আল্লাহ মিথ্যাবাদী নন, তিনিই সত্য উপাস্য। ২১ তারাবি আজ। ২৪ পারা শুরুতেই আল্লাহর পরিচয়, ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা এসেছে। অথচ অবিশ্বাসীরা আল্লাহকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে। আজকের তারাবির প্রথম রাকাতেই 'আল্লাহকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা দুঃসাহসী জালিমদের অবস্থান চিরস্থায়ী জাহান্নাম' এ সতর্ক বাণী ঘোষণায় হাফেজে কোরআনগণ নামাজ শুরু করবেন। অবিশ্বাসীদের কত বড় দুঃসাহস! তারা মহান আল্লাহকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে। আল্লাহর সত্য বাণী কোরআনকে তারা অস্বীকার করে। এদের চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে?
Advertisement
আজকের তারাবিতে সুরা যুমার (৩২-৭৫), সুরা মুমিন এবং সুরা হা-মিম আস-সাজদার ৪৬ আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে। সে সঙ্গে ২৪তম পারার তেলাওয়াত শেষ হবে। আজকের তারাবির আলোচ্য বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
সুরা যুমার : আয়াত ৩২-৭৫
এ সুরাটিও মক্কায় অবতীর্ণ। সুরাতুল গোরাফ নামেও এ সুরাটি পরিচিত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হলেও হজরত হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকারী সম্পর্কিত যে তিনটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, আয়াত তিনটি মদীনায় অবতীর্ণ।
Advertisement
এ সুরার অধিকাংশ বক্তব্য তাওহিদ সম্পর্কিত। যারা তাওহিদে বিশ্বাস করে, তাদের পুরস্কার; যারা অবিশ্বাস করে তাদের শাস্তির কথাও এ সুরায় ঘোষিত হয়েছে। মানবতার কলংক শিরক তথা অংশীবাদের বাতুলতা ঘোষণা করা হয়েছে।
অবিশ্বাসীদের কত বড় দুঃসাহস! তারা মহান আল্লাহকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে। আল্লাহর সত্য বাণী কোরআনকে তারা অস্বীকার করে। এদের চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে? আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ کَذَبَ عَلَی اللّٰهِ وَ کَذَّبَ بِالصِّدۡقِ اِذۡ جَآءَهٗ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَهَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡکٰفِرِیۡنَ
'সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা বলে এবং তার কাছে আগত সত্যকে (কোরআনকে) মিথ্যাজ্ঞান করে, তার চেয়ে অধিক সীমালংঘনকারী আর কে? অবিশ্বাসীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি?
Advertisement
অবিশ্বাসীরা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা দাবি করে যে, 'আল্লাহর সন্তান-সন্ততি অথবা তাঁর শরিক আছে কিংবা তাঁর স্ত্রী আছে; অথচ তিনি এই সব জিনিস থেকে পাক ও পবিত্র। যাতে আছে তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ), (দ্বীনের) বিধি-বিধান ও ফরজ কার্যাদি; পুনরুত্থান সম্পর্কীয় আকিদা-বিশ্বাস, হারাম কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ এবং মুমিনদের জন্য সুসংবাদ ও কাফেরদের জন্য ধমক ও শাস্তির কথা। এ হল সেই দ্বীন ও শরিয়ত; মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে আগমন করেছেন। এটাকে তারা মিথ্যা মনে করে।
আল্লাহর পরিচয় ও শ্রেষ্ঠত্ব
আল্লাহ তাআলা তাঁর পরিচয়ের বিষয়টি সুরা ইখলাসে সুস্পষ্ট তুলে ধরেছেন এভাবে-
قُلۡ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌ
'বলুন, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়।' (সুরা ইখলাস : আয়াত ১)
হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলার বংশ-পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল, যার জওয়াবে এই সুরা নাজিল হয়।' (তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরাকে হাকেম)
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, মুশরিকরা আরও প্রশ্ন করেছিল- 'আল্লাহ তাআলা কিসের তৈরি, সোনা-রূপা অথবা অন্য কিছুর? এর জওয়াবে সুরাটি অবতীর্ণ হয়েছে।' (নাসাঈ, তাবরানি, মুসনাদে আবু ইয়ালা)
তাই এখানে ‘বলুন’ শব্দটির মাধ্যমে প্রথমত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ সম্পর্কে তাকেই প্রশ্ন করা হয়েছিল। আপনার রব কে? তিনি কেমন?
