ভ্রমণ

মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা ভ্রমণ

ভ্রমণপিপাসু মানুষ হিসেবে সমুদ্র সবারই বেশ পছন্দের। যদি এই সমুদ্রতীরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সম্প্রতি মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে ঘুরে এসেছি সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা। কুয়াকাটা সুন্দরবনের প্রান্ত ছুঁয়ে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে দক্ষিণে প্রসারিত একটি সমুদ্রসৈকত। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভাগ বরিশালের পটুয়াখালী জেলার সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষেই কুয়াকাটার অবস্থান।

Advertisement

ঘরে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমুদ্র বিলাসের বিভিন্ন ভিডিও দেখে আমি আর বন্ধু তাহুরুজ্জামান খান অনিক সিদ্ধান্ত নিই বেড়িয়ে পড়বো সমুদ্র দর্শনে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার বছরে দুই-তিনবার ভ্রমণ করা হলেও কুয়াকাটা যাওয়া হয়নি খুব একটা। ২০১৬ সালের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো কুয়াকাটা ভ্রমণ করেছিলাম বাইসাইকেল নিয়ে। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

২০১৬ সালের পর এবারই কুয়াকাটা যাওয়া হলো মোটরসাইকেলে। খুব ভোরে আমরা ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে যাই কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। নবনির্মিত ডেমরা-যাত্রাবাড়ী এক্সপ্রেসওয়ে অতিক্রম করে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পৌঁছানোর পরই শুরু হলো আলো-মেঘের খেলা। এরমধ্যেই আমাদের চোখে ধরা দিলো দারুণ এক রংধনু। এ সৌন্দর্য আসলে খুব বেশিক্ষণ উপভোগ করার সুযোগ ছিল না। কারণ পরক্ষণেই শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। রাস্তায় কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়ে ভিজতে ভিজতেই পদ্মা সেতুতে প্রবেশ করতে হয়। সেতুর ওপর থেকে প্রমত্তা পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের বিমোহিত করে।

আরও পড়ুন: এ সময় কুয়াকাটা ভ্রমণে ঘুরে দেখবেন যেসব স্পট

Advertisement

পদ্মা সেতু অতিক্রম করে ভাঙা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের দারুণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা এগিয়ে যাই। এরপর মাদারীপুর হাইওয়ের অবস্থা আসলে বেশ অনিরাপদ মনে হয়েছে। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে প্রচুর বাস ও অন্য যানবাহনের চাপ বেড়েছে ঠিকই কিন্তু সড়ক প্রসারিত হয়নি। তাই ঝুঁকি নিয়ে এক বাস অন্য বাসকে ওভারটেক করতে দেখা যায়। সাবধানতার সঙ্গে রাইড করতে করতে আমরা পৌঁছে যাই বরিশাল শহরে। বরিশাল শহর থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়কটি ছিল বেশ উপভোগ্য। নদীমাতৃক বাংলাদেশ এর নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে বরিশাল আসতেই হবে। কুয়াকাটা পর্যন্ত আমরা বেশ কয়েকটি নদী অতিক্রম করেছি। প্রতিটি নদীই ছিল বেশ দৃষ্টিনন্দন, যা আপনাকে বিমোহিত করতে বাধ্য।

কুয়াকাটা পৌঁছে আমরা প্রথমেই হোটেল খোঁজা শুরু করি। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কুয়াকাটায় ভালো মানের হোটেল খুবই কম। পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ হোটেল খুব কমই খুঁজে পেলাম। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর মোটামুটি মানের একটি হোটেল নিই পরবর্তী দুদিনের জন্য। হোটেলে উঠে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি সমুদ্রসৈকত উপভোগ করতে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের মেইন পয়েন্ট দেখে আমরা বেশ হতাশ হই। পুরো বিচটাই যেন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সেদিন সন্ধ্যাটা সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতেই কাটিয়ে দিই। রাতের খাবার খেতে গিয়ে পড়তে হলো আরেক বিপত্তিতে। প্রথমত ভালো মানের খাবার হোটেল নেই। যেসব হোটেল আছে; সেসবে অন্য পর্যটন স্থানের তুলনায় বেশ চড়া দাম ও মানহীন খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।

দ্বিতীয় সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাদের মোটরবাইক নিয়ে চলে যাই সমুদ্রসৈকত ঘুরে দেখতে। কুয়াকাটা মেইন পয়েন্ট থেকে কিছুটা দূরে যাওয়ার পরই আসলে কুয়াকাটার আসল সৌন্দর্য আমাদের নজর কেড়ে নেয়। সমুদ্র তীর ঘেঁষে মোটরবাইক চালিয়ে ছুটে চলছি, সমুদ্রের পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। সে এক দারুণ অনুভূতি। বেশ কিছুক্ষণ মোটরবাইক চালিয়ে আমরা চলে আসি লেবুর চর। এখানের সৌন্দর্য আমাদের এতটাই বিমোহিত করেছে যে, আমরা এখানে ঘণ্টাখানেক চুপচাপ বসে থেকে শুধু সমুদ্রের গর্জন শুনেছি। কিছুক্ষণ পর আমাদের ঘোর কাটে সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে আসা মেঘের গর্জনে। আকাশ ঘন কালো অন্ধকার সাথে বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ। পুরো তীরে আমি, অনিক আর স্থানীয় দুইজন গলদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহকারী।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের যে দ্বীপে মানুষের চেয়েও হরিণ বেশি

Advertisement

অবিশ্বাস্য ভয়ানক সুন্দর একটি মুহূর্ত ছিল। আমি খুব করে চাইছিলাম, সময় এখানে থমকে যাক। আমি অনন্তকাল ধরে উপভোগ করতে চাই এ সৌন্দর্য। মেঘের গর্জনের সাথে শুরু হয়ে বৃষ্টি এবং একইসাথে জোয়ারের পানিও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সমুদ্রের পানি আমাদের পায় ছুঁয়ে যায়। যদিও আমাদের পানিতে ভেজার কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তবুও চোখের সামনে এত সুন্দর পরিবেশ দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। লেবুর চরে সমুদ্রের পানিতে অর্ধের ডুবে থাকা গাছে ঝুলছিল দুটি হ্যামক। আমি আর অনিক নিজেদের গা এলিয়ে দিই সেই হ্যামকে। সমুদ্রের ঢেউ এসে দোল দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের। এরপর আর সময়ের হিসেব রাখিনি। জোয়ারের পানি কমে গেলে আমরা আবারও সমুদ্র তীর ঘেঁষে ফিরে আসি আমাদের হোটেলে। বিশ্রাম নিয়ে আবারও ফিরে যাই সমুদ্রসৈকতে। রাতের অর্ধেক সময়ই আমরা কাটিয়ে দিই সৈকতে বিছানো বসার জায়গায়।

পরদিন সকালে খুব ভোরেই রওয়ানা হয়ে সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটাকে বিদায় জানাই। কুয়াকাটা বেশ সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন কেন্দ্র। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন এ পর্যটন কেন্দ্রকে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে।

এসইউ/জেআইএম