আইন-আদালত

জাহালম কাণ্ড : যেসব সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে

পাটকল শ্রমিক জাহালমকে আবু সালেক রূপে চিহ্নিত করতে দায়ী কে সে বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ প্রতিবেদন দাখিল করে।

Advertisement

প্রতিবেদন দাখিলের পর বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ শুনানির জন্য মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দিন ঠিক করেছেন।

আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। জাহালমের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল বাশার।

জাহালমের মামলায় তদন্ত বিষয় কী ছিল

Advertisement

প্রতিবেদনের শুরুতেই আসামি আবু সলেকের পরিবর্তে জাহালম, জাহালমের বিরুদ্ধে ২৬ মামলার বর্ণনা। অন্য অংশে জাহালমকাণ্ডে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অন্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা এবং তাদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনা রোধে অনুসন্ধান ও তদন্ত পদ্ধতিতে কী কী নতুনত্ব আনা যায় তার সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

তদন্তে যাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছে

তদন্তকারী কর্মকর্তা সেলিনা আক্তার মনি (উপপরিচালক), মো. মাসুদুর রহমান (উপপরিচালক), শেখ মেসবাহ উদ্দিন (উপপরিচালক), নাজমুচ্ছায়াদাত (উপপরিচালক), দেবব্রত মণ্ডল (উপপরিচালক), এ এস এম সাজ্জাদ হোসেন (উপপরিচালক), সুমিত্রা সেন (সহকারী পরিচালক), রাফী মো. নাজমুস সাদাত (সহকারী পরিচালক), মেফতাহুল জান্নাত (সহকারী পরিচালক), মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন (সহকারী পরিচালক), মো. সাইদুজ্জামান (সহকারী পরিচালক) ও সিলভিয়া ফেরদৌস ছাড়াও এ সংক্রান্ত ৩৩ মামলার বাদি ও প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কমিশনের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, তদন্তকারী কর্মকর্তা সাবেক মহাপরিচালক কাজী শফিকুল আলম, মো. বেনজীর আহমদ ও উপপরিচালকেদের জিজ্ঞাসা করা হয়।

এছাড়া জাহালমকে আবু ছালেক হিসেবে শনাক্তকারী ব্র্যাক, ইউসিবিএল, সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা, টাঙ্গাইলের ধুবুড়িয়া ও সালিমাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সফিকুর রহমান খান ও মো. আজহারুল ইসলাম মন্টু, বিচারকি আদালতে কমিশনের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের (পিপি) বক্তব্য নেয়া হয়।

Advertisement

এর আগে গত ১৭ এপ্রিল জাহালমকে জেলে নেয়ার ঘটনায় কে বা কারা দায়ী তা দেখার জন্য দুদকের প্রতিবেদন চেয়েছিল হাইকোর্ট। আদেশ অনুযায়ী নির্ধারিত দিন বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদের ২৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়।

আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমকে আসামি করার বিষয়ে বলা হয়, ৩৩টি মামলা করার আগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। পুলিশ মামলার তদন্ত শুরু করে। এরপর তদন্তের জন্য দুদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জাহালমের মামলার নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাপক প্রকৃতির (বিপুল পরিমাণ রেকর্ডপত্র ও অধিকসংখ্যক ব্যক্তির সম্পৃক্ততা) অভিযোগের পর কোনো অনুসন্ধান দল গঠন না করে একজন মাত্র অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাও বিষয়টি কমিশনের নজরে আনেননি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি মামলার পরিবর্তে ৩৩টি মামলা দায়ের এবং মামলার ঘটনাস্থল পরিবর্তন করে ফেলার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্ন জড়িত ছিল। অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদারককারী কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক বিষয়টি লিগ্যাল অনুবিভাগের আইনগত মতামত গ্রহণ করেনি।

মতামত গ্রহণ করলে এ ভুল এড়ানো সম্ভব হত। এ ভুলের জন্য অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল-জাহিদ, তদারককারী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুক কিংবা সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক হনিফ ইকবাল দায় এড়াতে পারেন না।

এছাড়া কোনো আসামির ঠিকানা যাচাই না করে, সরেজমিনে না গিয়ে শুধুমাত্র ব্যাংকের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা তার অনুসন্ধান প্রতিবেদন দিয়েছিলেন যা দুদক বিধিমালা ২০০৭ অনুসরণ করা হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আবু সালেকসহ অন্যদের ধরিয়ে দিতে ছবি দিয়ে পত্রিকা বা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেয়া যেত, তা করা হয়নি, জাহালমসহ অন্য আসামিদের মুখোমুখী করা হয়নি, জাহালমের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করা হয়নি। ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে যাচাই না করা, আত্মসাৎ করা টাকার গন্তব্যের তথ্য সংগ্রহ না করা, আইন অনুযায়ী ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত না করা।

এছাড়াও বলা হয়, মামলাগুলোতে ১২ জন তদন্ত কর্মকর্তার মধ্যে কেউই জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেননি। করলে জাহালমের বাড়ির দৈন্যদশা দেখে তদন্ত কর্মকর্তাদের মনে অবশ্যই সন্দেহ দেখা দিত। এই তদন্তকারী কর্মকর্তারা নবীন হওয়ায় দক্ষতার অভাব ও যথাযথ তদারকি না করার কারণে এ ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান মো. আব্দুল ওয়াদুদ প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘সার্বিক বিবেচনায় আমার নিকট প্রতীয়মান হয় যে, জাহালমকে আবু সালেক রূপে চিহ্নিত করার যে ভুল হয়েছে তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভুলের কারণেই ঘটেছে। আর তাদেরকে ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং অ্যাকাউন্টের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয় দানকারীরা। তবে, সঠিক ঘটনা উদঘাটন করে আদালতের নিকট তা উপস্থাপন করাটাই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব।

এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর বা অন্য কারো ওপর এ দয়িত্ব অর্পণ করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এটা লক্ষ্য করা উচিত ছিল যে, প্রথমে কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা কিংবা অ্যাকাউন্টের শনাক্তকারীরা আবু সালেককে শনাক্ত করতে কিংবা তাকে খুঁজে বের করতে তৎপর হয়নি।’

যেসব সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে

# অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা (অনুসন্ধান তদারকি প্যানেল) করা।

# ট্রেইল দ্য মানি (কোনো দুর্নীতির অপরাধ সংঘটনের পর ওই ঘটনার প্রকৃত সুবিধাভোগী নির্ধারণ এবং আইনের আওতায় আনার জন্য) প্রতিষ্ঠা করা।

# অপরাধ লব্ধ সম্পদের গতিবিধি অনুসরণ করে মূল অপরাধী শনাক্তের লক্ষ্যে ফরেনসিক অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা।

# সাক্ষী ও আসামিদের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই করা। এ জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের তথ্য ভাণ্ডার ব্যবহার করা যেতে পারে।

# অনুসন্ধান নোটবই ও কেস ডায়রি যথাযথভাবে লেখা ও সংরক্ষণ করা।

# গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের রিমান্ডে এনে ব্যাপক ও নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের ব্যবস্থা করা।

# একই ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের না করা।

# সাক্ষ্য হারিয়ে যাওয়া এবং আসামিরা পালিয়ে যেতে পারে এ কারণে মামলার তদন্ত গোপনে দ্রুত শেষ করা।

# দুদক আইনজীবীদের সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা করা। একই আদালতে বিচার চলার পরও কিছু মামলায় জাহালমকে পলাতক আবার কিছু মামলায় হাজির দেখানো হয়েছে। দুদকের আইনজীবীর এ রকম নানা শৈথিল্য তুলে ধরা হয়েছে।

# গুরুত্বপূর্ণ আদেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমিশনকে অবহিত করা।

# বিভাগীয় মামলায় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিশনকে অবহিত করা এবং

# একই ঘটনায় একাধিক মামলা করার বিষয়ে লিগ্যাল অনুবিভাগের মতামত নিতে হবে।

প্রসঙ্গত, সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের করা ৩৩ মামলায় বিনা অপরাধে তিন বছর কারাভোগ করেন টাঙ্গাইলের পাটকল শ্রমিক জাহালম। ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এক আইনজীবী বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে আদালত সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের মামলা (৩৩ মামলা) থেকে জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে সেদিনই মুক্তি দিতে নির্দেশ দেন। ওইদিন রাতেই গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম।

এফএইচ/এএইচ/এমকেএইচ