আবার এ সুরায় তাকেই হুকুম দেওয়া হয়েছিল, প্রশ্নের জবাবে আপনি একথা বলুন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর এ সম্বোধনটি প্রত্যেক মুমিনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে কথা বলার হুকুম দেওয়া হয়েছিল এখন সে কথা প্রত্যেক মুমিনকেই বলতে হবে।
এ বাক্যটির অর্থ হচ্ছে, তিনি (যার সম্পর্কে তোমরা প্রশ্ন করছে) আল্লাহ, একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো সমকক্ষ, সদৃশ, স্ত্রী, সন্তান, অংশীদার কিছুই নেই। একত্ব তাঁরই মাঝে নিহিত। তাই তিনি পূর্ণতার অধিকারী, অদ্বিতীয়-এক। সুন্দর নামসমূহ, পূর্ণ শ্রেষ্ঠ গুণাবলী এককভাবে শুধু তারই।' (কুরতুবি)
আর أَحَد শব্দটি শুধু আল্লাহ ছাড়া আর কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কেননা তিনিই গুণাবলী ও কার্যাবলীতে একমাত্র পরিপূর্ণ সত্তা।
মোটকথা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর সত্তা ও গুণাবলীতে একক, তার কোনো সমকক্ষ, শরিক নেই। এ সুরার শেষ আয়াত 'আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই' দ্বারা তিনি এর ব্যাখ্যা করেছেন।
মূলত পুরো কোরআন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাত; এমনকি সব নবি-রাসুলদের রেসালাতের আগমন হয়েছিলো এ একত্ব ঘোষণা ও প্রতিষ্ঠার জন্যই। আল্লাহ ছাড়া কোনো হক মাবুদ বা ইলাহ নেই। পুরো সৃষ্টিজগতেই রয়েছে এর পরিচয়, আল্লাহর একত্ববাদের পরিচয়। কোরআনে অগণিত আয়াতে এ কথাটির প্রমাণ ও যুক্তি রয়েছে।
اَللّٰهُ الصَّمَدُ
'আল্লাহ হচ্ছেন সামাদ : তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। (সুরা ইখলাস : আয়াত ২)
এখানে صمد শব্দের অর্থ সম্পর্কে তাফসীরবিদদের অনেক উক্তি আছে। হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইকরামা বলেছেন, 'সামাদ হচ্ছেন এমন এক সত্তা, যার কাছে সবাই তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য (দাবি/চাহিদা) পেশ করে থাকে।'
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আবু ওয়ায়েল শাকিক ইবনে সালামাহ বলেছেন, তিনি এমন সরদার, নেতা, যার নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যে সরদার তার নেতৃত্ব, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, সংযম, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা তথা শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার সমস্ত গুণাবলিতে সম্পূর্ণ পূর্ণতার অধিকারী তিনি সামাদ।
হজরত যায়েদ ইবন আসলাম বলেন, এর অর্থ, নেতা।
হজরত হাসান ও কাতাদা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এর অর্থ- 'যিনি তার সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে গেলেও অবশিষ্ট থাকবেন।'
হজরত হাসান থেকে অন্য বর্ণনায় বলেন, 'তিনি ওই সত্বা, যিনি চিরঞ্জীব ও সবকিছুর ধারক, যার কোনো পতন নেই।'
অন্য বর্ণনায় হজরত ইকরিমা বলেন, 'যার থেকে কোনো কিছু বের হয়নি এবং যিনি খাবার গ্রহণ করেন না।'
হজরত রবি ইবনে আনাস বলেন, 'যিনি জন্ম গ্ৰহণ করেননি এবং জন্ম দেননি।'
শাবি বলেন, এর অর্থ- 'যিনি খাবার খান না এবং পানীয় গ্রহণ করেন না।' (তাবারি, ইবন কাসির, ফাতহুল কাদির)
উপরে সবগুলো অর্থই নির্ভুল। এর মানে হচ্ছে, আসল ও প্রকৃত সামাদ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। সৃষ্টি যদি কোনো দিক দিয়ে সামাদ হয়ে থাকে তাহলে অন্য দিক দিয়ে তা সামাদ নয়; কারণ তা অবিনশ্বর নয় একদিন তার বিনাশ হবে।
কোনো কোনো সৃষ্টি তার মুখাপেক্ষী হলেও সে নিজেও আবার কারো মুখাপেক্ষী। তার নেতৃত্ব আপেক্ষিক, নিরংকুশ নয়। কারো তুলনায় সে শ্রেষ্ঠতম হলেও তার তুলনায় আবার অন্য কেউ আছে শ্রেষ্ঠতম। কিছু সৃষ্টির কিছু প্রয়োজন সে পূর্ণ করতে পারে। কিন্তু সবার সব প্রয়োজন পূর্ণ করার ক্ষমতা কোনো সৃষ্টির নেই।
