লেখযোগ্য নয়। আমাদের দক্ষ অনুবাদকদের জড়িত করার দুটি উপায় রয়েছে। একটি বেসরকারি এবং অন্যটি সরকারি। ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সরকারকেই এ কাজে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

পঞ্চপাণ্ডব বা কিছু কবির বিদেশি ভাষা দখল থাকার সুবাদে বিদেশি ভাষা থেকে অনূদিত কিছু কবিতা পেয়েছি। রূপান্তরিত করে বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করা গেছে। ঠিক উল্টোটাই ঘটেছে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে। আবার বাংলাদেশের কবিতা এ ক্ষেত্রে একেবারেই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক কবিতা কিন্তু ল্যাটিন ভাষা বা আফ্রিকার অনেক কবিতা থেকে ভালো মানের। কিছু কিছু কবিতা তো বিখ্যাত কবিদের প্রায় সমকক্ষ। কিন্তু ভালো অনুবাদের অভাবে বিশ্বপাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। অনুবাদই অতি নগণ্য; ভালো অনুবাদ তো সুদূরপরাহত!

Advertisement

ইউরোপের ব্ল্যাংকভার্স অবলম্বনে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষা ও কবিতায় প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রয়োগ করেন। ভাষারীতির এ পরিবর্তনে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। এরপর রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক রূপান্তর বা পরিবর্তনে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার প্রকাশ্য সুবাস মেলে। কিন্তু মূলত আধুনিক কবিতার পরিপূর্ণ প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে তিরিশের দশকে—কল্লোল যুগে। পঞ্চপাণ্ডব—বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ এবং তিরিশের বেশ কিছু কবির মানসে প্রকৃত আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। এদের বেশিরভাগই ইউরোপীয় ভাষায় দখল বা দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ফলে রূপান্তরিত পদ্ধতিতে ইউরোপীয় কবিতার শক্তি প্রবেশ করান বাংলা কবিতায়। মূলত রবীন্দ্রধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু করার জন্যই এ প্রচেষ্টা। নজরুল ও মোহিতলাল রবীন্দ্রনাথ থেকে বেরিয়ে এসে নতুনত্ব আনলেন। কিন্তু যুগ সৃষ্টি করার সুযোগ পেয়েও পারেননি। তার প্রধান কারণ তিরিশের কবিদের আবির্ভাব ও বাংলা কবিতায় তাদের সম্মিলিত প্রভাব।

আরও পড়ুন: মুঠোফোনের কাব্য: কবিতার ভিন্ন আঙ্গিক

আত্মাই আধুনিক কবিতার শিল্পসার বলে মনে করা হয়। আধুনিক কবিতার এই আত্মস্বরূপ অনুসন্ধান প্রয়োজন। একটু দেরিতে হলেও আধুনিক বাংলা কবিতা ও কাব্য সাহিত্য ইউরোপীয় আধুনিকতত্ত্ব সহজেই গ্রহণ করা হয়েছে। এজরা পাউন্ড, এলিয়ট, পো, বোদলেয়ার, র্যাঁবো প্রমুখ ইউরোপীয় কবিদের আদর্শ গ্রহণ করে বাংলা কবিতার গঠন বা পুনর্গঠন করেছেন এবং আধুনিক রূপ দিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকেই (আমরা তিরিশের দশক বলে থাকি) মূলত আধুনিক কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছে। পঞ্চপাণ্ডব ও তিরিশের বেশ কিছু কবি এ যাত্রার শুরু করে গতিশীল করেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এখন তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবে। রূপান্তরিত করে পাঠকের রুচিকে আকৃষ্ট করতে হবে। যারা পারবেন না, তারা ব্যর্থতার তালিকায় থাকবেন। ব্যর্থদের গল্প কেউ শুনতে চায় না। কোনো কবিই একা-একা বেড়ে ওঠেন না বা বেড়ে উঠতে পারেন না! সব কবিকেই পূর্ব কবি বা অগ্রজদের কাছে যেতেই হয়। এরপর রূপান্তরিত করে নিজের ভাষা নির্মাণ করতে হয়। সব বড় কবিরা তাই করেছেন। ফলে অগ্রজ কবি বা বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিক কবিদের কবিতার প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক নয়। বরং কবিতাকে পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে নিজস্ব একটি ভাষা বা স্বর তৈরি করাই ভালো কবির প্রধান চাওয়া হতে হবে।

তিরিশের অনেক কবি বা পঞ্চপাণ্ডবের ইংরেজি ভাষায় দখল ছিল। মূলত তারাই বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় বা বিদেশি কবিতার ওজস্ব নিয়ে এনেছেন। বাংলা কবিতার ধমনীতে ইংরেজি ভাষার প্রবেশ করিয়েছেন। তখন থেকেই আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রাণসঞ্চার লাভ করেছে। বোদলেয়ারের অনেক প্রভাব রয়েছে। মালার্মে, র্যাঁবো, পাউন্ড, ফ্রস্ট প্রমুখের সৌন্দর্য, গতি, ঐক্য ইত্যাদির রূপান্তরিত রূপ বাংলা কবিতায় বিছিয়েছেন। বায়ুপরাগায়নের মতো বায়ুতে বায়ুতে প্রজন্ম রক্ষা করেছে, কিছু বিষয়ে বীজ রোপিত হয়েছে এ সময়ে। আমাদের কবিতার রক্তে শার্ল বোদলেয়ার, এজরা পাউন্ড, পাবলো নেরুদা, রবার্ট ফ্রস্ট, হুইটম্যান, কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, লংফেলো, ইয়েটস, এলান পো প্রমুখের উজ্জ্বলতা ধরা দিচ্ছে। রূপান্তরিত করে নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করাই ভালো কবির গুণ। এ ক্ষেত্রে খুব কম কবিই সফল হচ্ছে বলে মনে করি। পূর্বতনদের এড়িয়ে একটি আলাদা কবিতার ভাষা নির্মাণ বাংলাদেশের খুব কম কবিই পারছেন।

এসইউ/এএসএম