সাহিত্য

ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম: কবিতার পরিশীলিত অন্তঃস্বর

আল মাকসুদ

Advertisement

পাঠই কবিতার শেষ কথা নয় যদি কিছু অনুভূতি ব্যক্ত না হয়। হোক তা সরল, তীব্র, কটু, আক্রমণাত্মক; কিন্তু তা আবশ্যক কাব্য আলোচনায়। কাব্যের লাক্ষণিক বিষয়সমূহকে চিহ্নিত করা যায় পাঠানুভূতির ওই পাদভূমিতে দাঁড়িয়েই। কথা হচ্ছে―কবিতার তত্ত্বাদর্শ ও পরিচিন্তন কবির নিজের। কবিতা মেটাফোর নির্ভর হলে একরকম হয়। শুধু গদ্যায়নের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ হলে তার রূপ অন্যরকম। ছন্দের মাপকাঠিতে কবিতার আজকাল আর বিচার হয় না। কারণ হলো এতে কবির স্বতঃস্ফূর্ত গতিকে অকারণ বাধাগ্রস্ত করা হয়। চিত্তের অদম্য সংরাগ অথবা ক্ষোভ মানুষকে কবি করে তোলে। তখন কবি না হয়ে আর উপায় থাকে না হয়তো। এ-ধারার কবিরা জীবন ও বাস্তবতার নৈঃসঙ্গ্য নির্মমতাকে উপলব্ধি করেন গভীরভাবে। কবিতার বিকাশ আছে, পরিণতি নেই; কিন্তু অবশ্যই কবিতা রূপান্তরপ্রবণ। পরিণতি নেই এই অর্থে কবিতা সবসময়ই ঘোর তৈরি করে―মায়াও তৈরি করে; বিপ্লবী বানায়, কেউ কেউ হয়ে ওঠেন দ্রোহী, কেউ প্রেমিক। কেউ আবার নীরব পাঠক―কিছুই বলেন না এরা। সুতরাং পরিণতিটা কী হবে আগে থেকে বলা কঠিন। কবিতায় অন্তত পরিণতির কথা না ভাবাই ভালো। কবিতা কতটুকু মিশে থাকে অন্তরে অন্দরে তার খোঁজ নিতে গেলে পাঠকের হৃদয়ের খোঁজ নেওয়া আবশ্যক। একজন কবি কার দিকে তাকিয়ে থাকেন? পাঠকের চোখের দিকে কি? কবির দায় নেই যদিও কারো দিকে তাকানোর; কিন্তু কবির সৃষ্টিপুতুলকে নেড়েচেড়ে দেখবেন তো ওই পাঠকই। অতএব তার চোখের দিকে না তাকিয়ে উপায় আছে কি? এ-প্রসঙ্গে উৎপলকুমার বসুর একটি কথা মনে আসে ভীষণ: ‘কবিতা, পাঠক এবং কবির মধ্যে এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী পদ্ধতি’। মজিদ মাহমুদ অবশ্য নিজেকে কবি না বলে ‘বকি’ বলতে চান। তার ‘কাব্য’ মূলত দীর্ঘ বাক্যের সমষ্টি। মানে বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে। এই উলটপালট কেন? এর নেপথ্য সত্যিটা হচ্ছে―কবি মজিদ মাহমুদ কবি হতে চান বকবক করে হলেও, কারণ ‘গুরুর সিলসিলা’ চালু রাখার প্রয়াস। আর কাব্যকে বাক্য বলতে আগ্রহবোধ করেন ভাষাবিজ্ঞানের পাঠ থেকে। চমস্কির মতো: ‘শব্দ ফুরিয়ে গেলেও বাক্য ফুরায় না’। এই বাক্য সন্দেহাতীতভাবে কাব্যই।