পক্ষান্তরে মহান আল্লাহর সামাদ হবার গুণ অর্থাৎ তাঁর মুখাপেক্ষীহীনতার গুণ সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ। সারা দুনিয়া তাঁর মুখাপেক্ষী তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিস নিজের অস্তিত্ব, স্থায়ীত্ব এবং প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য সচেতন ও অবচেতনভাবে তাঁরই শরণাপন্ন হয়। তিনিই তাদের সবার প্রয়োজন পূর্ণ করেন।
আল্লাহ; তিনি অমর, অজয়, অক্ষয়। তিনি রিজিক দেন, নেন। সমগ্ৰ বিশ্ব জাহানের ওপর তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই তিনি 'আস-সামাদ'। অর্থাৎ তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি অমুখাপেক্ষিতার গুণাবলীর সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত। আবার যেহেতু তিনি 'আস-সামাদ' তাই তার একাকি ও স্বজনবিহীন হওয়া অপরিহার্য। কারণ এ ধরনের সত্তা একজনই হতে পারেন, যিনি কারো কাছে নিজের অভাব পূরণের জন্য হাত পাতেন না, বরং সবাই নিজেদের অভাব পূরণের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী হয়।
দুই বা তার চেয়ে বেশি সত্তা সবার প্রতি অমুখাপেক্ষী ও অনির্ভরশীল এবং সবার প্রয়োজন পূরণকারী হতে পারে না। তাছাড়া তাঁর 'আস-সামাদ' হবার কারণে তাঁর একক মাবুদ হওয়ার ব্যাপারটিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
কারণ মানুষ যার মুখাপেক্ষী হয় তারই ইবাদাত করে। আবার তিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। 'আস-সামাদ' হওয়ার কারণে এটাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ, যে প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষমতা ও সামর্থই রাখে না, কোনো সচেতন ব্যক্তি তার ইবাদাত করতে পারে না। এভাবে আমরা উপরোক্ত অর্থগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারি।
لَمۡ یَلِدۡ ۬ وَ لَمۡ یُوۡلَدۡ
'তিনি কাউকেও জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেওয়া হয়নি।' (সুরা ইখলাস : আয়াত ৩)
যারা আল্লাহর বংশ পরিচয় জিজ্ঞাসা করেছিল, এটা তাদের প্রশ্নের উত্তর। সন্তান প্ৰজনন সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য; স্রষ্টার নয়। অতএব, তিনি কারও সন্তান নন এবং তাঁর কোনো সন্তান নেই। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, 'আদম সন্তান আমার উপর মিথ্যারোপ করে অথচ এটা তার জন্য উচিত নয়। আর আমাকে গালি দেয়, এটাও তার জন্য উচিত নয়। তার মিথ্যারোপ হচ্ছে, সে বলে আমাকে যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন সেভাবে তিনি কখনও আমাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন না। অথচ দ্বিতীয় সৃষ্টি প্রথম সৃষ্টির চেয়ে কোনভাবেই কঠিন নয়। আর আমাকে গালি দেওয়ার ব্যাপারটি হলো, সে বলে আল্লাহ সন্তান গ্ৰহণ করেছেন। অথচ আমি একক, সামাদ, জন্মগ্রহণ করিনি এবং কাউকে জন্মও দেইনি। আর কেউই আমার সমকক্ষ নেই।' (বুখারি)
وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ کُفُوًا اَحَدٌ
'এবং তাঁর সমতুল্য কেউই নেই।' (সুরা ইখলাস : আয়াত ৪)
বলা হয়েছে ‘কুফু’। এর মানে হচ্ছে, নজীর, সদৃশ, সমান, সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমতুল্য। আয়াতের মানে হচ্ছে, সারা বিশ্ব-জাহানে আল্লাহর সমকক্ষ অথবা তাঁর সমমর্যাদাসম্পন্ন কিংবা নিজের গুণাবলী, কর্ম ও ক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর সমান পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এমন কেউ কোনো দিন ছিল না এবং কোনো দিন হতেও পারবে না। এবং আকার-আকৃতিতেও কেউ তাঁর সাথে সামঞ্জস্য রাখে না। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত বুরাইদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন এক লোক নামাজ আদায় করছে এবং বলছে-
اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ بِأَنِّى أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ الَّذِى لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِى لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُواً أَحَدٌ
