সাহিত্য

সমরেশ মজুমদার: নক্ষত্রের প্রস্থান

অলোক আচার্য

Advertisement

‘এক ফোঁটা চোখের জল একশ ফোঁটা রক্তের চেয়ে দামী’—সাহিত্যিক না হলে এমন বাজারদরের যুগে চোখের জলের মূল্যায়ন আর কে করবে! সদ্যপ্রায়াত পশ্চিমবাংলার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহনে’ লেখা এমন আরও উক্তি রয়েছে, যা পাঠকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। আবার তিনিই বলেছেন, ‘নাটকের সংলাপ তো মিথ্যে কথা নয়। জীবনের কথা। হয়তো সেই জীবনটা তোমার নয়। কিন্তু কারও না কারও জীবনে ওইরকম ঘটনা ঘটেছে। তুমি সেই জীবনটাকে যদি ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে পারো তাহলে দেখবে আনন্দে মন ভরে যাবে।’ (কলিকাতায় নবকুমার)

তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় বইয়ের মাধ্যমে। অসংখ্য পাঠকের সঙ্গে তাঁর যেভাবে পরিচয়, সেভাবেই। তাঁর মৃত্যুর পর দু’লাইন লিখতে ইচ্ছে হলো স্বাভাবিকভাবেই। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে আমার বড়বেলায়। আমার গল্প, উপন্যাস পড়া শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনসহ সমসাময়িক সাহিত্যিকদের বই পড়তে পড়তে। তারপর একসময় এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে হাতে আসে ওপার বাংলার সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই। দু’জনের বই-ই মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তে আরম্ভ করি।

আরও পড়ুন: চাঁদপুরে পাঠানো রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি চিঠির সন্ধান

Advertisement

অস্বীকার করার উপায় নেই, একটু নতুন ধরনের লেখনীর ঢঙে আমি একজন পাঠক হিসেবে আনন্দ বোধ করলাম। কারণ আমি তখনো একজন পাঠকমাত্র। আজও তা-ই আছি। তবে লেখালিখিটা একটু-আধটু করি। তবে এই পাঠকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত সব উপন্যাসের। গল্পের কাহিনি বিন্যাস, শব্দ প্রয়োগ—সবকিছুতেই সমরেশ মজুমদারের লেখায় এক অন্যরকম অনুভূতি পেলাম। একে একে পড়লাম ‘কালবেলা’, ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’সহ কয়েকটি বিখ্যাত সৃষ্টি। এসবের মধ্যে আট কুঠুরি নয় দরজার স্বাদটা একটু অন্য রকম। তখন অল্প বয়স, পত্রপত্রিকায় পাশ্চাত্য ধাঁচের লেখা কিছুটা পড়ি। দেশের বাজারেও দু’একটি পত্রিকা আছে পশ্চিমা থ্রিলার ধাঁচের লেখা আসে। তাছাড়া বিখ্যাত গোয়েন্দা সিরিজ শার্লক হোমস পড়ে শেষ করেছি। ফেলুদা পড়েছি। সেসব তখন খুব টানতো। মনে রোমাঞ্চ, রক্তে আন্দোলন। সে সময়েই হাতে পাই আট কুঠুরি নয় দরজা।

এমন কাহিনি আমি আগে পড়িনি এটা নিশ্চিত। একটি পলিটিক্যাল গল্প। একটি বিপ্লব এবং একজন বিপ্লবীর গল্প। যার শেষটা একটু অন্যরকম। গল্পে বিপ্লবের কেন্দ্রীয় মানুষটি মারা গেলো আবার রহস্যজনকভাবে ফিরেও এলো। এমন একটা অবস্থা হলো—উপন্যাস বলতেই তখন আমি বুঝি সমরেশ মজুমদার আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। তিনি ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ ও ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’র মতো অসংখ্য কাহিনির জন্ম দিয়েছেন। তার হাত দিয়ে বেশ কিছু সফল সিরিয়ালও এসেছে। তবে তাকে আরবান লেখকও কেউ কেউ বলেন। এটি সম্পূর্ণ সঠিক আবার সঠিক নয়। কারণ তার লেখা শহরকেন্দ্রীক একটু বেশিই ছিল।

আরও পড়ুন: জাঁ বোদ্রিয়াড ও হাইপার-রিয়েলের কথকতা

সমরেশ মজুমদার ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের গয়েরকাটায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম কৃষ্ণদাস মজুমদার এবং মায়ের নাম শ্যামলী দেবী। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ভবানী মাস্টারের পাঠশালায়। তিনি উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন কলকাতা থেকে। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লেখালেখির শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। সেবছর দেশ পত্রিকায় তার লেখা ‘অন্যমাত্রা’ ছাপা হয়েছিল। তারপর প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ প্রকাশ হয় ১৯৭৫ সালে। ধীরে ধীরে লেখক হিসেবে পাঠকের মনে জায়গা করে নেন। তার লেখার ভিন্ন ধরন, চরিত্র, কাহিনির বহুমাত্রিকতা পাঠকমহলকে আলোড়িত করে। তার ত্রয়ী উপন্যাস হলো ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’। বাংলা সাহিত্যে এ তিনটি উপন্যাসের আলাদা মূল্যায়ন আছে। সেই মূল্যায়েন তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

Advertisement

যদিও তার বেশিরভাগ লেখাই পাঠককে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। একটি দৈনিকে প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘লেখক হওয়ার কোনো পরিকল্পনাই আমার ছিল না। আসলে পরিকল্পনা করে তো অনেকেই লেখালেখিটা শুরু করেননি।’ এরকম আরও উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু যখন লেখাটা মনে ধরেছে; তখন শুধু লেখা বেরিয়েছে। আবার পরিবার বা জাতগত লেখকও আছেন। সাহিত্যিক জীবনে তিনি লিখেছেন কথাসাহিত্যের সব শাখায়—গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, গোয়েন্দা কাহিনি, কিশোর উপন্যাস। তার লেখায় চা বাগানের মসেদিয়া সমাজ, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনধারা, তাদের সুখ, দুঃখ, প্রেম—এসব জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/এমএস