মদিনায় এক ইয়াতিম ছেলের একটি খেজুর বাগান ছিল। তার বাগানের সঙ্গে আবু লুবাবা নামে এক লোকের একটি খেজুর বাগান ছিল। ইয়াতিম ছেলেটি তার বাগানের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের চিন্তা করলো। যাতে প্রত্যেকের অংশ পৃথক হয়ে যায়। কিন্তু প্রাচীর দিতে গিয়ে সে দেখলো, প্রতিবেশি আবু লুবাবার বাগানের একটি খেজুর গাছ তার সীমানার মধ্যে পড়ে আছে; যে কারণে তার প্রাচীরটি সোজা করে নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
Advertisement
প্রতিবেশীর (আবু লুবাবা) কাছে গিয়ে তার সমস্যার কথা জানিয়ে গাছটি দান অথবা বিক্রির প্রস্তাব দিলো। আবু লুবাবা আল্লাহর কসম করে বললো, কোনোভাবেই সে গাছটি তাকে (ইয়াতিম ছেলেকে) দেবে না।
ইয়াতিম ছেলে কোনো উপায় না পেয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা জানালো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবু লুবাবাকে ডাকালেন। আবু লুবাবা মসজিদে নববিতে এলে বিশ্বনবি তাকে সেই খেজুর গাছটি অর্থের বিনিময়ে অথবা ইয়াতিম ছেলেকে দান করতে বললেন।
সে বলল, আমি কোনোভাবেই খেজুর গাছটি তাকে দেব না। বিশ্বনবি তাকে কয়েকবার বলার পরেও যখন সে রাজি হলো না; তখন বিশ্বনবি আবু লাবাবাকে বললেন, তোমার (ইয়াতিম) ভাইকে ঐ খেজুর গাছটি দিয়ে দাও। আমি তোমার জন্য জান্নাতে একটি খেজুর গাছের যিম্মাদার হব। আবু লুবাবা এ ঘোষণার পরও খেজুর গাছটি দিতে অস্বীকার করল। তখন বিশ্বনবি চুপ হয়ে গেলেন।
Advertisement
সাহাবাগণ সে মজলিসের কথপোকথন নিশ্চুপ শুনছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিল হজরত আবু দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। মদিনায় তাঁর ৬০০ সুস্বাদু খেজুর গাছের খুবই প্রসিদ্ধ একটি সুন্দর বাগান ছিল। সেখানে তিনি বসবাস করতেন। এবং সে বাগানে একটি কুপও ছিল।
হজরত আবু দাহদাহও বিশ্বনবির কথা শুনছিলেন। তিনি ভাবলেন, এ ক্ষনস্থায়ী দুনিয়া কি? পরকালের চিরস্থায় জীবনের কাছে এ দুনিয়া তুচ্ছ। বরং যদি জান্নাতে একটি খেজুর গাছ পাওয়া যায়, তাহ’লে আর কি চাই?
তিনি বিশ্বনবিকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি জান্নাতের যে খেজুর গাছের কথা বললেন, এটা কি শুধু তার (আবু লুবাবার) জন্যই (খাছ)? আমি যদি ঐ ব্যক্তির কাছ থেকে (সীমানার ওপর পড়ে থাকা) খেজুর গাছটি ক্রয় করে এ ইয়াতিমকে দেয়ার ব্যবস্থা করি, তাহ’লে আমিও কি জান্নাতে খেজুর গাছের মালিক হব?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- হ্যাঁ, তোমার জন্যও জান্নাতে খেজুর গাছ থাকবে। আবু দাহদাহ ঐ ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বললেন- হে আবু লুবাবা শোন! তুমি আমার বাগান সম্পর্কে অবগত আছ, যেখানে ৬০০ খেজুর গাছ আছে, সঙ্গে ঘর ও একটি কূপও আছে?
Advertisement
সে বলল, মদিনাতে এমন কে আছে, যে আপনার বাগান সম্পর্কে জানে না? তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি আমার ঐ সম্পূর্ণ বাগান গ্রহণ করে তোমার একটি খেজুর গাছ আমাকে দিয়ে দাও।
আবু লুবাবা তাঁর এ কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে আবু দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর দিকে তাকাল। অতপর লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা লক্ষ্য কর, আবু দাহদাহ কি বলছে? লোকজন যখন তার কথার ব্যাপারে সাক্ষী হ’ল, তখন সে বলল, হ্যাঁ আমি তোমার খেজুর গাছের বাগান গ্রহণ করলাম এবং ঐ খেজুর গাছটি তোমাকে দিয়ে দিলাম।
হজরত আবু দাহদাহ যখন ঐ খেজুর গাছের মালিক হয়ে গেলেন, তখন ঐ ইয়াতিমকে বললেন, এখন থেকে ঐ খেজুর গাছটি তোমার। আমি তা তোমাকে উপহার দিলাম। এখন তোমার বাগানের প্রাচীর সোজা করতে আর কোনো বাঁধা নেই।
এবার হজরত আবু দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বিশ্বনবির দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এখন আমি কি জান্নাতে খেজুর গাছের মালিক হ’লাম?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, كَمْ مِنْ عِذْقِ رَدَاحٍ لِأَبِي الدَّحْدَاحِ فِي الْجَنَّةِ ‘আবু দাহদাহর জন্য জান্নাতে এখন কত বিশাল বিশাল খেজুরের বাগান অপেক্ষা করছে’!
হাদিসটি বর্ণনাকারী হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এ শব্দটি তিনি (বিশ্বনবি) এক, দুই বা তিনবার বলেননি; বরং খুশি হয়ে বারংবার বলেছেন।
অবশেষে হজরত আবু দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু জান্নাতে বাগানের সুসংবাদ নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে নিজের বর্তমান বাগানের দরজায় গিয়ে স্ত্রীকে ডাক দিলেন- হে উম্মে দাহদাহ! হজরত উম্মে দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা অত্যন্ত অবাক হ’লেন যে, আজকে আবু দাহদাহ বাগানের বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভিতরে আসছেন না কেন? আবারও আওয়াজ আসল! উম্মে দাহদাহ!, উত্তরে তিনি বললেন, আমি উপস্থিত হে আবু দাহদাহ!
বাচ্চাদেরকে নিয়ে এ বাগান থেকে বের হয়ে আস। উম্মে দাহদাহ বললেন, আমি বাগান হ’তে বের হয়ে আসব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি এ বাগান বিক্রি করে দিয়েছি। উম্মে দাহদাহ বললেন, আপনি কার নিকট এটা বিক্রি করেছেন? কে কত দাম দিয়ে এটা ক্রয় করেছেন?
হজরত আবু দাহদাহ বললেন, আমি জান্নাতে একটি খেজুর গাছের বিনিময়ে তা বিক্রি করে দিয়েছি। উম্মে দাহদাহ বললেন, আল্লাহু আকবার, হে আবু দাহদাহ! আপনি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা করেছেন।
জান্নাতের একটি বৃক্ষ, যার নিচে (একজন) অশ্বারোহী একশত বছর পর্যন্ত চলার পরেও তার ছায়া শেষ হবে না। (বুখারি)
কী সৌভাগ্য আমাদের যে, আমরা জান্নাতে এমন একটি (খেজুর) গাছ পাব। (মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরেকে হাকিম)
পরিশেষে…আবু দাহদাহ এবং উম্মে দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার এ দান কোনো সাধারণ দান ছিল না। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আশা পূর্ণ এবং একজন ইয়াতিমকে সহায়তা করার জন্য দুনিয়ায় নিজের মূল্যবান সম্পদ তারা আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
স্বীয় বাসস্থান, মূল্যবান সুস্বাদু খেজুর বাগান, কূপ ছেড়ে দিয়ে মানব জাতির জন্য দানের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন। এটাই হল সত্যিকারের রাসুল প্রেম।
আল্লাহ তাআলা হজরত আবু দাহদাহ ও তাঁর পরিবারের প্রতি অবিরত ধারায় রহমত বর্ষণ করুন! এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে অনুরূপ দানশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস