কৃষি ও প্রকৃতি

নওগাঁয় মাশরুম চাষে সফল সাগর

সবজি ব্যবসায়ী যুবক সাগর আলী। প্রায় ১২ বছর ধরে নওগাঁ শহরের উপজেলা পরিষদের সামনের বাজারে ছোট্ট দোকান দিয়ে সবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এক বছর ধরে তিনি মাশরুম চাষ করছেন। প্রথমবার মাশরুম চাষে প্রায় ৭০ হাজার টাকা মুনাফা পেয়েছিলেন। সেই আগ্রহ থেকে দ্বিতীয়বার বড় পরিসরে বাণিজ্যিক আকারে চাষ শুরু করেন।

Advertisement

এবার মোটা অঙ্কের মুনাফা আশা করছেন তিনি। তবে মাশরুম চাষে এমন সম্ভাবনা বাস্তবায়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণ পেলে সারাবছরই চাষ করা সম্ভব বলে মনে করেন চাষিরা। এতে বেকারত্ব দূর হওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব।

নওগাঁ সদর উপজেলার কীর্ত্তিপুর ইউনিয়নের বেনীফতেপুর গ্রামের সাগর আলী। পড়াশোনা করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। মহামারিতে তার সবজি ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ে। দোকানও ঠিকমতো চলতো না। এ সময়ে তিনি ইউটিউবে মাশরুম চাষের ওপর ভিডিও দেখে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর মাশরুম চাষের ওপর মাগুরা জেলার সদর উপজেলার বড়খড়ি গ্রামে ডিএম সেন্টার নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চারদিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কিন্তু আবাদের জন্য নেই কোনো কৃষি জমি। সেখান থেকে বীজ (স্পন) সংগ্রহ করে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ করে বাড়ির উঠানে চাষ প্রথমবার চার মাসে ৯০ হাজার টাকা বিক্রি করেছিলেন।

সেই আগ্রহ থেকে সবজি ব্যবসার পাশাপাশি আবারও মাস্টার মাদার বীজ (স্পন) সংগ্রহ করে বাণিজ্যিকভাবে বাড়ির পাশে সামান্য জমিতে খামার করে মাশরুম চাষ করেন। এবার ৩০০ স্পনের প্যাকেট ও খামার তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। বাড়ির পাশেই ছোট্ট খামার করেছেন। যেখানে আট হাজার টাকার বীজ, উপকরণ এবং প্রায় ১২ হাজার টাকার ছাউনিসহ ঘরের অবকাঠামো তৈরি করেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: মাগুরায় রঙিন ফুলকপি চাষের আগ্রহ বাড়ছে 

নতুন এ খামারের বয়স ১ মাস। বীজ রোপণের ৪০ দিনের মধ্যে মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। এ সময়ের মধ্যে প্রতিদিন কয়েকবার পানি স্প্রে করতে হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ৫-৮ কেজি মাশরুম সংগ্রহ হচ্ছে। দিন যত যাবে মাশরুমের উৎপাদন তত বেশি হবে। মাশরুম পরিচর্যায় সহযোগিতা করছেন তার বড়মেয়ে সুরাইয়া আক্তার।

প্রতিদিনই সাগরের মাশরুমের খামার আশপাশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দেখতে আসছেন অনেকেই। কেউ মাশরুম কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এবং আবার কেউ পরামর্শ গ্রহণ করছেন। তার খামার দেখে যুবকরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। অনেক অসুস্থ ব্যক্তি মাশরুম খেয়ে উপকার পাওয়ার কথাও জানান। শহরের কয়েকটি রেস্টুরেন্ট ও ব্যক্তি তার নিয়মিত ক্রেতা।

