রাশেক রহমান ও শেখ ফয়সল
Advertisement
দূর হোক ‘সর্ব অকল্যাণ পীড়ন অশান্তি’দূর হোক ‘সর্ব অপৌরুষ মিথ্যা ও ভ্রান্তি’
অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের ' অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল' (ওএফএসি) বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড একশন ব্যাটিলিয়ন (র্যাব)-এর সাবেক ও বর্তমান সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র-ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণভাবে অভিযোগসাপেক্ষ। এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে প্রমাণসাপেক্ষ অথবা তদন্তসাপেক্ষ কোন দলিল বা যুক্তি নেই। পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আমাদের সবসময় প্রত্যাশা থাকে যুক্তিনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ এবং বলিষ্ঠ বক্তব্য, সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড।
সাম্প্রতিক সময়ের মার্কিন এ-সিদ্ধান্ত আমাদের সে-প্রত্যাশায় বজ্রাঘাত করেছে। অনুমান নির্ভর অভিযোগ করা কোন দেশের জন্য আধুনিক চিন্তাধারার কূটনৈতিক চর্চা হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রও এক্ষেত্রে স্মার্ট ডিপ্লোম্যাসির পরিচয় দিতে পারতো। তর্কের খাতিরে মার্কিন পুলিশ কর্তৃক প্রকাশ্যে জর্জ ফ্লয়েড এবং বেরেনা টেইলরকে হত্যার ও জ্যাকব ব্লেককে গুলি করার প্রসঙ্গটি আনা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের সকল অঙ্গরাজ্যে বর্ণবাদের বিপক্ষে লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদ আজও আমাদের বিস্মৃত হয়নি। তবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই এ-সকল মানবাধিকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে মার্কিন রাষ্ট্রীয়-নীতির অবস্থান। যদিও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যা যা আন্তর্জাতিকভাবে সংজ্ঞায়িত ও প্রমাণিত, সে অপরাধের দায়ে পাকিস্তানকে আজও যুক্তরাষ্ট্র ভর্ৎসনা করেনি বা বাংলাদেশের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেনি।
Advertisement
বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উষ্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে তরান্বিত করে। বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের নীতি এবং প্রচেষ্টা এক ও অভিন্ন। আজ এক অচিহ্নিত তৃতীয় পক্ষ যারা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থ ও মঙ্গলের প্রতিকূলপক্ষ, তারা মার্কিন প্রশাসনকে মিথ্যা তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে প্রভাবিত করেছে। এক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসন যদি বিষয়গুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং অনুসন্ধান করে, তবে পর্দার পেছনের নীলনকশা ও কুশীলবদের চেহারা বিশ্ববাসীর কাছে ফুটে উঠবে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দেশের অভ্যন্তরে যেমন জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে সফল হয়েছেন, ঠিক তেমনি তিনি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য একটি রোডম্যাপও তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি মানুষের ন্যায্যতার অধিকার নিশ্চিতের লড়াইয়ে নেমে এদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি, ন্যায় বিচার, শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন।
সম্পূরক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পূর্বে বৈশ্বিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যে ঘোষণা দিয়েছিল, ক্ষমতায় বসে সর্বপ্রথম সে-প্রতিশ্রুতিই লঙ্ঘন করেছে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে। আজ আফগানিস্তানে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত। যে তালেবান সরকার অতীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে পপি চাষকে বৈধ ঘোষণা করেছিল, সেই সন্ত্রাসনির্ভর ও মাদকনির্ভর তালেবানদের হাতে আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণের ভবিষ্যৎ অর্পণ করে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু গণতান্ত্রিক চর্চা করলো? সে-কারণে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও শান্তি হুমকির সম্মুখীন নয় কি? এর দায় কার?