কবি কিছু বিষয়ে অভ্যাসী হয়ে ওঠেন সচেতনভাবে। তিনি শব্দকে ভাঙেন; নতুন শব্দ তৈরি করেন। শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে হয়তো একটা কিছু দাঁড় করান―এবং তার একটি অবয়বও দৃশ্যমান হয়। নির্মাতা খুশি হন। প্রচল ভুবন থেকে অপ্রচলের দিকে যাত্রা তার। কিন্তু তিনি থাকেন মানুষের সঙ্গেই। এই মানুষেরাই কবিতার মিউজ। কথায়নের মাঝে বিচিত্র শব্দের খোয়াবনামায় থাকে শব্দের নব ব্যাখ্যা―যা ছিলো না আগে কখনো। যেন এই প্রথম ভূমিষ্ঠ হলো। শব্দটা পুরোনো। কিন্তু তার অর্থ ওই খোয়াবনামায় নতুন করে চিত্রিত হয়েছে। মন্ময় চিন্তা, মানবিক উদ্ভাসন―জীবনবোধের গরলতাকে নিঃশেষ করে অমৃতের সন্ধান করে। অমৃতের সন্ধান মেলে যতটা কবিতায় ততটা আর নেই কোথাও। কবিতাশিল্প এখানে অপরাজেয় মিথ।

কবি মজিদ মাহমুদ অপরাজেয় মিথের গল্প বলেছেন ‘ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম’ কবিতাগ্রন্থে। পাল্টে যাওয়া পৃথিবীর অনুকূলে দাঁড়িয়েই তার এই রচনা। এমন নয় তিনি বিরূপ বিশ্বের মহা চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে কথা বলছেন। কথা বলছেন তার সৃষ্টিবেদনার নির্যাসকে সামনে রেখেই। এতে সুবিধাটা হয়েছে কবিতাগুলো পাঠ করতে গিয়ে পাঠক নিজের প্রতিবেশের দিকে একবার নজর দিতে পারেন। ধাত্রী ক্লিনিকের জন্মের ইতিহাস সম্পর্কে কবি নিজেই বলেন: [...] তবু নদীতে গড়িয়ে পড়া সন্তানদের/ নিরাপত্তার কথা ভেবে মা’রা কিছুটা উদ্বিগ্ন/ এসব ভয় ও উদ্বেগ থেকে গড়ে উঠেছে/ অসংখ্য ক্লিনিক ও মাতৃসদন’ (কাব্যসমুচ্চয়: মজিদ মাহমুদ, ২০১৯, পৃ-১১৯)। ভয় ও উদ্বেগ থেকে ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম হয়েছে। কিন্তু যে শিশু একদিন বয়োবৃদ্ধ হলো, ঘনিয়ে এলো মৃত্যু এবং মৃত্যুও হলো―তখন সে একা। না আছে নার্স, না আছে গাইনি―কেউ নেই তার পাশে। কবি ক্লিনিকের বাস্তবতার সঙ্গে মৃত্যুর ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন। কিন্তু মৃত্যুর পাশে ক্লিনিক নেই। মৃত্যু তো অবধারিত একা এক অনিশ্চিত অনন্ত ভ্রমণ। জানে না কেউ, তিনি কোথায় কতদিন অব্দি যাবেন। কবির সচকিত উচ্চারণ: ‘কবরের পাশে তো একটিও ক্লিনিক নেই/ অথচ সংখ্যা ও অনিবার্যতায় শিশুদের চেয়ে/ ঢের প্রয়োজন ছিল’। (প্রাগুক্ত, পৃ-১২০)।

Advertisement

কিছু কবিতা থাকে যা পাঠ করে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া নির্ণীত হয়। প্রতিক্রিয়াসমূহ খাপছাড়া হতে পারে। অনেকগুলো বিষয় জড়ো হয়। আবার বেরিয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মোহ তৈরি করে। মোহ ভেঙে যায়। ফিরে পেতে চায় সময়ের কিছু কিছু অভিন্ন মুহূর্ত। পারে না। এবং খুব অসাহায়বোধ করে আত্মনাভূতি। কবিও তথৈবচ। পড়ে থাকে স্মৃতির খোলামকুচি। ভাঙাচোরা আদর্শের কথা বলে বলে ফেনা তুলেন কেউ কেউ। পরক্ষণেই নিভে যায় আলো। কেন? কারণ মানুষ ভাবকাতর; তার চেয়েও বেশি স্বার্থকাতর। কিছুই টেকে না স্বার্থের কাছে। না রাজনীতি, না আদর্শ। আর সমকালীন বাস্তবতায় কবি যখন দেখেন সংশয়াচ্ছন্ন এ ভূমিতে, এ স্বদেশে ডুবে যায় কাঙ্ক্ষিত সমবেত অসংখ্য সত্য। তখন তার ভেতরের করোটি মিথ্যা বলে না। বলে ভিন্ন কিছু। সেটি আবার সত্যও নয়। সেটি সত্যের মতো কিছু। বাস্তবতার মতো কিছু। এবং গ্রাহ্য করার মতো কিছু। যেমন:

