ফিচার

স্যানিটারি প্যাড নিয়ে মারজিয়া প্রভার যুদ্ধ

ব্র্যান্ডভেদে বাংলাদেশে স্যানিটারি প্যাডের প্যাকেটের দাম গড়ে ১০০-১৬০ টাকা। এই দাম স্বচ্ছল পরিবারের কাছে আহামরি না হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তা অতিরিক্ত হারে বেশি। তাই তাদের পুরোনো কাপড়, অস্বাস্থ্যকর তুলা দিয়েই কাজ চালাতে হয়। কাপড় ব্যবহারের সঠিক ব্যবস্থাপনা না মানায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে এতে। মাসিক চলাকালে অব্যবস্থাপনার জন্য প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী জরায়ু, জরায়ুমুখ ও মূত্রনালির সংক্রমণের শিকার হন, যা পরে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। শহরাঞ্চলে প্যাডের ব্যবহার ৪০-৫০ শতাংশ হলেও সারাদেশে সেই হার মাত্র ১২-১৫ শতাংশ।

Advertisement

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভের তথ্য বলছে, ৪১ শতাংশ মেয়ে মাসিকের সময় স্কুল-কলেজে অনুপস্থিত থাকে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাচ্ছে। এই পাল্টানোদের মধ্যে একজন মারজিয়া প্রভা। ২০১৫ সাল থেকেই দেশের নানা প্রান্তে ছুটে চলেছেন তিনি। স্কুলে স্কুলে স্থাপন করেছেন প্যাড কর্নার। সেই সাথে মাসিক নিয়ে সচেতনতা, স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার, স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কাপড় ব্যবহারসহ সার্বিক স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।

স্কুলে যাওয়ার পর যদি হঠাৎ মাসিক শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের মনে এই ভয় সবচেয়ে বেশি কাজ করে। স্কুলে পিরিয়ড বা মাসিক শুরু হলেও শিক্ষার্থীদের ভয় দূর করার জন্য দেশের ১৬টি জেলার ১৬টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জরুরি প্যাড কর্নার চালু করেছেন মারজিয়া। মাসিক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি ও তার দলের সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় বাজে মন্তব্য শুনতে হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে কোনো স্কুলে কর্মশালা বা অন্য কোনো কার্যক্রম চালানোর সময় এলাকার লোকজনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এসব কারণে ২০১৭ সালে কার্যক্রম অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে দমে যাননি মারজিয়া ও তার দলের সদস্যরা। সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক এ কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন।

মারজিয়া বাংলাদেশে মাসিক নিয়ে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচিতে কাজ করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। নিজের এই মহৎ উদ্যোগ নিয়ে জাগো নিউজের সাথে কথা বলেছেন মারজিয়া প্রভা। তিনি জানান, শুরুতে তার উদ্যোগের নাম ছিল ‘ডোনেট আ প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ’ (স্বাস্থ্যসম্মত বাংলাদেশের জন্য একটি প্যাড দান করুন)। বাংলাদেশে মাসিক বা মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার নিয়ে যে ‘ট্যাবু’ বা গোপনীয়তা আছে, তা ভাঙতে। মারজিয়া ও তার দলের সদস্যরা সংগ্রাম করছেন নিস্বার্থভাবে।

Advertisement

মারজিয়া জানান, প্রথমে নিজেদের বেতনের টাকা, পরিবারের সদস্য, বন্ধুদের সহায়তায় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। বর্তমানে কিছু সংগঠন এবং ব্যক্তি এ কার্যক্রমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে টাকার জন্য এই কার্যক্রম আটকে থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, সর্বশেষ যতদিন নিজের আয় থাকবে এই কার্যক্রম বন্ধ হবে না।

দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুলে জরুরি প্যাড কর্নারের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে একটি বিদ্যালয়ে প্যাড কর্নারের জন্য ২০০ স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের জরুরিভিত্তিতে প্যাড প্রয়োজন হলে পাঁচ টাকা বা যার সামর্থ আছে, সে বেশি টাকা দিয়ে একটি প্যাড কিনে ব্যবহার করবে। সমবায় পদ্ধতিতে প্যাড বিক্রির টাকা জমা হবে। আর পুরো কার্যক্রম তদারকির জন্য একজন নারী শিক্ষককে দায়িত্ব দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। জমানো টাকা থেকে আবার প্যাড কিনে রাখা হয়।

ব্যবহারের পর প্যাড নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্যও ব্যবস্থা করে দেয় মারজিয়ার দলের সদস্যরা। কর্নার চালু হয়ে গেলে পরে স্কুলের তত্ত্বাবধানে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ উদ্যোগ দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি চান প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে প্যাড কর্নার গড়ে তুলবেন।

মারজিয়া জানান, শুধু প্যাড কর্নার চালু নয়, বিদ্যালয়ে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করেন তারা। এতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা উপস্থিত থাকেন। শিক্ষার্থীরা মাসিক নিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বলে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন।

Advertisement

মারজিয়া বলেন, ‘কার্যক্রম শুরুর দিকে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে দেখতাম, মেয়েরা লজ্জায় কথা বলত না। আর এখন মেয়েরা মাইক্রোফোনেও কথা বলে।’

এবার অন্যরকম এক আন্দোলন শুরু করেছেন মারজিয়া প্রভা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনা মূল্যে স্যানেটারি প্যাড প্রদানের দাবিতে দেশব্যাপি গণস্বাক্ষর কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। ৬ নভেম্বর দুপুরে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরামের (নাসাসু) উদ্যোগে মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ওয়ার্কশপের মধ্যদিয়ে গণস্বাক্ষর কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন।

কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি জানান, মূলত মোট সাতটি দাবিতে দেশব্যাপি তারা এই গণস্বাক্ষর কর্মসূচি চালাবেন। দাবিগুলো হচ্ছে-১. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও কমিউনিটি ক্লিনিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনামূল্যে স্যানিটারি প্যাড প্রদান।২. আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক সুরক্ষা খাত এবং কল্যাণমূলক খাত থেকে বিনা মূল্যে প্যাড প্রদানের জন্য বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।৩. অতি তাড়াতাড়ি মাসিক ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করা।৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা ওয়াশরুম এবং ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা।৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কিশোরী ক্লাবে শিক্ষার্থীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান।৬. নারীদের মধ্যে মাসিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ।৭. বাজারে উৎপাদিত জেল প্যাডকে সম্পূর্ণ না করে পরিবেশবান্ধব এবং স্বাস্থ্যসম্মত অর্গানিক কটন স্যানেটারি প্যাড তৈরির জন্য সরকারের আইন প্রণয়ন।

দেশের সচেতন মানুষকে এ আন্দোলনের সাথে পেতে এবং সরকারকে এই দাবি মেনে নিয়ে নারীদের স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে আহ্বান জানান মারজিয়া প্রভা। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এলে তিনি এ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

এসইউ/জেআইএম