ফিচার

শেখ কামালের অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়ন হোক

মোতাহার হোসেন

Advertisement

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বড় ছেলে শেখ কামাল রাজনৈকি, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। এই নক্ষত্রের জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৭৫ বছর। সে হিসেবে তাঁর ৭৫তম জন্মদিন আজ। পিতা-মাতাসহ পরিবারের অপরাপর সদস্যের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনিও শহীদ হন। এ নক্ষত্রের শূন্যতায় তরুণ যুব সমাজসহ সমগ্র জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে শেখ কামাল দ্বিতীয় ছিলেন। তিনি শাহীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন সংগঠক, ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সংস্কৃতিবান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যমত সংগঠক, ত্যাগী, সাহসী সেনানায়ক।

ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক হিসেবে ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামাল সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ’৬৯-এর অগ্নিঝরা গণআন্দোলনের সময় শেখ কামালের প্রতিদিনের উপস্থিতি ছিল সবার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। এ আন্দোলনে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করে মিছিলসহ বটতলায় সমবেত হতেন শেখ কামাল। ’৬৯-এ পাকিস্তান সামরিক জান্তা সরকার ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করে। শেখ কামাল তখন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের সংগঠিত করেন এবং রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি খ্যাতিমান শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দিয়ে বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানে পরিবেশনের উদ্যোগ নেন। সংস্কৃতিবান শেখ কামালের প্রতিবাদের ভাষা ছিল রবীন্দ্রসংগীত। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করে হাতিয়ার তুলে নিয়ে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ সংগঠিত করেন। তাঁর আশাবাদ ছিল, দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নতি করবেন এবং দেশকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করবেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশ পুনর্গঠনে নিজের অসামান্য মেধা ও কর্মক্ষমতা নিয়ে জাতির পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। সেখান থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে শেখ কামালের অবদান চিরদিনই আমাদের জন্য অনুকরণীয়। তিনি ছায়ানট থেকে সেতার শিক্ষার তালিম নেন। পড়ালেখা, সংগীতচর্চা, থিয়েটার, অভিনয়, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা থেকে শুরু করে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন শেখ কামাল। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তার পদচারণায় ছিল মুখর। স্বাধীনতার পর ‘থিয়েটার’ চর্চা এবং আধুনিক সংগীত সংগঠন ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’ গঠন করেন। আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি দেশের ক্রীড়াজগতে স্মরণীয় বরণীয়। প্রকৃতপক্ষে শেখ কামাল ছিলেন ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনা সুকুমার চিন্তার মানুষ।

Advertisement

শাহীন স্কুলের ছাত্র থাকাকালে স্কুলের প্রতিটি খেলায় তিনি ছিলেন অপরিহার্য। এর মধ্যে ক্রিকেট ছিল তার প্রিয়। তৎকালের অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেন তিনি। ‘আজাদ বয়েজ ক্লাব’ তখন কামালদের মতো উঠতি প্রতিভাদের আশ্রয়স্থল। এখানেই শেখ কামাল প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন দীর্ঘদিন। ’৭৫-এর ১৪ জুলাই গণভবনে শেখ কামাল ও শেখ জামাল দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের অল্প কিছুদিন পর ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় বিশ্বাসঘাতক উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্যের হাতে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, নববিবাহিতা দুই বধূ, দুই ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে নির্মম মৃত্যুকে বরণ করতে হয় তাঁকে।

জাতির পিতা যৌবনের ১৩টি বসন্ত কাটিয়েছেন কারান্তরালে। তাঁর অনুপস্থিতিতে শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা কখনোই কোনো ক্ষেদোক্তি প্রকাশ করেননি। বরং পরিবারের সদস্যরা সেসব মেনে নিয়ে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অংশে পরিণত হয়েছেন। দেশ স্বাধীনের পর কুচক্রী মহল শেখ কামালের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বানোয়াট অপপ্রচার চালাবার চেষ্টা করেছিল। যা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