ক.[...] সবাই বলবে, সত্যের জন্য লড়াই করোকিন্তু তোমার কি দায় পড়েছেসত্য কাকে বলে কেউ জানে না এখানে সত্য বহুরূপীসত্য প্রতারক (প্রাগুক্ত, পৃ-১২৮)।

খ.তবু মার্কসবাদ মানেই শ্রমিক অসন্তোষমালিকরা মন খুলে হাসতে পারে নামাকর্সবাদ মানে অলাভজনক পাটকলগুলো বন্ধ না হওয়াআইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন খায়েশ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ামার্কসবাদ মানেই মরার আগে অন্তত হাত উত্তোলন করা। (প্রাগুক্ত, পৃ-১৩৬)।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দিয়েছে স্বদেশ। আর কী কী দিয়েছে, জানি কি? মুক্তির প্রশ্নে যাঁরা সংশপ্তক ছিলেন তাঁরা কেমন আছেন? উত্তরটা হবে আছেন তো ভালোই। ভাতা পাচ্ছেন; সঙ্গে আছে বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে সংবর্ধনা। মাতামাতি। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার পঙ্গুত্বও কতটা মহত্ত্বকে বহন করতে পারে তা অনুভব করেছেন মজিদ মাহমুদ কবির চোখে। কবির তৃতীয় চোখ যতটুকু দেখে, তার চেয়ে অধিক উপলব্ধি করে। অন্যের ভেতরেও জাগিয়ে দেয় উপলব্ধির সম্ভ্রম, আত্মবিশ্বাস। নির্মাণ করে জেগে ওঠার, স্বপ্ন দেখার ভিন্ন পটভূমি। ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে চোখ সরিয়ে একজন কবিই পারেন একজন পাঠককে স্পর্ধিত সত্যের মুখোমুখি করতে। সেখানে ভণ্ডামি নেই; বরং নিরেট নৈষ্ঠিকতা আর বিশ্বাসের স্ফূলিঙ্গ খেলা করে সেখানে। তাই লক্ষ করি, যুদ্ধে একটি পা হারিয়ে ফেলা মুক্তিযোদ্ধা অনন্য হয়ে ওঠেন মজিদ মাহমুদের কবিতায় এভাবে: [...] আমাদের স্বাধীনতা তার একটি পা নিয়েছে/ বর্তমানে সে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা [...] ভাবি, মানুষকে চলতে গেলে/ সামনে এগুতে গেলে তো/ এক পায়ের ওপর দাঁড়াতে হয়/ অন্য পা তো সব সময় উপরে উঠে থাকে/ দু’পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ এগুতে পারে না/ দু’পায়ে ভর দেয়া মানুষ কোথাও যেতে পারে না/ মুক্তিযোদ্ধাকে তো অনেক দূর যেতে হবে। (প্রাগুক্ত, পৃ-১২৭)।

