ফিচার

তীক্ষ্ণ চোখের ৯ ফুটের সাগর ঈগল

মানুষ হোক বা পশু-পাখি। দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজনীয়তা সবার জন্যই সমান। চলাফেরার জন্য দৃষ্টিশক্তির গুরুত্ব কতটুকু তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সবার দেখার ক্ষমতা আবার এক রকম হয় না। অল্পতেই কেউ ঠিকঠাক দেখে। কেউ বেশি দেখে। কেউ কম।

Advertisement

তবে পৃথিবীতে অনেক প্রাণী আছে, যাদের দৃষ্টিশক্তি আমাদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এ ধরনের প্রাণীর উদাহরণ দিতে গেলে প্রথমেই চলে আসে সাগর ঈগলের কথা। সাগরের বাজপাখি বলা হয় এদের।

পুরো নাম-স্টেলারস সি-ঈগল। রাশিয়ার কামচাটকার কুরিলস্কো লেকে এদের দেখতে পাওয়া যায়। শীতের প্রায় পুরো সময় ওরা কাটায় নিজের বাসায়। অপেক্ষা করে লেকে মাছ ভেসে ওঠার জন্য। আকাশে ডানা না মেলা পর্যন্ত বোঝা যায় না, কি বিশাল আকৃতি ওদের।

পূর্ণ বয়স্ক একটি সাগর-ঈগলের মেলে দেওয়া ডানার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ৯ ফুট। ওজনও কম নয়। প্রায় ২০ পাউন্ড। যা উত্তর আমেরিকার ন্যাড়া শকুনের চেয়েও অনেক বেশি। শীতে ওরা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত ওড়ে গেলেও ঘর বাঁধে শুধু পূর্ব রাশিয়ার বলকান শ্যান্টান্টের মতো দ্বীপাঞ্চলে।

Advertisement

এদের নামকরণ হয়েছে জর্জ স্টেলারের নামে। একজন জার্মান প্রকৃতি বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি। ১৭৪০ সালে কামচাটকায় গবেষণা করতে গিয়ে তিনি এদের দেখতে পান- স্যামন মাছের জন্য বিখ্যাত কুরিলস্কো লেকে।

শুনলে অবাক হতে হয়, এই সাগর ঈগল বা স্টেলার’স সি ঈগল পাখির দৃষ্টিশক্তি মানুষের চেয়ে ৩-৪ গুণ বেশি তীক্ষ্ম। শিকারি পাখি হিসেবে এই সাগর ঈগলের সুনাম আছে সর্বত্র। কয়েক মাইল দূর থেকে ওরা শিকার দেখতে পায়।

৮-১০ হাজার ফুট ওপর থেকে শিকার খোঁজে এই সাগর ঈগল। শিকার পেয়ে গেলে তো কথাই নেই! ১০০ মাইল বেগে ওরা ওই শিকার ধরতে নিচে নামা শুরু করে। আরও অবাক করা বিষয় হলো, এতো গতিতে চলেও শিকারের দিকে ঠিকই নজর রাখে স্টেলার’স সাগর ঈগল।

তবে স্টেলার’স সাগর -ঈগলরা মারামারি না করে খাবার খেতে পারে না। একা একা খাবার সুযোগ পায় না কেউই। যুদ্ধ ছাড়া খাবার জোটে না কারও। দিনের শুরু করে ওরা দোয়েল আর কাকের গতিবিধি দেখে। দোয়েল ও কাক নিজেরা প্রস্তুত থাকলেও ওরা যেনো পছন্দ করে ছোট ছোট তীক্ষ্ম চোখের পাখিগুলোর পথ প্রদর্শনে। বিনিময়ে ছিটে-ফোঁটা খাবার ওদের ভাগ্যেও জোটে। ঈগলের বিশাল ঠোঁট স্যামনের শক্ত চামড়া ফেঁড়ে ফেললেই ছোট পাখিগুলো ভেতরে উঁকি ঝুঁকি মেরে কামড়ে ছিড়ে একটু আধটু খুবলে নিয়েই তুষ্ট থাকে।

Advertisement

প্রথমে একটি ঈগল শিকার করলেই মুহুর্তের মধ্যে হাজির হয় অন্যরা। শুরু হয়ে যায় উম্মত্ততা। প্রথম শিকারী ডানা দিয়ে আগলে রাখতে চায় শিকার। ডান-বাম থেকে তখন চলতে থাকে টানা-হেঁচড়া। পুরষ্কারও অবশ্য মেলে। তখন লুণ্ঠনকারীর চেষ্টা চলে জিতে নেয়া খাবারকে আগলে রাখার।

কৌতূহলী গবেষকদের প্রশ্ন জাগে, পর্যাপ্ত খাবার থাকতেও কেন ওদের এই ধস্তাধস্তি-টানা হেচড়া? প্রাণী বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার লেজিজিন বিশ্বাস করেন স্যামনের চামড়া এতোটাই শক্ত যে ছেঁড়ার চাইতে চুরি করা বরং সহজ। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, ওরা এভাবেই খেতে পছন্দ করে।

চকিতে চমকিত লাজুক স্টেলার’স সাগর ঈগল দেখতে পাওয়া যায় পৃথিবীর দূর্গম জনবিরল কিছু অঞ্চলে। কামচাটকা থেকে ৭০০ মাইল পশ্চিমে সি অব ওস্টস্কের মরিসাইজ দ্বীপে থাকে ওরা। প্রতি বসন্তেই এই ঈগলেরা একই বাসায় একই সঙ্গীকে নিয়ে ফিরে আসে।

উঁচু গাছের পছন্দসই ডালে বাসা বাঁধে এমনভাবে যেন দূর থেকে নিজের বাড়ি আর মাছের খাঁড়ি দুদিকেই স্পষ্ট নজর রাখা যায়। গাছের ছোট ছোট ডাল, শুকনো ঘাস আর ছোট ছোট উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি হয় প্রায় ১০ ফুট প্রশস্ত কিং সাইজ বেডের চাইতেও চওড়া প্লাটফর্ম।

সুনসান নিরবতায় মাঝে মাঝে শোনা যায় খাদ্যের জন্য বাচ্চাদের চেচাঁমেচি আর বাড়ির খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়া দুই ঈগলদের উদ্দেশে বাবা মায়ের শাসানি। স্যামনের আনাগোনার শুরু হওয়ার আগে, বড় ঈগলেরা রাতে ছোট ছোট মাছ ধরে ঘরে আনে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য।

গবেষকরা লক্ষ্য করেন, শুধু মা-ঈগলই বাচ্চাদের খাওয়ায়। ৯০ দিন লাগে বাচ্চা ঈগলের ওড়া শিখতে। সাদা ধবধবে ঘাড়, লেজ, পা আর কপাল পুরোপুরি শক্তপোক্ত হতে সময় লাগে প্রায় ৬-৮ বছর।

স্টেলার’স সাগর ঈগলের এই জীবন বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য, আচরণ মানুষকে সহনশীল, একতাবদ্ধ জীবনের প্রেরণা জোগায় বৈকি!

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।

জেএমএস/এএসএম