ফিচার

প্রতিমুহূর্তে জীবাণুনাশক কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

 

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করতে কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এতদসত্ত্বেও স্বীকৃত কোন ভ্যাক্সিন বা ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। যদিও বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করে ট্রায়ালের মাধ্যমে চিকিৎসার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো উপায় হলো যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ করা। এজন্য বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলা, নিয়ম মেনে মাস্ক পরিধান করা, যেসব দ্রব্যাদি বারবার বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে আসে তা জীবাণুমুক্ত করা ইত্যাদি নিয়ম অনুসরণ করতে বলা হচ্ছে। জীবাণুমুক্ত করতে বিভিন্ন ধরনের জীবাণুনাশক এখন ব্যবহার করা হচ্ছে। এই জীবাণুনাশক সম্পর্কে আজ আমরা বিস্তারিত জানব।

Advertisement

জীবাণুনাশক কী: যেসব সক্রিয় রাসায়নিক পদার্থ বা বিভিন্ন ধরনের তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ বিভিন্ন আণুবীক্ষণিক জীবাণু, যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও প্রোটোজোয়াকে নিধন করে বা এদের প্রজনন ও বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে, তাদের সাধারণভাবে জীবাণুনাশক বলা হয়।

জীবাণুনাশকের ধরন: জীবাণুনাশক তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণিটি হলো সংক্রমণ নিবারক বা ডিসইনফেকট্যান্ট। এগুলো বাছবিচারহীনভাবে বিভিন্ন জীবাণুর সাথে সাথে সজীব মানবকোষ ও প্রাণিকোষেরও ক্ষতি করে বলে এগুলোকে কেবল নির্জীব পৃষ্ঠতলে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক বিভিন্ন প্রকারের জীবাণু ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করা হয়, যাতে রোগের বিস্তারলাভ প্রতিরোধ করা যায়। সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট, হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইড, গ্লুটারালডিহাইড, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি-সি, গামা রশ্মি, ইথিলিন অক্সাইড এবং ফরম্যালডিহাইড গ্যাস ইত্যাদি এ শ্রেণির জীবাণুনাশক।

দ্বিতীয় শ্রেণিটি হলো পচন নিবারক বা অ্যান্টিসেপটিক। এগুলোকে জীবদেহের বহিঃস্থ পৃষ্ঠতলে প্রয়োগ করা হয় (উদাহরণস্বরূপ শল্যচিকিৎসার সময় অথবা শরীরের ত্বক জীবাণুমুক্ত করতে), যাতে রোগসংক্রমণ না হয়। উল্লেখ্য, এ শ্রেণির জীবাণুনাশক কেবল জীবদেহের বাইরের পৃষ্ঠতল বা ত্বকে প্রয়োগ করা হয়। জীবদেহের অভ্যন্তরে কিংবা মিউকাস মেমব্রেনে এটা প্রয়োগ করা হয় না। কারণ ত্বকের কোষকে আক্রমণ না করলেও শরীরের অভ্যন্তরের বিভিন্ন কোষে এটি ক্ষতিসাধন করতে পারে। ৭০% আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল, রেকটিফায়েড স্পিরিট, ক্লোরহেক্সিডিন, পোভিডোন আয়োডিন, ক্ষারযুক্ত সাবান ইত্যাদি হলো এ ধরনের জীবাণুনাশক।

Advertisement

তৃতীয় শ্রেণিটি হলো জীবাণু নিরোধক ওষুধ, যেগুলো জীবদেহের বহিস্থ পৃষ্ঠের পাশাপাশি জীবদেহের অভ্যন্তরেও জীবাণুদের বিরুদ্ধে কাজ করে। সাধারণত এ শ্রেণির জীবাণুনাশক সজীব জীবদেহে কোন ক্ষতিসাধন করে না। জীবাণু নিরোধক ওষুধগুলোকে এগুলোর উদ্দীষ্ট জীবাণুগুলোর উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়। যেমন ব্যাকটেরিয়া নিরোধক বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এবং ছত্রাক নিরোধক ওষুধ বিভিন্ন ছত্রাকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় ইত্যাদি। পেনিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন, এরিথ্রোমাইসিন, নিস্ট্যাটিন, মাইকোনাজোল ইত্যাদি হলো জীবাণু নিরোধক ওষুধ।

করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিহত করার জন্য প্রথম দুই শ্রেণির জীবাণুনাশক পদার্থ অর্থাৎ ডিসইনফেকট্যান্ট এবং এন্টিসেপটিক বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ রোধে জীবাণুনাশকের ব্যবহার: করোনাভাইরাস একটি সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড আরএনএ ভাইরাস, যার প্রোটিন ক্যাপসিডকে ঘিরে লিপোপ্রোটিনের একটি আবরণী বিদ্যমান। ক্ষার এবং বিভিন্ন জীবাণুনাশকের উপস্থিতিতে ভাইরাসের এই বহিরাবরণটি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ভাইরাস পার্টিকেলটি অকেজো হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়। এ বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে করোনাভাইরাস বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডিসইনফেকট্যান্ট ধরনের জীবাণুনাশক হিসাবে এক্ষেত্রে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইটের ৫.২৫%-৬.১৫% দ্রবণ বা ব্লিচিং পাউডারের দ্রবণ এবং হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইডের ৩% দ্রবণ বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি এন্টিসেপটিক ধরনের জীবাণুনাশক হিসাবে ক্লোরহেক্সিডিন ও ৭০% আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহলের মিশ্রণ এবং ডিটারজেন্ট বা সাধারণ সাবান-পানি কিংবা সোপি ওয়াটার বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে।