উচ্চারণ : 'আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিআন্নি আশহাদু আন্নাকা আংতাল্লাহুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা আংতাল আহাদুস সামাদুল্লাজি লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ ওয়া লাম ইকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।'
এটা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, এ লোকটি আল্লাহকে তাঁর এমন মহান নামে ডাকলো যার অসিলায় চাইলে তিনি প্ৰদান করেন। আর যার দ্বারা দোয়া করলে তিনি কবুল করেন।' (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
মুশরিকরা প্রতি যুগে মাবুদদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করে এসেছে যে, মানুষের মতো তাদেরও একটি জাতি বা শ্রেণী আছে। তার সদস্য সংখ্যাও অনেক। তাদের মধ্যে বিয়ে-শাদী এবং বংশ বিস্তারের কাজও চলে। তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকেও এ জাহেলি ধারণা মুক্ত রাখেনি।
তাঁর জন্য সন্তান সন্ততিও ঠিক করে নিয়েছে। তারা ফেরেশতাদেরকে মহান আল্লাহর কন্যা গণ্য করতো। যদিও তাদের কেউ কাউকে আল্লাহর পিতা গণ্য করার সাহস করেনি। কিন্তু তারা তাদের কোনো কোনো ব্যক্তি বা নবিকে আল্লাহর সন্তান মনে করতে দ্বিধা করেনি। এ সবের উত্তরেই এ সুরায় বলা হয়েছে-
'তিনি কাউকে জন্ম দেননি। আর তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি।'
যদিও মহান আল্লাহকে 'আহাদ' ও 'আস-সামাদ' বললে এসব উদ্ভট ধারণা-কল্পনার মুলে কুঠারাঘাত করা হয়, তবুও এরপর 'না তাঁর কোনো সন্তান আছে, না তিনি কারো সন্তান' একথা বলায় এ ব্যাপারে আর কোনো প্রকার সংশয় সন্দেহের অবকাশই থাকে না।
এরপর যেহেতু আল্লাহর মহান সত্তা সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা-কল্পনা শিরকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর অন্তর্ভুক্ত, তাই মহান আল্লাহ শুধুমাত্র সুরা ইখলাসেই এগুলোর দ্ব্যর্থহীন ও চূড়ান্ত প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।
এভাবে লোকেরা সত্যকে পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নীচের আয়াতগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে-
১. اِنَّمَا اللّٰهُ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ؕ سُبۡحٰنَهٗۤ اَنۡ یَّکُوۡنَ لَهٗ وَلَدٌ ۘ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ وَکِیۡلًا
'আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র ইলাহ। কেউ তাঁর পুত্র হবে, এ অবস্থা থেকে তিনি মুক্ত-পাক-পবিত্র। যা কিছু, আকাশসমূহের মধ্যে এবং যা কিছু জমিনের মধ্যে আছে, সবই তার মালিকানাধীন।' (সুরা নিসা : আয়াত ১৭১)
২. اَلَاۤ اِنَّهُمۡ مِّنۡ اِفۡکِهِمۡ لَیَقُوۡلُوۡنَ - وَلَدَ اللّٰهُ ۙ وَ اِنَّهُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ
'জেনে রাখো! এরা যে বলছে আল্লাহর সন্তান আছে, এটা এদের নিজেদের মনগড়া কথা। আসলে এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা।' (সুরা আস-সাফফাত : আয়াত ১৫১–১৫২)
৩. وَ جَعَلُوۡا بَیۡنَهٗ وَ بَیۡنَ الۡجِنَّۃِ نَسَبًا ؕ وَ لَقَدۡ عَلِمَتِ الۡجِنَّۃُ اِنَّهُمۡ لَمُحۡضَرُوۡنَ
'তারা আল্লাহ ও জিনদের মধ্যে বংশীয় সম্পর্কে তৈরি করে নিয়েছে অথচ জিনেরা ভালো করেই জানে এরা (অপরাধী হিসেবে) উপস্থাপিত হবে।' (সুরা আস-সাফফাত : আয়াত ১৫৮)
৪. وَ جَعَلُوۡا لَهٗ مِنۡ عِبَادِهٖ جُزۡءًا ؕ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَکَفُوۡرٌ مُّبِیۡنٌ
'লোকেরা তার বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে তার অংশ বনিয়ে ফেলেছে। আসলে মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ।' (সুরা আয-যুখরুফ : আয়াত ১৫)