Advertisement

‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবি’...’ কাজী নজরুল ইসলামের এ পঙক্তিতে এ-কথা খুবই স্পষ্ট কবির কাজ ভবিষ্যৎকে নির্দেশ করা নয়। ভবিষ্যৎ দেখার জন্য ‘নবি’র বাণী আছে। কিন্তু নবি তো আর আসবেন না। কবি আসবেন যুগে যুগেই। কবির বাণীতেও থাকে সত্যেরই উচ্চারণ। কবি মিথ্যাকেও সত্যের মতো উপস্থাপন করতে পারেন―এ-ও সত্য; নবি ও কবির বিশাল ফারাক এখানে, কারণ নবি কখনো মিথ্যা বলেন না। প্রয়োজনও হয়নি। কবির প্রয়োজন হয় মিথ্যা বলার―তাই বলে কবি মিথ্যাবাদী নন। নজরুলীয় এ-উচ্চারণে আর-একটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো―কবি হিসেবে বর্তমানের দাবি করা, আর ভবিষ্যতের ‘নবি’ না হওয়ার মাঝে অসাধারণ বিনয়; মানে আমি কবিই, নবি নই। তবে কবিরও কাজ আছে কিন্তু তা নবির তুল্য নয় কখনোই। তাতে কোনো সংশয় নেই। এ-ধরনের চিন্তার উৎকর্ষ কবির স্যানিটিকে দারুণভাবে প্রকটিত করে। মজিদ মাহমুদ এ স্যানিটিকে মান্য করেন; বিশ্বাসও করেন। এর ফল প্রত্যক্ষ করি তার ‘দোজখে এক আলেমকে দেখার পর’ কবিতায়। কবিও নরকে, আলেমও নরকে। বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেননি কবি। কবি হিসেবে তার নিজের নরকবাসে কোনো ক্ষোভ নেই। ওখানে আছেন ইমরুল কায়েস, র্যাবো, বোদলেয়ার। লিখছেন কবিতা ওখানে বসেও। প্রসঙ্গ সেই নারী, মদ, সিফলিস এসব বিষয়ই―যা দুনিয়াতেও ছিলো তাদের কবিতা লেখার উপকরণ। ঈশ্বরের প্রতি রাগও হচ্ছিল ওই আলেম বেচারাকে দোজখে শাস্তি পেতে দেখে। এই মুহূর্তটিকে মজিদ মাহমুদ বর্ণনা করেন এভাবে:ঈশ্বর বলেন, শোন তবে মন দিয়ে, কবি তোমরা ছিলে দিকভ্রান্ত নবীআমার থাকা না থাকার করোনি তোয়াক্কা, ছিলে আপন সত্ত্বার গানেমশগুল, আপন খেয়ালের বশে রচেছ আপনার বাণীআর এই আলেম আমার কথা বলতো তার নিজ প্রয়োজনেপাকস্থলি তার প্রকৃত কাব্য; পরকাল মানেই সত্যের উন্মোচন। (প্রাগুক্ত, পৃ-১৩৫)।বোঝা যায় নবি ও কবির পার্থক্য। সেই সঙ্গে পার্থক্য তৈরি করেছেন একজন কবির সঙ্গে আলেমেরও। হ্যাঁ, এই আলেম নিশ্চয়ই সে-ধরনের আলেম যিনি আত্মমুক্তির খাতিরে অপরের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিতে অধিক তৎপর ছিলেন। সর্বজনীন মুক্তিতে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। অপরদিকে কবি কারোরই মুক্তির কথা বলেননি; না নিজের, না অপরের। কবির দোষ একটাই ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপনে সন্দিহান। কিন্তু তারা পরোপকারী; সর্বমানবিক, সৌন্দর্যের প্রতি মোহগ্রস্ত। তারা এক পৃথিবীর মানুষ। তাই ঈশ্বরের মূল্যায়ন ‘তোমরা ছিলে দিকভ্রান্ত নবী’।

কবির ক্রোধ সাধারণের ক্রোধ থেকে আলাদা। কবি যেভাবে ভাবেন, সাধারণে সেভাবে ভাবেন না―কারণটা মূলত এখানেই। ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় কবি মজিদ মাহমুদ তার ব্যক্তিক বিষণ্নতাকে ক্রোধের আকারে উপস্থাপন করেছেন। সেটি অবশ্য শেষ অব্দি হয়ে উঠেছে প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের ক্রোধের স্বরূপ। দেশকে ভালোবাসলেই হয় না ধারণও করতে হয়। ধারণ না করলে কোনো আত্মিকতা নির্মিত হয় না। এবং জানতে হয় দেশের অতীত ঐতিহ্যধারা। যেমন কবি বলেন:বিদেশের অভিজ্ঞতা আমার বড় খারাপ। সরাক্ষণ মন ভার হয়ে থাকে।তোমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। তারা জিজ্ঞেস করে আমি কোথা থেকে এসেছি। আমি পরম মমতায় আমার দেশের নাম বলি। বলি বাংলাদেশ। তারা বলে ও! ইন্ডিয়া? আমি দুঃখ পাই। কাতর অননুয় ও বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়েনিই। মনে মনে কসে গাল দিই। বলি গাধার বাচ্চা! [...]অথচ ৪শ বছর আগেও ফাঁসোয়া বার্নিয়ার জানতেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ হলো বাংলাদেশ। (প্রাগুক্ত, পৃ-১৫০)।

উপলব্ধির হিমালয় এসে কবিকে কখনো বুক চেপে ধরে। কবি তখন কেবলই মানুষ নন; সংবেদনশীল মানুষ। কোনো কোনো মানুষের ভেতরে বাস করে পরমাত্মা। পরমাত্মার অবয়ব নেই। আছে তাকে নিয়ে ধ্যান। সাধনার চরমে পৌঁছে কেউ কেউ হয়ে ওঠেন মনসুর হাল্লাজ। বিশ্বাসের চোখ ও মন অভিন্ন হতে হয়। তা না হলে অধ্যাত্মবোধের মরমি সুখলাভ অধরা থেকে যায়। তত্ত্ব দিয়ে বিজ্ঞান দিয়ে পরমাত্মার দর্শনলাভও সম্ভব হয় না। নিগূঢ় বিশ্বাসটাই মুখ্য। চেতনার গভীরে থাকে আত্মার সংশুদ্ধি। নন্দনবিভা থাকে―তবে তা মরমি; বৈষয়িক নয়। কবি মজিদ মাহমুদ কখনো কখনো সে পথ মাড়াতে চেয়েছেন। সে পথ যে কণ্টকাকীর্ণ, প্রশ্নবিদ্ধ, সন্ধিগ্ধ তা তার অজ্ঞাত নয়। দ্বিধান্বিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন স্রষ্টা সকাশে―‘আজ মনে হয়, তুমিও ব্যস্ত নিত্য নতুন পুতুল বানাতে,/ আর তোমার পুতুলের সমঝদার/ হয়ে যাই পুতুল পূজক...’। তবুও আপনগণ্ডিকে অতিক্রম করে কিছু একটা করার আয়াস মজিদ মাহমুদের ভেতরে লক্ষ্য করা যায়। এমতো আয়াস তৈরি হয় বিশ্বাসের কেন্দ্র থেকে। তিনি নিশ্চয়ই অবিশ্বাসী নন। বিশ্বাসী সত্তার মাঝেও অসংখ্য দ্বিধা থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বাসী মানুষের পক্ষেও নির্দ্বিধ অটল থাকা সম্ভব হয়নি, ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে/ সরল জীবনে!’ এমন কথা তা-ই প্রমাণ করে। মজিদ মাহমুদের ব্যক্তিচিত্তের বিশ্বাসের দর্শনবিন্দুকে স্পর্শ করতে দুটি কবিতার কিছু পঙক্তির শরণ নিতে চাই:

ক.তুমি থাকো না কাছে, দাওনি দেখার ক্ষমতাসবাই জানে, তুমি আছ, খুব কাছাকাছিতোমার নিঃশ্বাসের দাগ লেগে আছে আমার শিরোদেশেচতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে মোথিত আত্মার গানমসজিদ থেকে আজান হাঁকে, নামাজের জন্য এসোছুটে যাই; নামাজ মানে তো তোমার দিদাররাত জেগে বসে থাকি, তাহাজ্জত পড়িতোমাকে দেখতে চাই, পারি নানা দেখার বিরহে কেঁদে উঠি, ঈমাম সান্ত্বনা দেয়চর্মচক্ষে তুমি দাও না ধরা, নিরাকার তোমার ভূষণমুমিনের দিলে তোমার বাস (প্রাগুক্ত, পৃ-১৫৫)।