মাশরুম খামারি সাগর আলী বলেন, ‘এবার খামারে ৩০০টি প্যাকেটে চাষ শুরু হয়েছে। ৫ কেজি ওজনের প্রতিটি প্যাকেটের বীজ, খড়কুটা ও কীটনাশকে খরচ পড়েছে প্রায় ৪০-৪৫ টাকা। ৩ মাসে প্রতিটি প্যাকেট থেকে মাশরুম সংগ্রহ হবে প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ কেজি। যা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা এবং খুচরা ৩০০ টাকা। ২৫০ টাকা হিসেবে ৩০০টি প্যাকেট থেকে আগামী তিন মাসে প্রায় ১২০০ কেজি মাশরুম সংগ্রহ হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ লাখ টাকা। এরই মধ্যে প্রায় ৯ হাজার টাকার বিক্রি করা হয়েছে। সবজির দোকান থেকে বিক্রি হচ্ছে। অনেকে ফোনে অর্ডার করেন। উৎপাদন যত বেশি হবে; বিক্রিও তত বাড়বে।’

Advertisement

মাশরুম চাষ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মাশরুম চাষের প্রধান উপকরণ খড় ও বীজ (স্পন)। খড় ছোট ছোট করে কেটে গরম পানিতে সেদ্ধ করে পরে হালকা করে শুকাতে হয়। প্যাকেট প্রস্তুত করার সময় বীজ দিয়ে মুখ বেঁধে রেখে সুচ দিয়ে কয়েকটা ছিদ্র করতে হয়। প্যাকেটের মধ্যে ছত্রাক যেন আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্য ছত্রাকনাশক দিতে হয়। এরপর ২০দিন পর প্রতিটি প্যাকেটে ৬-৭টি স্থানে প্রায় ১ ইঞ্চি পরিমাণ ছিদ্র বা প্যাকেটের গায়ে কেটে দিতে হবে। যেন মাশরুমের গাছটি বেরিয়ে আসতে পারে। ২০ দিন পর থেকেই প্যাকেটের গায়ে পানি স্প্রে করতে হয়। যেন মাশরুমের গাছ তাজা থাকে। ১ মাস পর থেকেই মাশরুম বিক্রির উপযোগী হয়। নিজেই এখন মাশরুমের বীজ (স্পন) তৈরি করছি।’

আরও পড়ুন: যমুনার বালুচরে সূর্যমুখীর হাসি 

মেয়ে সুরাইয়া আক্তার বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে সকাল-বিকেল মাশরুমে স্প্রে করার জন্য পানি দিয়ে সহযোগিতা করি। এ ছাড়া মাশরুমের প্যাকেট তৈরিতে যে খড়ের প্রয়োজন হয়, তা ছোট ছোট করে কাটতে ও শুকাতে সাহায্য করি।’

বৃদ্ধ মুনতাজ আলী বলেন, ‘গত ছয় মাস ধরে নিয়মিত মাশরুম খাচ্ছি। আগে কখনো খাইনি বা দেখিনি। এখন বাড়ির পাশেই চাষ হচ্ছে। এটি সুস্বাদু ও কিছুটা গরু-ছাগলের ভুড়ির মতো। ডায়াবেটিস ও এলার্জি নিরাময়ের জন্য আমার কাছে খুবই উপকারী মনে হয়েছে। আগে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হতো। এখন ওষুধ সেবনের পরিমাণ কমে গেছে।’

পাহাড়পুর গ্রামের যুবক মুক্তার হোসেন বলেন, ‘পাশের গ্রামে মাশরুম চাষ হচ্ছে শুনে দেখতে এসেছি। শুনেছি তিনি বেশ লাভবান হচ্ছেন। এ ছাড়া জায়গাও কম লাগে এবং পরিশ্রমও কম। যদি আমাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, আমরাও চাষ করতে পারতাম। বাড়তি আয়ের পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।’

নওগাঁ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফারহানা নাজনীন বলেন, ‘মাশরুম একটি পুষ্টিকর সুস্বাদু ও ওষুধি গুণসম্পন্ন খাবার। মাশরুম চাষে কোনো আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না। কম খরচে কম জায়গায় চাষ করা যায়। মাশরুম চাষ লাভজন। এরই মধ্যে সাগরের মাশরুমের খামার পরিদর্শন করা হয়েছে। মাশরুম চাষ বিষয়ে কোনো বরাদ্দ নেই। তবে যদি কেউ মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়, তাকে প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।’

আব্বাস আলী/এসইউ/জিকেএস