৫. وَ جَعَلُوۡا لِلّٰهِ شُرَکَآءَ الۡجِنَّ وَ خَلَقَهُمۡ وَ خَرَقُوۡا لَهٗ بَنِیۡنَ وَ بَنٰتٍۭ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ؕ سُبۡحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یَصِفُوۡنَ - بَدِیۡعُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اَنّٰی یَکُوۡنُ لَهٗ وَلَدٌ وَّ لَمۡ تَکُنۡ لَّهٗ صَاحِبَۃٌ ؕ وَ خَلَقَ کُلَّ شَیۡءٍ ۚ وَ هُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ
'আর লোকেরা জিনদেরকে আল্লাহর শরীক বানিয়েছে। অথচ তিনি তাদের স্রষ্টা। আর তারা না জেনে বুঝে তার জন্য পুত্ৰ-কণ্যা বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তারা যে সমস্ত কথা বলে তা থেকে তিনি মুক্ত ও পবিত্র এবং তার ঊর্ধ্বে তিনি অবস্থান করছেন। তিনি তো আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা। তাঁর পুত্র কেমন করে হতে পারে যখন তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই? তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন।' (সুরা আনআম : আয়াত ১০০-১০১)
৬. وَ قَالُوا اتَّخَذَ الرَّحۡمٰنُ وَلَدًا سُبۡحٰنَهٗ ؕ بَلۡ عِبَادٌ مُّکۡرَمُوۡنَ
'আর তারা বললো, দয়াময় আল্লাহ কাউকে পুত্ৰ বানিয়েছেন। তিনি পাক-পবিত্র। বরং (যাদেরকে এরা তাঁর সন্তান বলছে) তারা এমন সব বান্দা যাদেরকে মৰ্যদা দান করা হয়েছে।' (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ২৬)
যারা আল্লাহর জন্য সন্তান গ্রহণ করার কথা বলে, এ আয়াতগুলোতে সর্বতোভাবে তাদের এহেন আকিদা-বিশ্বাসের প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ আয়াতগুলো এবং এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য যে সব আয়াত কোরআনের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়, সেগুলো সূরা ইখলাসের অতি চমৎকার ব্যাখ্যা। তিনিই মহান আল্লাহ যিনি এসব কিছু থেকে পবিত্র।
আল্লাহ তাআলা মুহসিন বান্দার পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তারা যা চাইবে, তা-ই পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَهُمۡ مَّا یَشَآءُوۡنَ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ ؕ ذٰلِکَ جَزٰٓوٴُا الۡمُحۡسِنِیۡنَ
'তাদের জন্য তাদের রবের কাছে তা-ই রয়েছে যা তারা চাইবে। এটাই মুমিনদের পুরস্কার।' (সুরা যুমার : আয়াত ৩৪)
মহান আল্লাহ তাদের পাপগুলো মাফ করে দেবেন এবং তাদের মর্যাদাও বাড়িয়ে দেবেন। কেননা, প্রত্যেক মুসলিম আল্লাহর কাছে এটাই আশা রাখে। এ ছাড়া জান্নাতে যাওয়ার পর তো প্রত্যেক বাঞ্ছিত জিনিস পাওয়া যাবে।
মুহসিন বা একনিষ্ঠ বান্দা কারা?
আয়াতে مُحْسِنيْنَ এর একটি অর্থ হলো- যাঁরা নেক কাজ করেন।
দ্বিতীয় অর্থ হলো- যাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করেন। তাইতো হাদিসে ‘ইহসান’এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে কর যেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি এ রকম ভাব সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়, তবে এটা যেন অবশ্যই মনে করা হয় যে, তিনি তোমাকে দেখছেন।’
তৃতীয় অর্থ হলো- যাঁরা মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণ ও উত্তম ব্যবহার করেন।
চতুর্থ অর্থ হলো- যাঁরা প্রত্যেক নেক কাজকে সুন্দরভাবে বিনয়-নম্রতা এবং নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত অনুযায়ী সম্পাদন করেন। ইবাদতে আধিক্যের পরিবর্তে (যেটুকু করেন তাতে) সৌন্দর্যের খেয়াল রাখেন।
আল্লাহ তাআলাই মানুষকে সঠিক দেখান। তিনি ছাড়া কেউ মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে পারেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ مَنۡ یَّهۡدِ اللّٰهُ فَمَا لَهٗ مِنۡ مُّضِلٍّ ؕ اَلَیۡسَ اللّٰهُ بِعَزِیۡزٍ ذِی انۡتِقَامٍ
'আর যাকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেন তার জন্য কোনো পথভ্রষ্টকারী নেই; আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্ৰহণকারী নন?'
