মতামত

আমার মেয়েটিকে কেন মেরে ফেলা হলো?

সাত বছরের একটি মেয়ে। বড়সড় একটি পুতুলের মতো দেখতে সে। পুতুলের মতো মেয়েটি ছোটাছুটি করে সারা বাড়ি মাথায় করে রাখতো। সাত বছরের শিশুরা যেমন হয়! মেয়েটি স্কুলেও যাওয়া শুরু করেছিল। তার খাতার পাতায় এখনও জ্বলজ্বল করছে সদ্য লিখতে শেখা গোটা গোটা হাতের লেখা। গত ঈদে কেনা রঙিন ফ্রকটি এখনও তার আলমারিতে ভাঁজ করা আছে। তার পানি খাওয়ার মগ, ভাত খাওয়ার থালা, স্কুলের ব্যাগ সবই তেমন আছে। শুধু মেয়েটি নেই। নেই মানে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তারও আগে ধর্ষণ করা হয়েছে তাকে। লিখতে গিয়ে হাতটা একটু কেঁপে উঠলো কি! হয়তো! সাত বছরের একটি মেয়ে, যে এখনও জীবনকে চিনতেই শুরু করেনি, তাকে কি না মেনে নিতে হলো মৃত্যুর মতো করুণ উপসংহারকে! তারও আগে সহ্য করতে হলো পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অত্যাচারকে!

Advertisement

অপরাধী ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ এক যুবক। এই বয়সের যুবকেরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করে। নিজের একটা পরিচয়, বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন তৈরির চেষ্টা করে। এই বয়সে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, কেউ ব্যবসা শুরু করে, কেউ শ্রমিকের কাজ করে। তাই বলে একটা মানুষ খুন? খুনি এই যুবকটি কি জানতো তার মধ্যে বাস করছে এক খুনি সত্তা! তার এই খুনি সত্তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। যে কোনোভাবেই হোক, যুবকটির ভেতরে এই বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে একটি খুন করলে কিছুই হয় না! যেন খুন করা খুব স্বাভাবিক একটি কাজ। যেন চাইলেই যে কাউকে মেরে ফেলা যায়! পেশাদার খুনি না হয়েও যখন তখন যে কাউকে মেরে ফেলার মতো এমন অনেক খুনিই আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো একটি খুনের ঘটনা ঘটলেই কেবল আমরা তাদের দেখতে পাই। হয়তো আপনার-আমার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এই অসহশীল সত্তা, আগামী দিনের খুনি!

নতুন একটি অপরাধ এসে আড়াল করে দিচ্ছে পুরনো অপরাধের খবর। আমরা দেখছি, শুনছি, চুপ করে থাকছি। যেন অন্যায়কারীরাই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। আমরা নুসরাতকে আগুনে পুড়ে মরতে দেখেছি, রিফাতকে ধারালো দায়ের কোপে রক্তাক্ত করে মারা হয়েছে, ছোট্ট সায়মাকে ধর্ষণ করে গলায় রশি পেঁচিয়ে মারা হলো- সবই আমরা দেখছি। এই অনুভূতিহীন আমরাই আসার সুযোগ করে দিচ্ছি আগামীদিনের খুনিদের। যেদিন থেকে আমরা অন্যায় ও অবিচার মেনে নিতে শিখেছি সেদিন থেকেই আমরা মেরুদণ্ডহীন। আমাদের চুপ থাকার কারণেই ধ্বংস হতে বসেছে সমাজ। শ্বাপদসংকুল পরিবেশে থেকেও আমরা তৃপ্ত, কারণ আমরা এখনও বেঁচে আছি! কারণ রিফাতের গায়ের কোপটা আমাদের গায়ে লাগেনি, গায়ে লাগেনি নুসরাতের আগুনও। শিশু সায়মাকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে, আমাদের মেয়েকে নয়!

সায়মার না হয় মুক্তি মিলেছে এই বিভৎস পৃথিবী থেকে। তাকে আর আমাদের মতো মেরুদণ্ডহীন নির্লজ্জ জীবন বেছে নিতে হবে না। কিন্তু আমরা? আমাদের মুক্তি কবে? ধর্ষণ এবং খুন হওয়ার মাধ্যমেই কি আমাদের মুক্তি মিলবে? কেন একের পর এক অসুস্থ ঘটনা আমাদের আরও অসুস্থ করে দিচ্ছে? কেন আমরা একটু ঠিকভাবে হাসতেও পারছি না। কেন হাসতে নিলেই মনে হচ্ছে, দেশের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ এখন খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে! কেন বিভৎস সব ভিডিও আমাদের স্ক্রিনজুড়ে ভেসে বেড়ায়? বেঁচে থেকেও যে আমরা মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছি, এর দায় কি রাষ্ট্র নেবে না? নাকি বরাবরের মতোই দায়সারা কোনো অজুহাতে লালন করে চলবে এই সব খুনিকে?

Advertisement

সায়মার মায়ের অভিশাপ কি একটুও আঁচড় কাটবে না এই মানচিত্রে? সায়মার বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের যে বোঝা আমরা চাপিয়ে দিয়েছি, সেই ভার সইতে পারবে তো বাংলাদেশ! হয়তো পারবে! এর আগেও তো তনু, রিশা, মিতু, বিশ্বজিৎ, নুসরাত, রিফাতদের ভার সয়ে নিয়েছে। সয়ে নিয়েছে সেই সব হতভাগ্যের লাশ যারা শুধু মৃত্যুই পেয়েছে, বিচারটুকুও পায়নি! আমাদের চোখের জল, আমাদের দীর্ঘশ্বাস, আমাদের অসহায়ত্ব, আমাদের হাহাকার, আমাদের অভিশাপ- সব সয়ে নিতে পারে আমাদের এই দুখিনী দেশ। আর আমরা বেঁচে থাকি তার সেই সব মেরুদণ্ডহীন সন্তান হয়ে, যারা শুধু দেখে আর সহ্য করে যায়, প্রতিবাদ করতে জানে না!#

এইচআর/এমএস