বিনোদন

দেশে হিন্দি গানের আগ্রাসনে ক্ষুব্ধ সংগীত প্রযোজকরা

বছর পাঁচেক আগেও দেশের মোবাইল ফোনগুলোর মাধ্যমে ভাইরাসের মতো সংক্রমিত হয়েছিল হিন্দি গান। মুঠোফোনের রিংটোন, ওয়েলকাম টিউনের সূত্র ধরে তখন দেশের বেশিরভাগ উৎসবে, অনুষ্ঠানে, দোকানে, বাসে, ঘরে বাজতো হিন্দি গান।

Advertisement

বিপরীতে বাংলা গান ছিল ‘নিজ দেশে পরবাসী’র মতো! হিন্দি গানের প্রভাব এতোটাই ছিল যে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল নাগাদ দেশের বেশিরভাগ সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

এমন সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে, দেশের সংস্কৃতি ও সংগীতকে বাঁচানোর জন্য এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর তাগিদে অডিও প্রযোজকদের সংগঠন এমআইবি’র নেতারা দ্বারস্থ হন উচ্চ আদালতের। ফলাফল হিসেবে ২০১৫ সালের ৯ জুলাই উচ্চ আদালত থেকে একটি ঐতিহাসিক স্থগিতাদেশ দেন। ওইদিন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের রিংটোন ও ওয়েলকাম টিউনে হিন্দি গানের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

এমন ঘোষণার পর দেশের সব মোবাইল ফোন থেকে হিন্দি গানের বিপণন রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায়। দুঃখের ব্যাপার হলো, চলতি বছরের ৩ জুলাই থেকে আবারও হিন্দি গানের আগ্রাসন শুরু হয়েছে।

Advertisement

মোবাইল অপারেটর সিস্টেম রবির ওপর ভর করে আবারও ঢুকে পড়েছে হিন্দিসহ বিভিন্ন বিদেশি গান। যার মধ্যে বরাবরই দেশের সংগীতের মূল অন্তরায় হিসেবে ধরা দিয়েছে হিন্দি গান।

চলতি বছরের ৩ জুলাই মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি তাদের গ্রাহকদের জন্য যুক্ত করেছে ভারতীয় জনপ্রিয় স্ট্রিমিং অ্যাপ ‘জি-ফাইভ’। যার মাধ্যমে রবি গ্রাহকরা উপভোগ করতে পারবেন হিন্দি গানসহ বিদেশের বিভিন্ন নাটক, সিনেমা ও ওয়েব সিরিজ।

এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি বিস্ময় প্রকাশ করছেন সংগীত সংশ্লিষ্টরা। তাদের প্রশ্ন, দেশের উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্য করে কীভাবে একটি মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান এই কাজটি করতে পারে? তবে কি তারা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি আর সংগীতকে ধ্বংস করে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আবারও হিন্দি গানের ‘চল ছাঁইয়া ছাঁইয়া’ উৎসব ছড়িয়ে দিতে চান?

এমন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে এমআইবির (মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) পক্ষ থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান রবি আজিয়াটা লিমিটেড বরাবর একটি উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। জানতে চাওয়া হয়, কেন উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্য করে প্রতিষ্ঠানটি ফের উপমহাদেশের গান-নাটক বিপণন করছেন তারা।

Advertisement

এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে এমআইবি’র সভাপতি ও দেশের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশনের চেয়ারম্যান একে এম আরিফুর রহমান বলেন, ‘বাংলা গান যদি হিন্দির প্রভাবে আবার ঢাকা পড়ে যায়, তাহলে আর আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি থাকবে না। আবারও আমাদের ঘরে ঘরে বিয়ে, উৎসবে বাজবে হিন্দি আইটেম গান। অথচ খেয়াল করুন, গত পাঁচ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নাচের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিয়ের উৎসবেও এখন বাংলাদেশের গান বাজে।

যেটা বছর পাঁচেক আগেও ছিল স্বপ্নের মতো। তারচেয়ে বড় বিস্ময় রবি এই কাজটির মাধ্যমে আমাদের উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশকেও বৃদ্ধাঙুলি দেখালো! আমরা এর বিচার চাই।’