আজ মুসল্লিরা আল্লাহর রহমতের ওপর আস্থা রাখার প্রাণশক্তিও ফিরে পাবে। আল্লাহ মানুষকে রিজিক দেন আবার মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশও হয় না। কারণ আজ হাফেজে কোরআনগণ মহান রবের রিজিক দেওয়ার ও তার রহমতের সেসব আশার বাণী ঘোষণা করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اَوَ لَمۡ یَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ
'তারা কি জানে না, আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন রিয্ক প্রশস্ত করে দেন আর সঙ্কুচিত করে দেন? নিশ্চয় এতে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।' (সুরা যুমার : আয়াত ৫২)
রিজিকের প্রশস্ততা ও সংকীর্ণতার মধ্যেও আল্লাহর তাওহিদের প্রমাণ বিদ্যমান। অর্থাৎ, এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বজাহানে কেবল তাঁরই নির্দেশ ও কর্তৃত্ব চলে। তাঁরই পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কার্যকর ও প্রভাবশীল। এই জন্য তিনি যাকে চান তাকে প্রচুর ধন দিয়ে ধন্য করেন এবং যাকে চান তাকে অভাব-অনটনে নাজেহাল করেন।
তাঁর এই বিচার-বিবেচনায়, যা তাঁর সুকৌশল ও ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত; না কেউ তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে, আর না তাতে কোনো পরিবর্তন সাধন করতে পারে। তবে এই নিদর্শনাবলী কেবল ঈমানদারদের জন্যই ফলপ্রসূ হয়। কেননা, তারাই এগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে উপকৃত হয় এবং আল্লাহর ক্ষমা পেয়ে থাকেন।
قُلۡ یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّهٗ هُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ
'বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' (সুরা যুমার : আয়াত ৫৩)
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কিছু লোক ছিল, যারা অন্যায় হত্যা করেছিল এবং অনেক করেছিল। আরও কিছু লোক ছিল, যারা ব্যভিচার করেছিল এবং অনেক করেছিল। তারা এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আরজ করলো- আপনি যে ধর্মের দাওয়াত দেন, তা তো খুবই উত্তম, কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো- এই যে, আমরা অনেক জঘন্য গগনাহ করে ফেলেছি। আমরা যদি ইসলাম গ্রহণ করি, তবে আমাদের তওবা কবুল হবে কি? এর পরিপ্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয় ৷' (বুখারি, মুসলিম)
সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলা হয়েছে আল্লাহর রহমত পেতে দেরি করা মোটেই ঠিক হবে না। কারণ দেরি করে ফেললে ক্ষমা না ও হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন-
وَ اَنِیۡبُوۡۤا اِلٰی رَبِّکُمۡ وَ اَسۡلِمُوۡا لَهٗ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَکُمُ الۡعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنۡصَرُوۡنَ
'আর তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তোমাদের উপর আযাব আসার পূর্বেই তার কাছে আত্মসমর্পণ কর। তার (আযাব আসার) পরে তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না।' (সুরা যুমার : আয়াত ৫৪)
কেয়ামতের দিন কাফের ও মোশরেকদের টেনেহিঁচড়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে আর মুত্তাকিদের জান্নাতে প্রবেশের জন্য আহ্বান করা হবে। ফেরেশতারা তাদের অভ্যর্থনা জানাবেন, তাদের খেদমতে সালাম পেশ করবেন আর তারা আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে আপন নিবাস জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
আল্লাহ তাআলা নবিজীকে উদ্দেশ্য করে তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দেন এবং কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার আহ্বান জানান এভাবে-
بَلِ اللّٰهَ فَاعۡبُدۡ وَ کُنۡ مِّنَ الشّٰکِرِیۡنَ
'বরং আপনি আল্লাহরই ইবাদাত করুন এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হোন।' (সুরা যুমার : আয়াত ৬৬)
আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমতার পরিচয়