করোনা রোধে যেভাবে জীবাণুনাশক ব্যবহার করবেন: করোনা মোকাবেলায় সাধারণ পরিষ্কারের কাজ যেমন আসবাবপত্র, যন্ত্রাংশ, মেঝে, গাড়ি, দরজার হাতল, সুইচ, সিঁড়ির রেলিং ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করতে ১ঃ১০০ ঘনত্বের ব্লিচিং পাউডারের দ্রবণ ব্যবহার করা যায়। এজন্য ২০ লিটার পানিতে এক টেবিল চামচ ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে ৩০ মিনিট রেখে দেওয়ার পর নিচে জমা হওয়া তলানি ফেলে উপরের স্বচ্ছ জীবাণুনাশক তরল প্রয়োগ করুন। আবার অধিক সংক্রামক বর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করতে ১ঃ১০ ঘনত্বের ব্লিচিং পাউডারের দ্রবণ ব্যবহার করুন। এ লক্ষ্যে ২ লিটার পানিতে এক টেবিল চামচ ব্লিচিং পাউডার গুলিয়ে পূর্বের মত ৩০ মিনিট রেখে নিচে জমা হওয়া তলানি ফেলে দেওয়ার পর উপরের স্বচ্ছ তরল ব্যবহার করতে পারেন। তবে ব্যবহারের সময় যেন এ দ্রবণ চোখ, নাক বা চামড়ার সংস্পর্শে না আসতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

Advertisement

আবার আপনার ত্বককে জীবাণুমুক্ত করতে বারবার ক্ষারযুক্ত সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলবেন। কোথাও সাবান-পানি না পেলে যেমন ঘরের বাইরে বের হলে কোন কিছু ধরার পর ক্লোরহেক্সিডিন ও ৭০% আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহলের মিশ্রণ দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলুন। বিভিন্ন কোম্পানি মিশ্রণটি বিভিন্ন নামে বাজারজাত করছে। গরিবদের জন্য আইসিডিডিআর,বি সোপি ওয়াটারের সাহায্যে এক টাকায় আশি বার হাত ধোয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। এ পদ্ধতিতে দেড় লিটার ফুটানো পানি নিয়ে তাতে ৪ চা চামচ ডিটারজেন্ট মিশিয়ে ভালোমত নেড়ে উক্ত দ্রবণ স্প্রে বোতলের মাধ্যমে কিংবা পাত্র থেকে ঢেলে সোপিওয়াটার ব্যবহার করতে পারেন। এই দেড় লিটার সোপি ওয়াটার দিয়ে ৪০০ বারেরও বেশি হাত ধুতে পারবেন। পাশাপাশি আপনার ব্যবহৃত জামা-কাপড় প্রতিদিন ডিটারজেন্ট বা বল সাবান ও পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলুন।

জীবাণুনাশকের কোনো অপকারিতা আছে: আমেরিকান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কার্যকর ঘনমাত্রায় ডিসইনফেকট্যান্ট ধরনের জীবাণুনাশক কেবল কোনো জড় বস্তুর ওপরই ব্যবহার উপযোগী। কোনো প্রাণির শরীরে সরাসরি এটি ব্যবহার করা একদমই অনুচিত। মানুষ কিংবা কোনো প্রাণির শরীরের বহির্ভাগে সরাসরি এ ধরনের জীবাণুনাশক প্রয়োগ করলে ত্বক, চোখ, নাক, এমনকি শ্বাসযন্ত্রেরও ক্ষতি হতে পারে। ত্বকে জ্বালাপোড়া, কেমিক্যাল ডার্মাটাইটিস এমনকি কেমিক্যাল বার্ন, চোখে জ্বালাপোড়া, চোখ লাল হওয়া, কেমিক্যাল কনজাংটিভাইটিসও (রাসায়নিকের প্রভাবে চোখের প্রদাহ) হতে পারে। এ ছাড়া স্প্রে করা এসব জীবাণুনাশক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ভেতরে গিয়ে ফুসফুসে কেমিক্যাল নিউমোনাইটিসের (রাসায়নিকের প্রভাবে ফুসফুসের প্রদাহ) কারণ পর্যন্ত হতে পারে। তা ছাড়া জীবাণুমুক্ত হতে কোনো বস্তুর যে সময়ব্যাপী কার্যকর ঘনমাত্রার জীবাণুনাশকের সংস্পর্শে থাকার শর্ত রয়েছে, তা অনেক সময়ই পূরণ করা দুঃসাধ্য। বরং এতে নিজেকে যথাযথ জীবাণুমুক্ত মনে করে ‘ফলস সেফটি’র বিষয়টি অবচেতন মনে এসে ব্যক্তিগত সতর্কতা কমে যেতে পারে। উপরন্তু এসব জীবাণুনাশক মাটিতে বা পানিতে মিশে দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

এ ছাড়া দীর্ঘদিন বারবার ক্ষারযুক্ত সাবান ব্যবহার করে হাত পরিষ্কার করার ফলে হাতের চামড়া খসখসে হয়ে ডার্মাটাইটিস তৈরি করতে পারে। এন্টিসেপটিক জীবাণুনাশকগুলো চোখ কিংবা মিউকাস মেমব্রেন যেমন গালের ভেতর কিংবা নাকের ভেতরের সংস্পর্শে আসলে আক্রান্ত স্থান জ্বালাপোড়া করতে পারে। তাই যেকোন ধরনের জীবাণুনাশকই সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত।

এসইউ/এমএস