২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন। এই উদারতা, এই মানবতা বিশ্বের আর কোন দেশ, কোন সরকার প্রধান দেখাতে পারেনি। সে-সময় ইউরোপের কূটনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ডিপ্লোম্যাট’, ‘শেখ হাসিনা : দ্য মাদার অব হিউম্যানিটি’ শিরোনামে কাভার স্টোরি প্রকাশ করেছে।
Advertisement
আজ তিনি বিশ্ব-শান্তির মডেল উপস্থাপন করছেন আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে। তাঁর নীতি ও প্রস্তাবনা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হচ্ছে বহুজাতিক সম্মেলনে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এল সালভাদর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনপ্রার্থী ১৩৮ নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি করে হত্যা করেছে নিছক অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে।
আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড একশন ব্যাটিলিয়নের সাবেক ও বর্তমান যে সাত শীর্ষ কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র-ভ্রমণের উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা সকলেই দেশের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এবং জবাবদিহিতার সাথে। প্রসঙ্গত ফিরে দেখা যেতে পারে ২০১৩ সালে বিএনপি, জামায়াত ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর ‘মানুষ জ্বালাও, গাড়ী পোড়াও’ কর্মকাণ্ডগুলো। তখন সারাদেশে কত মানুষ পেট্রোল বোমায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে! বাবার সামনে সন্তান! স্ত্রীর সামনে স্বামী! কী বর্বরতা! কী নৃশংসতা! হরতালের নামে উড়ন্ত-অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার অপপ্রয়াস! এ-সব কিছু প্রতিহত করে সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই সাত কর্মকর্তার অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের সার্ভিস রেকর্ড বিশ্লেষণ করলে ক্ষমতার অপব্যবহারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। আলোচনার ধারাবাহিকতায় এখানে একটি প্রশ্ন রাখা যেতেই পারে, এমন জ্বালাও-পোড়াও পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রে হলে অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য মার্কিন প্রশাসনিক-নীতি কি হতো?
বাংলাদেশে আন্দোলনের নামে বিগত ১২ বছরে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দূর্বৃত্তরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপরে হামলা করে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। এমন ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ কী করে, সেটা দেখা প্রয়োজন। যদিও ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্যবাতায়ন বলছে, বিগত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর ১ কোটি মানুষকে কারান্তরীণ করা হচ্ছে সেখানে। গুয়ান্তানামো বে কারাগারে কতজন কয়েদীকে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আটক রাখা হয়েছে সেটি জিজ্ঞাস্য। সেখানে বিচারাধিকার কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে? বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস দমনে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ও কর্মকাণ্ড কতটুকু স্বচ্ছ? যেখানে কংগ্রেসম্যান চার্লি উইলসনের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় তালেবানের সৃজন ঘটে, যে তালেবান আজ বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি!
তবুও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের কিছু বিষয়কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে এবং ঐক্যমত্যের জায়গায় পৌছাতে হবে। আজ বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের উন্মুক্ত ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইতিবাচক হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানী, রাশিয়া, চীন, ভারত ও অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীরা নিরাপদে বিনিয়োগ করতে পারছেন বিদ্যুৎ, পোশাকসহ নানা খাতে। জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ ও যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ উদ্যোগে আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশন চলমান, যেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কল্পনাপ্রসূত সিদ্ধান্তে বিশ্ববাসীর কাছে বিদেশে নিয়োজিত বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী সদস্যদের সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে, যা বৃহত্তর অর্থে ও সীমায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনকে বাধাগ্রস্থ করবে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের সাথে কাজ করছে মানি লন্ডারিং ও কালোটাকার অপব্যবহার রোধে। সন্ত্রাস ও মাদকের তৎপরতা প্রতিহতকল্পে দু’দেশের মধ্যে পারষ্পরিক সহযোগিতার একটা কালচার ও মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এ-কর্মকাণ্ড যেন বাধাপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অগ্রজ দেশের কোন সিদ্ধান্ত যেন বন্ধুপ্রতীম অনুজ দেশের জন্য অপবাদ হয়ে না আসে সেদিকে যেমন খেয়াল রাখতে হবে, পাশাপাশি সে-সিদ্ধান্তে যেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী উপকৃত ও আনন্দিত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
বাংলাদেশ উদারনৈতিক কূটনীতিতে বিশ্বাসী। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’- নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতা ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে মার্কিন প্রশাসনের এ-সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই বদলাবে।
শেষান্তে এটাই প্রত্যাশা, যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক চর্চার অধিকারকে মূল্য দিবে, সার্বভৌমত্বকে সম্মান দিবে। এইচআর/এমএস