শেখ কামালের আচার-আচরণ কেমন ছিল, সে-সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবুল ফজল রচিত ‘শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি’ গ্রন্থের ৪৭-৪৮ পৃষ্ঠাজুড়ে আছে একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। লেখাটির শিরোনাম ‘শেখ কামাল: স্মৃতিচারণ’। তিনি লিখেছেন, ‘‘১৭ই মার্চ শেখ সাহেবের জন্মদিন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ প্রতি বছর এ দিনটি পালন করে থাকে। ১৯৭৪-এর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য ঢাকার ছাত্রলীগ আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি রাজি হলাম, তবে দিনে দিনে ফিরে আসতে চাই এ শর্তে। তারা সেভাবে বিমানের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল।

১৭ তারিখ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, ওরা আমাকে নিতে আসবে কিনা, এলেও আমি চিনতে পারবো কিনা। ওদের কারো সঙ্গে তো আমার দেখা নেই। ...একধারে দেখলাম একটা ছিপছিপে গোঁফওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ লম্বা বলে সহজে চোখে পড়ে। ছেলেটাকে আমি চিনতে পারলাম না। লাউঞ্জের প্রবেশপথে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলেঃ ‘আপনাকে নিতে এসেছি।’ বলেই আমার হাত থেকে ব্যাগটি আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের হাতে নিয়ে নিল। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলামঃ তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ? ‘জ্বী হ্যাঁ।’ নম্র কণ্ঠে জবাব দিলো ছেলেটি।

Advertisement

ওর পেছনে পেছনে হেঁটে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলো ও নিজে এবং শুরু করলো ড্রাইভ করতে। তার আগে ও জেনে নিয়েছে আমি কোথায় উঠবো। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হঠাৎ কৌতূহল হলো, জিজ্ঞাসা করলামঃ তুমি কি করো? বললেঃ ‘অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোশিয়োলজিতে।’ ঢাকা থেকে? ‘জ্বী হ্যাঁ।’ শেখ সাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা করলামঃ তোমার নাম। ‘শেখ কামাল।’ ও তুমি আমাদের শেখ সাহেবের ছেলে।” এই ছিলেন শেখ কামাল। জাতির পিতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে কোনো অহমিকাবোধ ছিল না। তিনি ছিলেন বিনয়ী, মার্জিত ও সংস্কৃতিবান। দাম্ভিকতা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। পরোপকারী, বন্ধুবৎসল ও মার্জিত শেখ কামালের বিনম্র আচরণে মুগ্ধ হতো সবাই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শিরোনামের এক নিবন্ধে স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি লেখেন, “১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেফতার হন। আমি তখন খুবই ছোট্ট আর আমার ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছে। আব্বা ওকে দেখারও সুযোগ পাননি। একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। সে সময় আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেন। একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল তখন অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বার বার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি আব্বা-আব্বা বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে।’’

ঘাতকের বুলেট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। ঘাতকেরা চেয়েছিল বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করতে। তারা জানতো জাতির পিতার সন্তানেরা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারক-বাহক। সেজন্য তারা শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল কাউকেই রেহাই দেয়নি। সেদিন জাতির পিতার দুই কন্যা বিদেশে থাকায় ঘাতকের বুলেট তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর ’৮১তে আওয়ামী লীগের দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার হাতে শহীদের রক্তে ভেজা দলীয় পতাকা তুলে দেয় দল। সেই পতাকা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে হাতে তুলে নিয়ে জাতির পিতার আদর্শ সমুন্নত রেখে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি আজ দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করার যে স্বপ্ন শেখ কামাল দেখতেন; সেই অসমাপ্ত কাজটিও তারই পৃষ্ঠপোষকতায় সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে চলেছেন।

পরিশেষে বলা যায়, ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত, সংগ্রামী ও আদর্শবাদী কর্মী হিসেবে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ কামাল। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে পুনরায় লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য এবং পরে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি বেঁচে ধাকলে আজ জাতি, দেশ অনেক কিছু পেতেন তার কাছ থেকে। তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই, আছে তাঁর দেখানো পথ, তাঁর আদর্শ, তাঁর কর্ম। সেসব বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই তাকে স্মরণ ও মর্যাদা দেওয়া হবে।

লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

এসইউ/এএসএম