খ.কিন্তু আজ কবরে শুইয়ে দেয়ার পর সব নিরর্থ মনে হচ্ছেকারণ এখানে শুইয়ে সব দেখতে পাচ্ছিআগে যা দেখা হয়নি সেগুলোও[...] হাড্ডির সঙ্গে মাংস না থাকায় সারা শরীর দিয়েই হাসতে পারছিজীবিতরা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সামান্যই হাসতে পারেপ্রথম অনেকদিন হেসেছি বেঁচে থাকার বোকামির জন্যসবকিছু দেখার তড়িঘড়ির জন্যএখন হাসছি সব দেখার কি অফুরন্ত সময়! (প্রাগুক্ত, পৃ-১২৪)।এ কবিতা দুটির পঙক্তিনিচয়ে স্পষ্ট হয় মানববিভার স্বচৈতন্য। দার্শনিক রেখাও ইতিউতি করে। মানুষ কি তাহলে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে মৃত্যুর অসীমতাকে অনুভব না করেই? প্রশ্ন জাগে। মৃত্যু অনন্ত জীবনের সন্ধান দেয়। মৃত্যু হাসবার অফুরান বিলাস দেয়। অসাধারণ কিছু ভাবনার ঊর্ণজাল জীবনকে আঁকড়ে ধরে মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই।

কবি মজিদ মাহমুদ রাজনীতি সচেতন। রাজনীতি করেন না কিন্তু। কারো পোঁ ধরাও তার ধাতে নেই হয়তো। আত্মবিশ্বাসের অতলতাকে মর্যাদা দেন। তাই বাংলাদেশকে বিদেশি প্রেতেরা ইন্ডিয়া বললে ক্ষেপে যান। ভালোবাসেন শহরের চেয়ে গ্রামকেই। গ্রাম মানে তো স্বদেশ। শহরও ওই উপনিবেশকতার পরিণাম। তাবৎ শহরই মিথ্যে বড়াই আর পুঁজির অন্ধ বিনোয়াগ দিয়ে নির্মিত। সেখানে যা আছে তা গ্রামকে গ্রাস করার নতুন নতুন বিমানবিক কৌশল; যেমন―‘কিন্তু পৃথিবীর সব শহর ও এক অভিন্ন/ তার রূপ ও আত্মা, মুখ ও মুখোশ একই কোম্পানির তৈরি/ প্রতিটি শহর হত্যাকারী, গ্রাম ও গাছ,/ তিনপুরুষের ভিটা ও স্মৃতি হত্যা করে শহর গড়ে ওঠে’। (প্রাগুক্ত, পৃ-১৩০)। অথচ আমরা ভুলতে পারি না উপনিবেশিকতাকে। কারণ আমরা তো দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা ঔপনিবেশিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে আমরা আমাদের সৌন্দর্যবোধকেও পরাশ্রয়ী করে তুলেছি। যেন নিজের বলে কিছু নেই। দোষটা ওই রাজনীতির। এবং এশিয়া জুড়েই রয়েছে এ গ্লানির ছাপ। তাই পরিশ্রমী কাক পাখিকে কুৎসিত বলি। চাঁদকে বলি সুন্দর ভীষণ। আমরা এ-সব বলি; নিজের অজান্তে অথবা এ-ধরনের বিশ্বাসের পাঠই আমরা নিয়েছি চিরকাল―আমাদের প্রভুদের থেকে। এ-জন্যই কবির এমন স্যাটায়ারধর্মী উচ্চারণ ‘কাক’ শিরোনামের এ কবিতায়:এশিয়ার লোকেরা কাককে কুৎসিত আর চাঁদকে সুুন্দর বলেহয়তো তারা নিজেরা কালো আর চাঁদ অন্য কোনো উপনিবেশউপনিবেশ মানে পরান্নভোজী, যার নিজের আলো নেইযার শরীর এবড়ো-থেবড়ো, দগদগে ঘাতবু উপনিবেশ বেঁচে থাকে গল্পে; আর কাকপরিশ্রমী, সংঘবদ্ধ; নোঙরা আবর্জনা দেখলেই খেয়ে ফেলেকারণ, পৃথিবীকে তারা পরিচ্ছন্ন রাখতে চায়। (প্রাগুক্ত, পৃ-১২৫)।পৃথিবীকে মারিমুক্ত করতে, শান্তি ও স্বস্তির করতে এশিয়ার মানুষের অবদান বেশি। পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। শ্বেত চামড়ার ইউরোপীয়ানরা সব সময়ই চেয়েছে অন্যের ভূমি দখল করে কীভাবে প্রভুত্ব কায়েম করা যায়। তাদের সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বপরায়ণ চিন্তাকে আমরা কখনো বুঝে কখনো না বুঝে মেনে নিয়েছি। এখনো নিই―আমাদের স্বার্থে। আমরা পরান্নভোজী হয়ে থাকতেই ভালোবাসি। প্রতীচ্য ডাক দিলে প্রাচ্যের কথা বেমালুম ভুলে যাই। ঘরদোর ফেলে দিই দৌড়। সেখানে জীবন অনেক ঊর্ধ্বগামী। ওই জীবনের স্পর্শ পেতে উপনিবেশিকতা ভুলে থাকতেও দ্বিধা হয় না আমাদের।

একটি কাব্যে বিভিন্ন প্রকৃতির কবিতার স্থান হয়। একই মোটিফের কবিতা দিয়ে কাব্য লেখা হয় না। তবে বেশি সংখ্যক কবিতার সুরটাই ওই কবিতাগ্রন্থের অকৃত্রিম পরিচয়। ‘ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম’ যেভাবে তিনি শুরু করেছিলেন সেভাবে তিনি শেষ করেননি। কবিতার আঙ্গিক বিবেচনায় কিছু কবিতা মজিদ মাহমুদকেই পরিচয় করিয়ে দেয়। এটি কবির জন্য সুখকর। কবিতার প্রকরণশৈলী নিয়ে তর্ক হতে পারে। তাতে লাভ আছে কবি এবং পাঠকের। সমালোচক যেন একদিকে পাল্লা ভারী করে একরৈখিক লেখা না লেখেন সেই সাবধানবাণীও ওখানে সন্নিহিত। পুরো কাব্যে কবি সাধারণ থাকতে চেয়েছেন। সাধারণের একটি অমূল্য রূপ আছে―তা আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলে এই কাব্যের কবিতা পাঠ করে আনন্দলাভ অসম্ভব হবে। একই সঙ্গে আছে বিষয়ভাবনার নতুনত্ব অনেকগুলো কবিতাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে চমৎকার। বলা আবশ্যক―‘যাত্রার প্রথম গান’, ‘এখন দার্শনিক কবিতা লেখার সময়’, ‘কানা রফিকুল আমার ভাই’, ‘যুদ্ধ শেষে’, ‘ঘোড়া বিষয়ক এলিজি’, ‘আইন’, ‘আমার গুরু দ্রোণাচার্য’, ‘আগুন ও ইস্পাত দণ্ড’, ‘আমার কলম’, ‘ডাক্তার’―কেবল এই শিরোনামের কবিতাগুলো নিয়েই স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব।

কবিতা শেষ বিচারে মুগ্ধতাকেই প্রমোট করে। তখন মনে পড়তে পারে ‘সমস্তীপুর’ কবিতার এই লাইনগুলো: [...] আমিই কি বয়ে এনেছি তোমাদের পল্লীতে অশুভ বার্তা?/ আগুনের ক্ষেতের ওপর বসিয়ে দিয়ে কি ভয়ঙ্কর আনন্দের মাতম অন্তরালে ছড়িয়ে দিচ্ছ। আমি/ আর বলব না রাত্রির শরীরের মধ্যে সূর্যের আলোর কুচি ছড়িয়ে পড়ার আগে/ এক ঝাঁক কাক তোমাদের জাগিয়ে তুলেছিল। জেগে উঠে তোমরা দেখলে/ আলোর মধ্যে তোমাদের ভবিষ্যৎ উন্মোচন করে আমিই দাঁড়িয়ে আছি। [...] (প্রাগুক্ত, পৃ-১৪৯)।

এসইউ/এমএস