বিনোদন

কেন সিনেমার গানে নেই ন্যানসি?

এস এ হক অলিক পরিচালিত ২০০৬ সালে রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটির সুপারহিট ‘হৃদয়ের কথা’ সিনেমার শীর্ষ সংগীতের অডিও ভার্সনে হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গে কণ্ঠ দিয়ে ২০০৬ সালে সংগীতাঙ্গনে কণ্ঠশিল্পী ন্যানসির আগমন। তার উত্থান হয় রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটির ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়ে।

Advertisement

সেই সিনেমায় তার গাওয়া ‘পৃথিবীর যত সুখ’ ও ‘হাওয়ায় হাওয়া দোলনা দোলে’ গান দুটি শ্রোতাদের মনে দাগ কাটে।

এরপর তিনি নিয়মিত কণ্ঠ দিয়েছেন বেশ কিছু সিনেমায়। সেসব সিনেমা থেকে তার কণ্ঠে এসেছে ‘বাহির বলে দূরে থাকুক’, ‘জ্বলে জ্বলে জোনাকি’, ‘আমি তোমার মনের ভেতর’সহ বেশ কিছু শ্রোতাপ্রিয় গান। ন্যানসি প্রথমবারের মতো ২০১১ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তুলেন মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত ‘প্রজাপতি’ সিনেমার ‘দুই দিকে বসবাস’ গানে কণ্ঠ দিয়ে।

কিন্তু আজকাল প্লেব্যাক করতে দেখাই যায় না তাকে। শুধু সিনেমার গান নয়, বলা চলে সামগ্রিক গান থেকেই যেন দূরে সরে আছেন মধুকণ্ঠী এই গায়িকা। কেন?

Advertisement

প্রশ্নটা ছুঁড়তেই সরল কথায় হাসিমাখা জবাব, ‘আমি গান থেকে সরে যাইনি। অনেকেই বলেন কেন গানে নিয়মিত নেই, অনেক ভক্তরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে চান বিষয়টি। আমি নিয়মিত আছি, নিয়মিত গান করতেও প্রস্তুত। কিন্তু গান গাওয়ার সুযোগ তো নেই।’

এ প্রজন্মের সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় ও সফল গায়িকাদের একজন ন্যানসি। তিনি গানের সুযোগ পান না এটা শুনতে খটকা লাগে। সেই খটকা দূর করতে জিজ্ঞেস করা হয়, সুযোগ পান না বলতে কেউ কি আপনাকে দিয়ে গান করাতে চায় না? ন্যানসির জবাব, ‘অনেকটা সেরকমই। আমি গানের মানুষ। গান করবো বলেই তো গায়িকা হয়েছি। কিন্তু গেল কয়েক বছরে অভিজ্ঞতাটা খুবই বাজে। গানের আঙ্গিনাটা অনেক এলোমেলো লাগে, অগোছালো লাগে। কিছু অডিও গান করি কালেভদ্রে। সিনেমায় তো একেবারেই নেই বলা যায়। এর বেশ কিছু কারণই রয়েছে।

প্রথম সমস্যা বাজেটে। এখন অনেক বাজেটে সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু গানের জন্য সেই অনুপাতে বাজেট থাকে না। সিনেমার গানের শুটিং করা হচ্ছে দেশে বিদেশে গিয়ে। অথচ যারা গান তৈরি করেন, কণ্ঠ দেন তাদের টাকা দিতে গেলেই যেন কষ্ট হচ্ছে প্রযোজকদের। পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক না হলে একজন শিল্পী সার্ভাইব করবেন কী করে! একজন শিল্পী হিসেবে তো আমাকেও বেঁচে থাকতে হবে। আমার যোগ্য পারিশ্রমিক কেন বলে কয়ে চেয়ে নিতে হবে! এসব প্রশ্ন মনের মধ্যে কাজ করে আজকাল গান করতে গেলে। সেজন্যই বিরতি।

আমার কথা হলো যার ন্যানসির কণ্ঠ দরকার সে যোগ্য মূল্যায়ণ দেবেই। হয়তো আমার কণ্ঠ কারো দরকার পড়ছে না, তাই যোগ্য মূল্যায়ণ দিয়ে কেউ সুযোগও দিচ্ছে না। যোগ্য পারিশ্রমিকের অভাবে কিন্তু অনেক তারকা-সিনিয়র শিল্পীরাও প্লেব্যাক থেকে দূরে সরে আছেন। আমার মনে পড়ে না হাবিব ভাইকে (হাবিব ওয়াহিদ)শেষ কবে সিনেমার গান করতে দেখেছি। অথচ তিনি টানা কয়েক বছর সিনেমায় হিট গান উপহার দিয়েছেন।উনি এখন করেন না কেন? তিনি কি গান করা ভুলে গেছেন? মোটেও না। আমার মনে হয় সেখানেও পারিশ্রমিক একটি বড় কারণ। শ্রোতাদের কাছে চাহিদা থাকলেও সিনেমার সংশ্লিষ্টরা সিনেমার গানকে খুব একটা প্রাধান্য দিচ্ছেন না এখন। তারা মনে করছেন, কোনো রকমে গান হলেই হলো।’

Advertisement

গানে নিয়মিত হওয়ার প্রতিবন্ধকতায় আরও একটি বিষয়কে ন্যানসি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরলেন। সেটি হলো প্যাকেজ সিস্টেম। গায়িকার দাবি, আজকাল গানে চলছে প্যাকেজ ফর্মূলা। কোনো একজন গীতিকার বা সংগীত পরিচালককে দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয় প্যাকেজ আকারে সিনেমার সব গান তৈরি করার। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই জন প্রথমেই প্যাকেজের বাজেট থেকে সাশ্রয় করার চেষ্টা করছেন। এক গানের বাজেট দিয়ে তিন গান তৈরি করার চেষ্টা করছেন। যার ফলে তারকাশিল্পীদের গান দেখা যায় না সিনেমায়।

ন্যানসির এই দাবিটি অবশ্য অনেকদিন ধরেই অভিযোগ আকারে ঢাকাই সিনেমার বাজারে উড়ছে। খোঁজ করে দেখা যায় আজকাল সিনেমার গান শ্রোতারা শুনলো কি শুনলো না সেটা কেউ ভাবছেনই না। আগে সিনেমার গান নিয়ে প্রযোজক, পরিচালক থেকে শুরু করে অভিনয় তারকারাও সচেতন ছিলেন। গানকে খুব গুরুত্ব দিতেন। এখন সবাই গানটাকে খুব হালকাভাবে দেখেন। হলে হলো না হলেও হলো- এমন মুডেই গান চলছে। তাই সিনেমার গানে সফল শিল্পীদের আর দেখা যায় না এখন প্লেব্যাকে। পরিচালক তার পছন্দমতো লোকের উপর দায়িত্ব দেন সিনেমার গান তৈরির। সেই লোক নিজের কাছের মানুষদের সুযোগ করে দিচ্ছেন গান করার। কিন্তু সেখানে গানের মান ও শ্রোতা গ্রহণ করবে কী না সেইসব বিষয় থাকছে উপেক্ষিত। অনেকে লবিং করেও হাতিয়ে নিচ্ছে সিনেমার গান।

‘লবিং আগেও ছিলো এখনো আছে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এখনকার লবিংগুলোতে কোনো পারফেকশন মানা হয় না। আগে লবিং হলেও চেষ্টা করা হতো গানের মানকে প্রাধান্য দিতে। যে গানটি যাকে দিয়ে ভালো হবে তাকেই দেয়া হতো বা তার বিকল্পকে ভাবা হতো পরিচিতদের মধ্যে। কিন্তু এখন দেখা যায় যে ধাঁচের গান একজন শিল্পী গাইছেন সেই ধাঁচের গান ওই শিল্পী কখনোই কণ্ঠে নেননি। আবার সিনেমার পর্দাতে যার ঠোঁটে গানটি দেখানো হচ্ছে সেখানেও মানানসই লাগছে না। এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে একেকজনের টেস্ট একেকরকম। সেই টেস্ট মিলিয়ে গান করা সিনেমার জন্য খুব জরুরি বলে মনে করি। নইলে প্রচেষ্টা বিফলে যায়’- যোগ করেন ন্যানসি।

তবে ন্যানসির ঢাকার বাইরে স্থায়ী হওয়া প্রসঙ্গে অভিযোগ রয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে। গেল কয়েক বছর ধরে ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহে স্থায়ী হয়েছেন এই সংগীত তারকা। তাই অনেকেই বলেন, অনেক সময় কিছু গানের জন্য ন্যানসিকে ভাবা হলেও তাকে হাতের কাছে না পেয়ে অন্যদের দিয়ে গান করাতে হয়। এই অভিযোগকে উড়িয়ে দিলেন ন্যানসি। তিনি বলেন, ‘এটা একটা স্রেফ অজুহাত। দেখুন, আমার কাজ গান করা। একটা গানের রেকর্ড হতে যেটুকু সময় প্রয়োজন সেটুকু সময় আমি অনায়াসে বের করতে পারি। এমন কেউ বলতে পারবে না যে কখনো টাইম দিয়ে আমি লেট করে স্টুডিওতে গিয়েছি। কাউকে বসিয়ে রেখেছি। বরং ঢাকায় থেকেও যখন অনেকে দেরি করেছে সেখানে আমি ৮টার রেকর্ড হবে জেনেও সাড়ে ৬টায় পৌঁছে গিয়েছি ময়মনসিংহ থেকে। দূরত্ব কোনো সমস্যা নয় আমার ক্ষেত্রে।

যারা অভিনয় করেন তাদের টানা অনেকটা সময় একসঙ্গে থাকতে হয় টিমের সঙ্গে। আমার ব্যাপারটি তো এমন নয়। রেকর্ড শেষ হলেই আমার কাজ শেষ। ঢাকায় থাকলেই কি আর ময়মনসিংহে থাকলেই কি। আমি কীভাবে কল টাইমে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় যাবো সেটা আমার দেখার বিষয়। প্রতি সপ্তাহে অনেকবার আমাকে ঢাকায় যেতেই হয় নানা কাজে। তাই এটা স্রেফ অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয় যে আমি ময়মনসিংহে থাকি বলে গান করতে পারবো না।’

নিজের নতুন গান নিয়ে ন্যানসি জানান, সম্প্রতি অনুপম মিউজিকের ব্যানারে ১০টি গান প্রকাশ হবে তার মিউজিক ভিডিও আকারে। এই গানগুলো দেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ, রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া। নতুন করে সংগীতায়োজনে প্রকাশ করা হবে ন্যানসির কণ্ঠে।

এলএ/জেআইএম