ভ্রমণ

উজবেকিস্তান: ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতার দেশ

সাইফুর রহমান তুহিন

Advertisement

সমগ্র বিশ্বের অগণিত পর্যটকের মধ্যে অধিকাংশই মূলত দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে ভ্রমণে বের হন। একাংশ চান প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে এবং তারা সাধারণত দৃষ্টিনন্দন সমুদ্রসৈকত কিংবা চোখজুড়ানো পাহাড়ি এলাকাকে বেছে নেন। অন্য অংশটি পছন্দ করেন কোনো ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করতে এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ভালো করে জানতে। আপনি যদি দ্বিতীয় ভাগটির অন্তর্ভুক্ত কেউ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার জন্য আদর্শ এক গন্তব্য হতে পারে মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান। এটি একটি ভূমিবেষ্টিত রাষ্ট্র এবং দেশটির সাথে সীমান্ত আছে আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কিরঘিজিস্তানের। ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং নজরকাড়া সব মুসলিম স্থাপত্যকর্মের জন্য ব্যাপক পরিচিতি আছে উজবেকিস্তানের। তাসখন্দ, সমরখন্দ, বুখারা, খিভা প্রভৃতি স্থান মুসলিম সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চমৎকার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের কারণে উজবেকিস্তান তার প্রতিবেশী অন্যান্য মধ্য এশিয়ান দেশগুলোর তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ১৯৯১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর উজবেকিস্তানের পর্যটনশিল্প দ্রুত প্রসার লাভ করছে।

উজবেকিস্তানের প্রধান প্রধান গন্তব্যতাসখন্দ: ঐতিহাসিক তাসখন্দ নগরী শুধু উজবেকিস্তানের রাজধানীই নয়, গোটা মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চতুর্থ বৃহত্তম নগরী ছিল তাসখন্দ। তাসখন্দের রাস্তায় রাস্তায় দেখতে পাবেন মাথায় তারব্যান্ড বাঁধা এবং সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা রাখালদের সাথে ভেড়ার পাল। দায়েউ নেক্সিয়াসের সামনে একটার পর একটা টিকো কার, মাটির নিচে মেট্রোরেলের নড়াচড়া—এসব দেখে আপনি ভালোভাবেই টের পাবেন যে, আপনি তাসখন্দ শহরে আছেন। যদিও অনেক সময় ঐতিহাসিক সিল্ক রোড সংলগ্ন শহর সমরখন্দ, বুখারা ও খিভার সন্ধানের ছায়ায় তাসখন্দ একটু ঢাকা পড়ে যায়। তারপরও আপনি ঘুরে দেখতে পারেন চোরসু বাজার, আমির তৈমুর স্কয়ার, খাস্ত-ইমাম এনসেম্বল, ফলিত শিল্প জাদুঘর, তাসখন্দ মেট্রোরেল, তাসখন্দ টাওয়ার (যা বিশ্বের দীর্ঘতম টেলিভিশন টাওয়ারগুলোর একটি), দৃষ্টিনন্দন কুকেলদশ মাদ্রাসা, স্বাধীনতা স্কোয়ার, উজবেক পার্লামেন্ট ভবন, উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রীয় জাদুঘর প্রভৃতি। আর শহরের বাইরে আছে নজরকাড়া চিমগান পর্বত, যা একটি চমৎকার পিকনিক স্পট।

রাতে থাকার জন্য ভালো হোটেলের কোনো অভাবই নেই তাসখন্দ নগরীতে। শহরটির তেমন কোনো নির্দিষ্ট প্রাণকেন্দ্র নেই। তাই বেশির ভাগ হোটেল গড়ে উঠেছে মূল শহর ও বিমানবন্দরের আশেপাশে। লা গ্র্যান্ড প্লাজা হোটেল, হোটেল উজবেকিস্তান, মিরান ইন্টরন্যাশনাল হোটেল, শডলিক প্যালেস হোটেল, হোটেল ইন্টারন্যাশনাল তাসখন্দ, হোটেল সিটি প্যালেস, লোটে সিটি তাসখন্দ প্যালেস হোটেল, র্যাডিসন ব্লু তাসখন্দ হোটেল, গোল্ডেন ভ্যালি হোটেল প্রভৃতি হলো তাসখন্দ নগরীর সুপরিচিত হোটেলসমূহ। যে হোটেলেই থাকুন না কেন রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় উজবেকদের জাতীয় খাবার পালভের (ইংরেজি নাম পিলাফ) স্বাদ পরখ করতে ভুলবেন না। ভেড়ার মাংস, চাল ও সবজি দিয়ে তৈরি মুখরোচক খাবারটি পাবেন তাসখন্দ কিংবা অন্যান্য শহরের যে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে। এ ছাড়া সেখানকার তান্দির কাবাব, মান্টি ও শরবা নামের একজাতীয় স্যুপ খুবই জনপ্রিয়।

Advertisement

সমরখন্দ: সম্ভবত আধুনিক উজবেকিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত শহর হলো সমরখন্দ। খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ২০০০ সালে এ নগরীর গোড়াপত্তন হয়। পুরোনো শহরটি আফরোসিয়াব নামে পরিচিত এবং গ্রিকরা একে বলে মারাকান্দা। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৯ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের শাসনামলে পার্সিয়ান প্রদেশ সোগদিয়ানার রাজধানী ছিল সমরখন্দ। পরে এটি চীন ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যকার সড়কের একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি আরবদের দ্বারা শাসিত হয় এবং মুসলিম সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে। ১২২০ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গল শাসক চেঙ্গিস খান সমরখন্দকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেন। ১৩৬৯ সালে সম্রাট তৈমুর লং সমরখন্দকে তার রাজধানী বানালে আবার পুনর্গঠিত হয় সমরখন্দ। নিজের রাজধানী হিসেবে সমরখন্দকে বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরেন তৈমুর লং। এখন সেখানে যেসব স্থাপত্যকর্ম দেখা যায়, সেগুলো তৈমুর লং ও তার বংশধরদের হাতে গড়া। ইমাম আল বুখারী স্মৃতিস্তম্ভ, সেন্ট ড্যানিয়েলস স্মৃতিস্তম্ভ, উলুগবেক অবজারভেটরি, শাহ-ই-জিন্দা কমপ্লেক্স, বিবি খানম মসজিদ, গুর আমির স্মৃতিস্তম্ভ ও রেগিস্তান স্কয়ার হলো সমরখন্দের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।

সমরখন্দে বেড়াতে গেলে থাকা-খাওয়া নিয়ে চিন্তার কিছুই নেই। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর অনেক আধুনিক হোটেল গড়ে উঠেছে সেখানে। কামিলা হোটেল, গ্র্যান্ড সমরখন্দ হোটেল, ক্যারাভ্যান সেরাইল চোরাখা হোটেল, হোটেল রেগিস্তান প্লাজা, ওরিয়েন্ট স্টার হোটেল, এশিয়া সমরখন্দ হোটেল, মালিকা প্রাইম হোটেল, হোটেল আর্ক সমরখন্দ, জাহোঙ্গির হোটেল প্রভৃতি হলো সমরখন্দ নগরীর উল্লেখযোগ্য হোটেল।

বুখারা: মধ্য এশিয়ার প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি হলো বুখারা। এই শহরের অবিভক্ত ঐতিহাসিক ভবনগুলোর বেশিরভাগই মধ্যযুগীয় সময়ের শেষ পর্যায়ে নির্মিত। নানান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে বুখারার বিভিন্ন জায়গাজুড়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিরামিক পটারি, ফায়ারপ্লেস, ছবি ও লেখাযুক্ত প্রাচীন মুদ্রা, প্রাচীন ধাতব সামগ্রী, অলংকার, হস্তশিল্পের সরঞ্জাম প্রভৃতি। একটি দীর্ঘ সময় ধরে বুখারা পার্সিয়ান শাসনের অধীনস্থ ছিল। প্রাচীনকালে আরিয়ানরা এখানে বসতি গড়েছিল এবং বুখারার স্থানীয় বাসিন্দারা এদেরই উত্তর পুরুষ। ইরানের সোগদিয়ানরাও এখানে বসবাস করেছিল এবং এর কয়েক শতাব্দী পর এখানে পার্সিয়ান ভাষার বেশ প্রাধান্য ছিল। বুখারায় বেড়াতে গেলে যেখানে অবশ্যই যাবেন, তা হলো হিস্টোরিক সেন্টার অব বুখারা। ইতিহাস ও সভ্যতার অনেক নিদর্শনই আছে সেখানে।

সোভিয়েত আমলে বুখারায় ব্যক্তিমালিকানাধীন আধুনিক আবাসিক হোটেল একপ্রকার অকল্পনীয়ই ছিল এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হোটেলগুলোর পরিবেশ ছিল খুবই বাজে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। কমিল বুখারা বুটিক হোটেল, বুখারা প্যালেস হোটেল, ওল্ড সিটি হোটেল, হোটেল গ্র্যান্ড বুখারা, ওমর খৈয়াম হোটেল, এশিয়া বুখারা হোটেল, মিনজিফা বুটিক হোটেল, কামেরলট হোটেল প্রভৃতি সদা প্রস্তুত আপনাকে উষ্ণ আতিথেয়তা দিতে।

Advertisement

খিভা: আরব সাগরের দক্ষিণে অবস্থান খিভা শহরের। খিভা বিখ্যাত তার সব প্রাচীন ভবনগুলোর জন্য, যার অনেকগুলোই জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত। উজবেকিস্তানের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি হলো খিভা। এখানকার বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ভবনগুলো উনবিংশ শতাব্দীতে স্থাপিত এবং স্থাপত্যের বৈচিত্র্যের কারণে খিভা আপনাকে একটি স্পষ্ট ধারণা দেবে যে, মধ্য এশিয়ার অন্যান্য শহরগুলো আগে দেখতে কেমন ছিল। এখানে থাকার জন্য আছে ওরিয়েন্ট স্টার খিভা হোটেল, আজিয়া খিভা হোটেল, হোটেল মালিকা খিভা, হোটেল আরকাঞ্চি, হোটেল মালিকা খিয়েভাক, ইসলামবেক হোটেল, মেরোস হোটেল প্রভৃতি।

গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী: পর্যটকবান্ধব একটি দেশ হিসেবে উজবেকিস্তানের ভিসা জোগাড় করা খুব কঠিন নয়। গুগলে সার্চ দিয়ে আপনি সহজেই ভিসা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জেনে নিতে পারবেন। বাংলাদেশে উজবেকিস্তান কনস্যুলেটের ঠিকানা হলো- ওয়াইল সেন্টার, ৩য় তলা, বাড়ি নং-৭৪, গুলশান এভিনিউ, ঢাকা। হযরত শাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ নগরীর কোনো সরাসরি ফ্লাইট নেই। তবে কানেকটিং ফ্লাইট সহজেই পাওয়া যাবে। টার্কিশ এয়ারলাইন্স, এমিরেটস এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারওয়েজ, থাই এয়ারওয়েজ, ইতিহাদ এয়ারওয়েজ, সৌদি এয়ারলাইন্স, গালফ এয়ার, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, এয়ার ইন্ডিয়া প্রভৃতি ঢাকা ও তাসখন্দের মধ্যে কানেকটিং ফ্লাইট পরিচালনা করে।

উজবেকিস্তানের জলবায়ু একটু উষ্ণমণ্ডলীয়। গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও শুষ্ক। এপ্রিল থেকে জুন এবং আগস্টের দ্বিতীয় ভাগ থেকে নভেম্বর হলো উজবেকিস্তান ভ্রমণের সেরা সময়। দেশটির অফিসিয়াল ভাষা উজবেক, তবে রুশ ভাষার প্রচলনও ভালোভাবেই আছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে ইংরেজি ভাষা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রা হলো সুম। এক মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য হলো আনুমানিক ১০,৯৬০ উজবেক সুম। দেশটির বিভিন্ন স্থানে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে বলে ভ্রমণের সময় একজন ইংরেজি জানা স্থানীয় গাইড সাথে রাখা এবং কমপক্ষে দিন দশেক সেখানে অবস্থান করা উচিত। জাতি হিসেবে উজবেকরা খুবই অতিথিপরায়ণ ও পর্যটকবান্ধব, যা আপনাকে বাড়তি সুবিধা দেবে।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও ভ্রমণ লেখক।

এসইউ/জেআইএম