ভ্রমণ

রাঙ্গামাটির ‘নকাটাছড়া’ ঝরনার সন্ধানে

আমরা ১১ জনের একটি টিম রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার জেটি ঘাট থেকে বিলাইছড়ি যাওয়ার জন্য একটি বোট ভাড়া করে রওনা হয়েছি। বলে রাখি, রাঙ্গামাটি সদর থেকেও বিলাইছড়ি যাওয়া যায় বোটে করে। তবে যারা চট্টগ্রাম বা ঢাকা থেকে শুধু রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলায় যেতে চান, তারা সরাসরি রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় এলে সেখান থেকে বিলাইছড়ি যাওয়া সহজ ও খরচ কিছুটা কম হবে। রাঙ্গামাটি থেকে রিজার্ভ বোট প্রায় ৭ হাজার টাকা, যা কাপ্তাই থেকে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা।

Advertisement

কাপ্তাই থেকে আমরা সকাল নয়টায় বোট ভাড়া নিয়ে রওনা হলাম বিলাইছড়ি উপজেলার উদ্দেশে। যাওয়ার পথে বিশাল কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জল আর আকাশচুম্বী সবুজ পাহাড়ের দেখা মেলে। জল, পাহাড় আর আকাশের এ মিলন যে কোন ভ্রমণপিপাসুর মনে দোলা দিয়ে স্বাগত জানায়।

বিলাইছড়ি যাওয়ার পথে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্রের তিনটি ফটোকপি সাথে নিতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বিলাইছড়ির প্রবেশমুখ গাছকাটাছড়া সেনাবাহিনী ক্যাম্পে জমা দিয়ে অনুমতি নিতে হবে। তা না হলে বিলাইছড়ি উপজেলায় প্রবেশ করা যাবে না।

সেখান থেকে অনুমতি নিয়ে বিলাইছড়ি উপজেলা সদরে এসে পৌঁছলাম সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ। বিলাইছড়ি উপজেলা সদরে বেশ কয়েকটি বোডিং বা হোটেল রয়েছে। সেখানে রুম নিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে ভাড়া করা বোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ‘নকাটাছড়া ঝরনার’ উদ্দেশে। আবারও সেই হ্রদ আর দূর পাহাড়ের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে প্রায় ৪০-৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বাঙ্গালকাটা আদামের ঘাটে (আদাম অর্থ গ্রাম)।

Advertisement

সেখান থেকে স্থানীয় গাইড সুমন চাকমা আদামের পাশ দিয়ে একটি ছড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল ঝরনার দিকে। যাওয়ার পথে পাহাড়িদের বসতবাড়ি, জুমের খেত পেরিয়ে কখনো পাহাড়ের উঁচু-নিচু রাস্তা আবার কখনো ছড়ার উপর দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় অসংখ্য নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে চলতে হয়। যাওয়ার পথটিতে যেন রোমাঞ্চকর কিছু দৃশ্যের দেখে মেলে। দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত পাহাড় আর পাহাড়ের সবুজ গাছপালা যেমন সুন্দর; তেমন ছড়ার কিছু কিছু অংশের জল প্রবাহের দৃশ্য মনকে কোন এক অচিন রাজ্যে নিয়ে যায়।

ছড়ার মধ্যে যাওয়ার রাস্তাটি মাঝে মাঝে কিছুটা পিচ্ছিল। তবে মসৃণ পথ দিয়ে ছড়ার প্রবাহমান জলের অসাধারণ সুর শুনতে শুনতে, তার এঁকেবেঁকে যাওয়া জলের রূপ দেখতে দেখতে মূল ঝরনার দিকে এগিয়ে যেতে হয়। এসময় কিছু অংশে ছড়ার হাটু পানিতে যেমন নামতে হয়, আবার তেমনই পাহাড়ি গাছের লতা দিয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে যেতে হয়।

পাহাড়ি ছড়ার এ পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতির নানা রূপ ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটলে পৌঁছে যাবেন মূল নকাটাছড়া ঝরনার কাছে। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে অজস্র জল পড়ার দৃশ্য আর জলের শব্দ প্রকৃতিপ্রেমীকে আরও প্রেমিক করে তুলবে। ছড়ার মধ্য দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া ঝরনার জল যেমন সুন্দর, তার চেয়ে প্রায় তিনশ ফুট উপর থেকে গড়িয়ে পড়া জল আরও অপরূপ।

দুই দিকে বড় বড় গাছপালায় ভর্তি পাহাড়। পাহাড়ের ভাঁজে অপরূপ জল পড়ার এ দৃশ্য যেন স্বর্গ-সুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। নকাটাছড়া ঝরনায় আধ ঘণ্টার মত থাকলেই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা আরও বেশি গভীর হবে।

Advertisement

স্থানীয় যুবক সুমন চাকমা জানান, প্রতি বছর এ সময়ে বিলাইছড়ির নকাটাছড়া ঝরনা দেখার জন্য অসংখ্য পর্যটক আসেন। স্থানীয়রা গাইড হিসেবে তাদের ঝরনা ঘুরিয়ে দেখান। এখানে প্রায় ৩০টি পরিবারের বসবাস। তাদের প্রধান আয় হচ্ছে জুম চাষ। পর্যটকরা এলে তাদের সেবা দিলে কিছু বাড়তি উপার্জন হয়।

আইস অন বাংলাদেশের সিইও সাকিব মাহমুদ বলেন, ‘রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ঝরনা। আমি গত তিন বছর ধরে এখানে পর্যটক নিয়ে আসছি। বাংলাদেশের অনেক ঝরনা দেখেছি। কিন্তু সেগুলো থেকে বিলাইছড়ির ঝরনাগুলো অরেক বেশি সুন্দর।’

স্থানীয়রা মনে করেন, এখানে পর্যটন শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রশাসনকে নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়ে আরও কাজ করা প্রয়োজন। স্থানীয় কমিউনিটিকে উন্নত করার জন্য নজর দিতে হবে।

বিলাইছড়ি উপজেলা সদরে থাকার জন্য যে হোটেলগুলো রয়েছে সেগুলোর ভাড়া পড়বে ১৫০-২০০ টাকা। এখানে খাবার জন্য রুচিশীল ব্যবস্থাও করে থাকেন স্থানীয়রা। তবে এখন হ্রদের পানি বেশি থাকায় সুস্বাদু মাছও খেতে পারবেন।

সাইফুল উদ্দীন/এসইউ/এমকেএইচ