এদিকে দেশের অন্যতম প্রযোজক (ধ্রুব মিউজিক স্টেশন) ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ধ্রুব গুহ বলেন, ‘সবার আগে দেশকে রক্ষা করতে হবে। দেশের গান ও সংস্কৃতি রক্ষার মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। দেশের সংস্কৃতি বিকিয়ে, হিন্দি গান ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমাদের রেভিনিউ বাইরে চালান হয়ে যাবে- এটা তো হয় না।'

দেশে হিন্দি গানের প্রবেশ প্রসঙ্গে অনুপম রেকর্ডিংয়ের প্রধান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘চার দশক ধরে চলচ্চিত্রের গানগুলো আমি কিনেছি। মাঝে লম্বা সময় প্রচণ্ড হতাশার মধ্যে কেটেছে। কারণ, ইনভেস্টমেন্ট করে বসে আছি কিন্তু গান তো শোনানোর সুযোগ পাই না। চারদিকে শুধু হিন্দি সিনেমার গানের দৌরাত্ম্য। আমাদের মমতাময়ী নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমি মিনতি করে বলছি, প্লিজ বাংলা গানকে হিন্দির গ্রাস থেকে বাঁচান।’

দেশের আরেক জনপ্রিয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিডি চয়েসের কর্ণধার জহিরুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘শুধু গান নয়, আমার প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই বাংলা সংগীত, নাটক ও সিনেমাকে লালন করে আসছি। আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন বিনোদনমূলক কাজগুলোকে খুব সহজে পৌঁছে দেওয়ার। সেই চেষ্টায় তুমুল সাড়াও পেয়েছি। এখন হুট করে আমার সাজানো ঘরে ভারতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কনটেন্ট এসে যদি খেয়ে ফেলে- তাহলে কী হবে?

আমরা পথে বসে যাবো। এই বাংলা নাটক-সিনেমা-গানের বিকাশের জন্য কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছি আমরা প্রযোজকরা। মহামান্য আদালতের স্থগিতাদেশও আছে আমাদের বাংলা সংস্কৃতির পক্ষে। অথচ এর সবকিছু তুচ্ছ করে একটি প্রতিষ্ঠান হিন্দি গানের বাণিজ্য শুরু করে দিলো! এই পরিস্থিতিতে আমরা যদি এক না হই, প্রতিবাদ না করি- তাহলে কে করবে। এখানে শোবিজ সংশ্লিষ্ট সবার সাপোর্ট দরকার।’

ঈগল মিউজিকের প্রধান কচি আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের গান ও সংস্কৃতি বাঁচানোর জন্য হিন্দির বিরুদ্ধে একটা স্থগিতাদেশ আছে। সেটি দেশে বাস্তবায়নও হয়েছে। সেসব উপেক্ষা করে মোবাইল প্রতিষ্ঠান রবি ও জি ফাইভ সাবকন্টিনেন্ট কনটেন্ট বিপণন শুরু করে দিলো! এটা আদালত অবমাননা, এটা দেশদ্রোহিতা। আমি এই দেশে হিন্দি গানের বিচরণ দেখতে চাই না।’

এদিকে সংগীত প্রযোজকদের সংগঠন এমআইবি’র মহাসচিব ও সিএমভি’র কর্ণধার এসকে সাহেদ আলী এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলা নাটক, সিনেমা আর গানের ইন্ডাস্ট্রি বাঁচানোর জন্য পুরনো যুদ্ধটা আমাদের আবারও শুরু করতে হচ্ছে। এটাই বড় কষ্টের বিষয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে স্পষ্ট স্থগিতাদেশ পাওয়ার পর, সেটি কার্যকর হওয়ার এত বছর পর আবারও যদি কেউ দিনে দুপুরে এভাবে পুকুরচুরি করে, এই বিচার তাহলে কার কাছে চাইবো আমরা?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া তো এখন আর আমরা কোনো পথ দেখি না। এটা ঠিক, আমরা আবারও আইনের কাছে যাবো। পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করবো। 

এটা ঠিক, আমরা আবারও আইনের কাছে যাবো। পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করবো। কারণ, বাংলা গান ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চলমান এই ষড়যন্ত্রের স্থায়ী সমাধান আমরা চাই।'

এলএ/এমকেএইচ