পুরো জগত থাকবে মহান আল্লাহর হাতের মুষ্টিতে। অথচ অবিশ্বাসীরা আল্লাহকে মর্যাদা দেয়নি। আল্লাহ বলেন-
وَ مَا قَدَرُوا اللّٰهَ حَقَّ قَدۡرِهٖ ٭ۖ وَ الۡاَرۡضُ جَمِیۡعًا قَبۡضَتُهٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ السَّمٰوٰتُ مَطۡوِیّٰتٌۢ بِیَمِیۡنِهٖ ؕ سُبۡحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ
'আর তারা আল্লাহকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। অথচ কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তাঁর মুষ্টিতে এবং আকাশসমূহ তাঁর ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। তিনি পবিত্র, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের ঊর্ধ্বে।' (সুরা যুমার : আয়াত ৬৭)
কেয়ামতের দিন পৃথিবী আল্লাহর মুঠোতে থাকবে এবং আকাশ ভাঁজ করা অবস্থায় তার ডান হাতে থাকবে। আলেমগণের মতে আক্ষরিক অর্থেই এমনটি হবে। যার স্বরূপ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। এ আয়াতের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলার ‘মুঠি’ ও ‘ডান হাত’ আছে। এ দুটি আল্লাহর অন্যান্য গুণাগুণের মতোই দুটি গুণ।
জমিন আল্লাহ তাআলার হাতের মুঠিতে থাকা এবং আসমান ডান হাতে পেচানো থাকার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সঠিক মর্যাদা, বড়ত্ব ও সম্মান সম্পর্কে মানুষকে কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে।
কেয়ামতের দিন সব মানুষ (যারা আজ আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্বের অনুমান করতেও অক্ষম) নিজ চোখে দেখতে পাবে জমিন ও আসমান আল্লাহর হাতে একটা নগণ্যতম বল ও ছোট একটি রুমালের মত। হাদিসে এসেছে, একবার নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে উঠে খুতবা দিচ্ছিলেন। খুতবা দানের সময় তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন এবং বললেন-
'আল্লাহ তাআলা আসমান ও জমিনকে (অর্থাৎ গ্রহসমূহকে) তাঁর মুষ্ঠির মধ্যে নিয়ে এমনভাবে ঘুরাবেন যেমন শিশুরা বল ঘুরিয়ে থাকে এবং বলবেন- আমি একমাত্র আল্লাহ। আমি বাদশাহ। আমি সর্বশক্তিমান। আমি বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের মালিক। কোথায় পৃথিবীর বাদশাহ? কোথায় শক্তিমানরা? কোথায় অহংকারীরা? এভাবে বলতে বলতে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে কাঁপতে থাকলেন যে, তিনি মিম্বারসহ পড়ে না যান আমাদের সে ভয় হতে লাগলো।' (মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে, ইহুদি এক আলেম এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, 'হে মুহাম্মদ! আমরা আমাদের কিতাবে পাই যে, আল্লাহ তাআলা আসমানসমূহকে এক আঙ্গুলে রাখবেন, জমিনসমূহকে অপর আঙ্গুলে রাখবেন, গাছ-গাছালিকে এক আঙ্গুলে রাখবেন, পানি ও মাটিকে এক আঙ্গুলে রাখবেন আর সমস্ত সৃষ্টিকে অপর আঙ্গুলে রাখবেন, তারপর বলবেন- আমিই বাদশাহ! তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ইহুদি আলেমের বক্তব্যের সমর্থনে এমনভাবে হাসলেন যে, তার মাড়ির দাঁত পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন।' (বুখারি)
অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা জমিনকে মুষ্ঠিবদ্ধ করবেন। আর আসমানসমূহকে ডানহাতে গুটিয়ে রাখবেন তারপর বলবেন; আমিই বাদশাহ! কোথায় দুনিয়ার বাদশাহরা?ক' (বুখারি)
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, 'আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কেয়ামতের দিন সব জমিন থাকবে তাঁর হাতের মুঠিতে এবং আসমানসমূহ থাকবে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে।' সেদিন ঈমানদারগণ কোথায় থাকবে? তিনি বললেন- হে আয়েশা! সিরাতের (পুলসিরাতের) উপরে থাকবে।' (তিরমিজি)
সর্বশেষ আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিবসে বান্দাদের মধ্যে ন্যায় বিচারভিত্তিক ফয়সালা করবেন। যাতে আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য এবং গুণাবলী সন্নিবেশিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন-
وَ تَرَی الۡمَلٰٓئِکَۃَ حَآفِّیۡنَ مِنۡ حَوۡلِ الۡعَرۡشِ یُسَبِّحُوۡنَ بِحَمۡدِ رَبِّهِمۡ ۚ وَ قُضِیَ بَیۡنَهُمۡ بِالۡحَقِّ وَ قِیۡلَ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
‘আর আপনি ফেরেশতাদেরকে দেখতে পাবেন যে, তারা আরশের চারপাশে ঘিরে তাদের রবের সপ্ৰশংস পবিত্ৰতা ও মহিমা ঘোষণা করছে। আর তাদের মধ্যে বিচার করা হবে ন্যায়ের সাথে এবং বলা হবে, সকল প্ৰশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর প্রাপ্য।‘ (সুরা যুমার : আয়াত ৭৫)
সুরা মুমিন : আয়াত ০১-৮৫
সুরাটি মক্কায় নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা শুরুতেই তাঁর অসাধারণ গুণাবলী দিয়ে সুরাটি আরম্ভ করেছেন যে, তিনি পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী, গোনাহ মার্জনাকারী, তাওবা কবুলকারী, অবাধ্য বিদ্রোহীদের কঠোর শাস্তি প্রদানকারী। তিনি অনন্ত অসীম ক্ষমতাবান। তাঁর কানো শরীক নাই। তিনি একমাত্র উপাস্য। সমগ্র মানব জাতীকে পরিশেষে তাঁর নিকটই প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ এ সুরায়ও তাওহিদ বা একত্ববাদের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা তিনটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন-
১. তাওহিদ তথা একত্ববাদ সম্পর্কে
তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই; তাওহিদের বর্ণনা কোথাও দলিল-প্রমাণ সাব্যস্ত করেছেন; আবার কোথাও তাঁর আদেশ প্রদান করেছেন। এমনি ভাবে কুফর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছেন। সর্বোপরি এ সুরায় তাওহিদের ধারক ও বাহকদের প্রশংসা ও সুসংবাদ রয়েছে এ সুরায়।
২. দুনিয়ায় বিবাদ সৃষ্টিকারীদের ধমকি প্রদান
সত্যের ব্যাপারে এ বিবাদ সৃষ্টিকারীরা ব্যাপক, যারা বিশ্বনবিকে অস্বীকার করতেন। এ কারণে তাদেরকে ইহকালীন লাঞ্ছনা ও পরকালীন কঠোর শাস্তির ধমকি প্রদান করা হয়েছে।
৩. বিশ্বনবিকে সান্ত্বনা প্রদান
মক্কার কাফের মুশরিক কর্তৃক বিশ্বনবি যখন নানান লাঞ্ছনা-প্রবঞ্চনা, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, অপপ্রচার এমনকি জীবন নাশের ব্যর্থ পরিকল্পনার সময় বিচলিত ঠিক তখনই আল্লাহ তাআলা তাঁর অসহায়ত্ববোধকে দূরীকরণ এবং স্বীয় মিশন পরিচালনায় অটল এবং অবিচল থাকার জন্য এ সুরার মাধ্যমেই সান্ত্বনা প্রদান করেন। তাই এ সুরায় স্থান পায় হজরত মুসা ও মরদুদ ফিরাউনের মধ্যকার ঘটনা।
সুরা হা-মিম আস-সাজদা : আয়াত ১-৪৬
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরাটি সিজদা, হা-মিম আস-সিজদা, মাসাবিহ ও ফুসসিলাত নামে পরিচিত। এ সুরায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতের বর্ণনার পাশাপাশি মৃত্যুর পর মানুষের যে জীবন আসবে, সে সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে।
তাই যারা বিশ্বনবির প্রতি ঈমান আনয়নে অনীহা প্রকাশ করে এবং তার বিরোধীতা করে, তাদের উদ্দেশ্যে কঠোর সতর্কবানীও উচ্চারিত হয়েছে এ সুরায়।
এ সুরার ৩০-৩১ আয়াতে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন কাফেরদের কী অবস্থা হবে, তার বিবরণ শেষে মোমিন বান্দাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তারা একবার মনেপ্রাণে আল্লাহকে রব বলে মেনে নিলে আমরণ এ বিশ্বাসের ওপর অটুট-অবিচল থাকে। মৃত্যুর সময় এবং কেয়ামতের দিন ফেরেশতারা তাদের বলবেন, ভয় পেও না, জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো। দুনিয়া ও আখেরাতে আমরা হলাম তোমাদের বন্ধু। জান্নাত তোমাদের জন্য, তোমাদের মন যা চায়, এমন সবকিছুই আছে সেখানে।’
সুরার শেষাংশে আল্লাহ তাআলার ন্যায়ানুগ ফয়সালার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘যে নেক আমল করবে, সে নিজের কল্যাণের জন্যই করবে। আর যে মন্দকাজ করবে তার প্রতিফল সে নিজেই ভোগ করবে। তোমার প্রতিপালক বান্দাদের প্রতি মোটেই জুলুম করেন না।’ (সুরা হা-মিম আস-সাজদাহ : আয়াত ৪৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরাগুলো বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম