রোজা রাখার মাস রমজান। রমজানের রোজা রাখার সময় অনিচ্ছাকৃত যেসব ভুল-ত্রুটি হয়েছে, সেসব থেকে পবিত্র হওয়াই ফিতরা দেওয়ার উদ্দেশ্য। ঈদের আগে ফিতরা আদায় না করলে রোজাদারের রোজা আসমান ও জমিনে ঝুলন্ত থাকে বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবি। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিতরা দেওয়াকে ওয়াজিব করেছেন। কিন্তু কারা কারা পাবেন এ ফিতরা?
Advertisement
রোজার ফিতরা প্রকৃত হকদারকেই দিতে হবে। ইচ্ছামতো যাকে-তাকে ফিতরা দেওয়া যাবে না। কারা কারা ফিতরা পাওয়ার যোগ্য এ সম্পর্কেও রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। তাহলো-
'যারা জাকাত পাওয়ার অধিকার রাখে। তারাই রোজার ফিতরা পাওয়ার হক রাখে। যেসব খাত ও ব্যক্তি জাকাতের হকদার নয়, তাদের ফিতরাও দেওয়া যাবে না। এ বিষয়টি কুরআনুল কারিমের সুরা তাওবাহ-এর ৬০নং আয়াত দ্বারাই মীমাংসিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاء وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
Advertisement
'জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য, এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।' (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৬০)
আল্লাহ তআলা এ আয়াতে জাকাতের ৮টি খাতের বিবরণ তুলে ধরেছেন। আর এ লোকেরাই ফিতরা গ্রহণ করতে পারবেন। তারা হলেন-
১. নিঃস্ব ফকির
ফকির বলা হয়, যার কোনো সম্পদ নেই; নেই তার উপযোগী হালাল উপার্জন; যা দ্বারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। যার খাওয়া-পরা ও থাকার কোনো স্থান নেই। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নেই। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ফকির হলো সেই ব্যক্তি; যার সামান্য সম্পদ আছে। তবে জীবন ধারণের জন্য অপরের ওপর নির্ভর করতে হয়।
Advertisement
আল্লামা তাবারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি ফকিরের সংজ্ঞায় বলেন, 'ওই অভাবগ্রস্ত যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলেছে, কারোর কাছেই কিছুর প্রার্থনা করে না।
২. অভাবগ্রস্ত মিসকিন
মিসকিন বলা হয় যার এমন পরিমাণ সম্পদ আছে, যা দ্বারা তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়। আল-ফাতওয়া আল-হিন্দিয়ায় এসেছে, মিসকিন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কিছুই নেই, যে মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়ায় এবং খাদ্য-বস্ত্রের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়।
৩. জাকাত উঠানোর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি
যারা জাকাত আদায়কারী, সংরক্ষণকারী, পাহারাদার, লেখক, হিসাবরক্ষক এবং তার বণ্টনকারী এদের সবাইকে জাকাতের ফান্ড থেকে বেতন দিতে হবে। তবে-
> তাকে মুসলিম হতে হবে,
> পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ বিবেকসম্পন্ন হতে হবে,
> জাকাতের বিধান সম্পর্কে ইলম থাকতে হবে,
> আমানতদারি ও কাজের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে,
> স্বাধীন মুসলিম নিয়োগ করতে হবে, ক্রীতদাস নয়।
৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন/নও মুসলিম
ইসলামের প্রতি যাদের মন আকর্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য লোকদের জাকাতের খাত থেকে প্রদান করা। ইমাম যুহরির মতে, যে ইয়াহুদি বা খ্রিস্টান ইসলাম কবুল করবে, সে-ই এর মধ্যে গণ্য, সে যদি ধনী হয় তবুও।
৫. দাস মুক্তির জন্য
মালিককে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে যে ক্রীতদাস তার মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবন্ধ হয়েছে। কিংবা কোনো মুসলিম যুদ্ধবন্দিও এ খাতের আওতায় পড়বে। ইবনুল আরাবির মতে, মুসলিম দাসকে যখন মুক্ত করতে জাকাতের খাত থেকে দেয়া যাবে, ঠিক তেমনি মুসলিম বন্দিকে কাফিরদের দাসত্ব শৃঙ্খলা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজেও জাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম বলে বিবেচিত হবে।
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি
এমন ঋণের ভারে জর্জরিত, যার ঋণ পরিশোধের কোনো অবস্থান নেই। এমন ব্যক্তিকে জাকাতের ফান্ড থেকে সাহায্য করা।
৭. আল্লাহর পথে খরচ করা
আল্লাহর পথ বলতে আকিদা বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় যে পথ।
৮. মুসাফিরদের জন্য
নিজ আবাসস্থলে সম্পদ আছে, এমন ব্যক্তি যদি সফরে গিয়ে বিপদগ্রস্ত ও নিঃস্ব হয়, তাকে জাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য করা।
মনে রাখতে হবে
হাদিসে বর্ণিত গম, যব, কিসমিস, খেজুর ও পনির হলো ফিতরা পণ্য। এসব পণ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করাই সুন্নাত। তবে এ নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে অনেক মতবিরোধ আছে। তাই গরিব-মিসকিনকে যেসব পণ্য দিলে তারা উপকৃত হবে তা দিয়ে ফিতরা আদায় করা উত্তম।
ফিতরা আদায়ের উত্তম পন্থা
নিজ পরিবার-পরিজনের মধ্য যারা গরিব-অসহায়, তারাই ফিতরার প্রথম হকদার। আর একজনকে ন্যূনতম পূর্ণ একটি ফিতরা দেয়া উত্তম। প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে কয়েক জনের ফিতরাও একজনকে দেয়া যেতে পারে। এতে গরিব-অসহায় ব্যক্তির উপকার হয়।যে অর্থে ফিতরার এ অর্থকে উপযুক্ত যে কোনো কাজেও লাগাতে পারে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নির্ধারিত স্থানেও ফিতরা দেয়ার তাওফিক দান করুন। ফিতরা আদায় করার মাধ্যমে রোজার ভুল-ত্রুটিগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম