ফিচার

দিনমজুর সাইফুলের স্বেচ্ছাশ্রমের গল্প

প্রচলিত আছে ‘কারো মন আছে ধন নেই/ আবার কারো ধন আছে মন নেই’। তবে শুধু মন আর ধন নয়, মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কাজ করতে প্রবল ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। মাদার তেরেসার কথায়, ‘আমাদের সবার পক্ষে মহৎ কাজ করা সম্ভব হয় না। তবে চাইলেই মহৎ ভালোবাসা দিয়ে আমরা ছোট ছোট কাজ করতে পারি’। নিজের ধন সম্পদ না থাকলেও শুধু ইচ্ছাশক্তি দিয়ে উপকূলের মানুষের সেবা করা এক দিনমজুরের গল্প শোনাচ্ছেন শেখ নাসির উদ্দিন—

Advertisement

খুলনার কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামের রাজমিস্ত্রি এম এম সাইফুল ইসলাম। ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের সংসার বেড়ে ওঠা। বাবা ভ্যানচালক নুরুউদ্দিন মোড়ল যা আয় করতেন; সেটা দিয়ে চলত সংসার আর দুই ভাই-বোনের পড়াশোনা। যেখানে বছর বছর ঝড় হয়; সেখানে স্বচ্ছল হওয়ার আশা থাকে না। একটি স্বপ্ন পূরণের আগে আরেকটি স্বপ্ন ভেঙে যায় উপকূলবাসীর। তাই কলেজ প্রাঙ্গণে পা রাখলেও ঘূর্ণিঝড় আইলা তার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর সংসার যেন আর চলে না নুরুউদ্দিন মোড়লের। তাই কলেজ ছেড়ে স্টুডিওর দোকানে কাজ শুরু করে সাইফুল। মাসখানেক পর থেকে পনেরোশ টাকা বেতন পান। তারপর আরও অনেক কাজ করতে হয়েছে তাকে। পাশাপাশি সামাজিক সেবা সংগঠন ‘মানব কল্যাণ ইউনিট’র সদস্যও ছিলেন।

কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই স্বেচ্ছাশ্রম দিতেন এ সংগঠনের হয়ে। ২০১৪ সালে বিয়ে করে সংসার পাতেন, তাই খরচ বাড়ে। সংসার চালাতে রাজমিস্ত্রির কাজে নেমে পড়েন সাইফুল। গত পাঁচ বছর ধরে রাজমিস্ত্রি কাজের পাশাপাশি সামাজিক সেবা করে আসলেও এবার করোনা মহামারীতে কাজ বন্ধ থাকায় নেমে পড়েন প্রিয় সংগঠনের মানবিক কাজে।

কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন খাবার। সচেতনতা সৃষ্টিতে বিলি করেছেন হ্যান্ডবিল। এরপর আসে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। তখন থেকে পুরোদমে নেমে পড়েন উপকূলবাসীর সেবায়।

Advertisement

‘হিউম্যানিটি ফার্স্ট, আলোকিত শিশু, গিফট ফর গুড, আবুল বাশার ফাউন্ডেশন, বন্ধু ফাউন্ডেশনের হয়ে নিয়মিত স্বেচ্ছাশ্রমে উপকূলবাসীর সেবা করে যাচ্ছেন সাইফুল। জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড জয়ী ‘মানব কল্যাণ ইউনিট’র প্রচার সম্পাদক তিনি। এ ছাড়া ভালো মোবাইল ফটোগ্রাফিও করেন।

স্বেচ্ছাসেবক এম এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আইলার পর সংসারে অভাব-অনটন বেড়ে যায়; এজন্য পুরোদমে কাজে নেমে পড়ি। কলেজে ভর্তি হয়ে ক্লাসও করেছি কিছুদিন। কিন্তু কলেজ পাস করতে পারলাম না। ছোটবেলা থেকে ভ্যান চালিয়ে ও অন্য কাজ করে পড়াশোনা চালিয়েছি। মা কাঁথা সেলাই করে আমাকে আর ছোট বোনকে পড়াশোনায় সাহায্য করতেন।’

তিনি বলেন, ‘যখন সংসারের জন্য কাজ শুরু করি। তখন থেকে মানব কল্যাণ ইউনিটের সদস্য হয়ে কাজের ফাঁকে আমি স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া শুরু করি। একটি ঘূর্ণিঝড় কিভাবে পুরো সংসার লন্ডভন্ড করে দেয়, মানুষ কতটা অসহায় বোধ করে, সেটা আমি জানি। তাই সব সময় যতটুকু পারি মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করি।’

সাইফুল বলেন, ‘করোনার সময় মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার দিয়েছি। আরেকটা কাজ আমার ভালো লাগত, সেটা হলো সাইকেল দিয়ে ঘুরে ভবঘুরে, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে রান্না করা খাবারের প্যাকেট দেওয়া। অনেক ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করতাম। তারপর আম্ফানে কয়রা, শ্যামনগর উপজেলায় নৌকায় করে খাবার নিয়ে সময়-অসময়ে ছুটে যাই। যখন মানুষের মুখে প্রাপ্তির হাসি দেখি; তখন মন ভরে যায়।’

Advertisement

ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহ কিভাবে তৈরি হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামার স্টুডিওর দোকান আছে। সেখানে ছোটবেলা থেকে সময় দিতাম। এখনো মনে পড়ে, ক্লাস ফোরে আমি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলায় বেশি সময় দিয়েছি বলে ফেল করেছিলাম। নিজের ক্যামেরা কেনার শখ থাকলেও সাধ্য নেই। আমার একবছরের জমানো টাকা দিয়ে মোবাইল কিনেছি। ক্যামেরা তো অনেক টাকার জিনিস! তাই মোবাইল দিয়েই ছবি তুলি।’

সাইফুল আরও বলেন, ‘আমি যতদিন পারব মানুষের জন্য কাজ করব। আমার পরিবার সব সময় সহযোগিতা করে। আবার বেশি রাত হলে দুশ্চিন্তাও করে।’

হিউম্যানিটি ফার্স্ট’র প্রতিষ্ঠাতা ইদ্রিস আলী বলেন, ‘সাইফুল মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, মানবিক কাজের জন্য ইচ্ছাশক্তিই বড়। অনেক মানুষ আছে, অনেক টাকার মালিক হয়েও সমাজের জন্য একটি টাকাও ব্যয় করে না। এমনকি কারো উপকারও করে না। নিজের পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়, তবুও সাইফুল মানুষের জন্য স্বেচ্ছায় কাজ করছে। যা কেবল মহৎ মানুষের দ্বারা সম্ভব। কাজের প্রতি তার আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করে।’

মানব কল্যাণ ইউনিট’র পরিচালক ফরহাদ আল আমিন বলেন, ‘সাইফুলের পেশা ভিন্ন হলেও নেশা স্বেচ্ছাশ্রম। তার কাজের আগ্রহ ভালো বলে আমরা তাকে সংগঠনের প্রচার সম্পাদক করেছি। তার নেশা আর পেশা এক করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’

এসইউ/এএ/জেআইএম