ঘটনা ১. গত সপ্তাহে বিভক্ত বৃহত্তর পরিবারের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সাত দিনের জন্য যেতে হয়েছিল কলকাতায়। ট্রেনে যাচ্ছি। নিরুদ্বিগ্ন জার্নি। তবে ঢাকা স্টেশনে ইমিগ্রেশন ও কাস্টম ক্লিয়ারেন্সের জন্য মালপত্র নিয়ে লম্বা লাইন করে সুনির্দিষ্ট স্থানে যেতে হয়। সত্তরোর্ধ্ব দম্পতির এতে অসুবিধা হওয়ারই কথা। যাওয়ার সময় যাত্রী সবার সঙ্গে সবকিছু করতে গিয়ে ডায়াবেটিসের রোগী আমি পায়ের আঙুলের কোনায় পেলাম একটা প্রচণ্ড ব্যথা। কলকাতায় নেমে তেমনভাবে লম্বা লাইনের পাল্লায় পড়তে হলো না।
Advertisement
প্রবীণ হিসেবে আগে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। ফিরতি পথেও কলকাতা স্টেশনে প্রবীণ হিসেবে একই সুযোগ পেলাম। কিন্তু ঢাকা স্টেশনে এসে আবার সেই লাইনের পাল্লায় পড়লাম। শেষ প্রান্তে দাঁড়ালাম বটে, কিন্তু সেই একই কাজ করতে গিয়ে যুবকদের তাড়াহুড়ার ভিড়ে ঠেলাঠেলির মধ্যে পড়লাম। এবারে পায়ে চোট পেলেন গৃহকর্ত্রী। এই দুই ঘটনার মধ্যে পড়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৯-এর লিখিত প্রবীণ কল্যাণে করণীয় লাইনগুলোর একটি : যানবাহনে প্রবীণদের জন্য আসন/পরিসর নির্ধারণ এবং ওঠা-নামার ব্যবস্থা প্রবীণবান্ধব করা হবে।
ঘটনা ২. মার্চের শেষে নয়াপল্টনের এক দোকানে চুল কাটাতে গেছি। বেশ একটা জমানো আড্ডা সেখানে। দৈনিক পত্রিকা জোরে জোরে পড়ছে আর নিজেদের অভিজ্ঞতা বলাবলি করছে। চুল কাটাছিলাম আর তাদের কথা শুনছিলাম। খুব উচ্ছ্বসিত তারা। বুড়িগঙ্গা-তুরাগ তীরে অবৈধ স্থাপনার উচ্ছেদ অভিযান চলছে। হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা ভাঙা হচ্ছে। কেউ পত্রিকার ছবি দেখছে।
আবার কেউ নিজেরা স্বচক্ষে কী দেখেছেন, তার বর্ণনা দিচ্ছেন। একজন বগুড়ার বাড়ি থেকে ফিরেছেন, তিনি করতোয়া পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বর্ণনা দিলেন। যশোরের একজন ভৈরব নদীর পাড়ের উচ্ছেদ অভিযানের খবর জানালেন। চোখ বুজে চুল কাটাতে কাটাতে মনচোক্ষে ভেসে উঠল আওয়ামী লীগের সেই নির্বাচনী ইশতেহার : নদী ও খালগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করে খননের মাধ্যমে নাব্য ফিরিয়ে এনে নদী তীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হবে।
Advertisement
প্রসঙ্গত বলি, দ্বিতীয় ঘটনাটির পর সরকারি কাজে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে যেভাবে খুশি ও তৃপ্ত হয়েছিলাম, তা প্রকাশ করে এ বিষয়ে ভোরের কাগজে পরবর্তী কলামটা লিখতে চাইছিলাম। কিন্তু অন্য ইস্যু সামনে এসে পড়ায় তা নিয়ে আর লেখা হয়নি। পরবর্তী সময়ে এপ্রিলের শেষ দিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) যখন নতুন সরকারের ১০০ দিন ‘উদ্যমহীন, উচ্ছ্বাসহীন ও উদ্যোগহীন’ বলে অভিহিত করে তখনো দ্বিতীয় ঘটনাটিসহ আরো কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওই যে, লেখার বিড়ম্বনা!
ইস্যু ঠিক করা! মে দিবসের দিন ভোরের কাগজের লেখা সুনির্দিষ্ট থাকায় মানুষের ওই উচ্ছ্বাস আর সিপিডির ওই হতাশা নিয়ে আর লেখা হয়নি। পরের সপ্তাহে তো কলকাতায়ই ছিলাম। কলকাতা যাতায়াতের সময় উল্লিখিত প্রথম ঘটনার মুখোমুখি হওয়ায় ইশতেহারের বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষুদ্র এ কলামে কিছু কথা লিখতেই হলো।
এবারের নির্বাচনের পর সরকার প্রথম ১০০ দিনের কোনো ত্বরিত কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। ২০১৪ সালে নির্বাচনের পরও ওই ধরনের কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বলে মনে পড়ে না। তবে যতটুকু মনে পড়ছে ২০০৯ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। ধারণা করা যায়, ভিন্ন প্রেক্ষাপট তথা সম্পূর্ণ নতুন সরকার এবং ধারাবাহিক সরকার থাকার কারণে এমনটা হয়েছে।
এখন পরিস্থিতি বিশেষত সমালোচনার পর ভাবছি, এমনটা করাই হয়তো ভালো ছিল। মন্ত্রিসভায় পুরনো ও অভিজ্ঞ ৩৬ জনকে বাদ দিয়ে নতুন ৩১ জনকে যুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমেই যে চমক দেখিয়েছিলেন, তেমনি ১০০ দিনের কর্মসূচি ঠিক করে তা বাস্তবায়ন করার পথে গিয়ে চমক সৃষ্টি করলে মন্দ হতো না। চমক যে মানুষ চায়, এটা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সুস্পষ্ট। আর বলাই বাহুল্য, রাজনীতিতে বিশেষত জনগণকে উদ্দীপ্ত, উৎসাহিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে চমক লাগেই।
Advertisement
কলামটা যখন লিখছি তখন ভাবছি, সরকার যদি চমক সৃষ্টি করতে যাতায়াত বিষয়ে প্রবীণদের জন্য উল্লিখিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করত, তবে আমার পরিবার উপকৃত হতো। দুজনে দুবার পায়ে ব্যথা পেতাম না। আর চরম হাসিনাপন্থি গৃহকর্ত্রীর কাছ থেকেও বাক্যবাণ শুনতে হতো না, ‘বইপত্রে লেখা থাকলে কি হবে? লিখে কি হবে? কাজ তো করতে হবে? রেলে এই ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে কি শেখ হাসিনাকে লাগে নাকি? মন্ত্রীরাই তো এক কলমের খোঁচায় তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। এটা কি খুব কঠিন কাজ! শেখ হাসিনা করলে হবে আর না করলে হবে না, এমনটা হয় নাকি!’
এমন কথা থেকে সহজেই বোঝা যায়, সিপিডির বক্তব্যের প্রতিধ্বনি গণমানুষের কথার মধ্যে রয়েছে। সিপিডির পক্ষ থেকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং বিগত ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ আমলে সরকারি জনতা ব্যাংকের পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নতুন সরকারের ১০০ দিনের কর্মসূচি নিয়ে কঠোর ও কঠিন বিরূপ সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আমি মনে করি সাম্প্রতিক সময়ে যত নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বর্তমান ইশতেহার সব থেকে সুচিন্তিত, সুলিখিত এবং সুগঠিত।
তবে সেই অনুযায়ী বিগত ১০০ দিনের কাজে তেমন কোনো বড় উত্থান দেখিনি। আমরা যেটা লক্ষ করেছি গতানুগতিক ধারাবাহিকতা।’ কঠিন ও কঠোর এবং সার্বিক বিচারে হতাশা সৃষ্টিকারী সমালোচনার সঙ্গে অবশ্য তিনি সরকারের কিছু ভালো উদ্যোগও তুলে ধরেছেন, যা অনেক পত্রিকা উল্লেখও করেনি। ভালো কোনো কাজ উল্লেখ করা কিংবা ভালো কিছুকে এগিয়ে দেয়া যেন প্রচার জগৎ থেকে উঠে যাচ্ছে! তিনি বলেছেন, ‘এই ভালো উদ্যোগগুলোর মধ্যে আছে, বিদেশি কর্মজীবীদের বিষয়ে জরিপ চালিয়ে করের আওতায় আনার উদ্যোগ, অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং বিধিমালা জারি করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিজ্ঞাপনকে করের আওতায় আনা।’
আওয়ামী লীগ যে যথোপযুক্ত ইশতেহার দিয়েছে এবং এই কাজগুলো করেছে, তা সিপিডি তুলে না ধরলে এবং কিছু পত্রিকায় ওই প্রচার না এলে তা শুধু দেশবাসী কেন, আমার মতো একজন আওয়ামী লীগ কর্মী বিবেচনায়ও নিতে পারত না। তবে এ ক্ষেত্রে বলতেই হয়, নতুন সরকারের দেশব্যাপী দখল উচ্ছেদ অভিযান, যা গণমানুষকে আন্দোলিত করছে, যা জনস্বার্থে অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়, যা নিয়ে সুশীল সমাজ অতীতে অনেক সময়েই ছিল সোচ্চার; তা সিপিডি এড়িয়ে গেল কীভাবে? এ ঘটনায় সুশীল সমাজ সরকারের পক্ষে সোচ্চার হলো না কেন? সভা-সমাবেশ বক্তৃতা-বিবৃতি দেখা গেল না কেন? অপরাধী আমিও! অন্তত একটা কলাম লিখলাম না কেন?
এবারের উচ্ছেদ অভিযানকে কি ‘গতানুগতিক ধারাবাহিকতা’ বলা যাবে! বলাই বাহুল্য, আমিও এই ইস্যু নিয়ে ভাবতামই না, যদি না ওই দিন চুল কাটার সময় ওই ঘটনার অংশীদার হতাম। দেশের অনেক স্থানে টেলিফোন করে জেনেছি, এই উচ্ছেদ অভিযানে মানুষ খুব খুশি। তবে একটা প্রশ্ন কমবেশি মানুষের আছে আর তা হলো, ‘আবার তো সরকারি দলের নামধারি ভূমিদস্যুরা তা দখল করে নেবে।’
সিপিডি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পরিবর্তনের, দিন বদলের। আর ওই বদলকে আটকে রাখছে এমন এক গোষ্ঠী, যারা এই দুর্নীতি থেকে সুবিধা ভোগ করছে। সুবিধাভোগী সম্প্রদায় যেটা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে আছে, সেটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের শক্তিকে সামনে আসতে দিচ্ছে না। এটাকে যদি সমাধান করা না যায়, তাহলে আওয়ামী লীগের সুচিন্তিত, সুলিখিত ও সুগঠিত ইশতেহার কাল্পনিক দলিল হিসেবেই ইতিহাসে স্থান পাবে।’ তাত্ত্বিকভাবে এটা তো স্বতঃসিদ্ধ যে, ক্ষমতাকে ঘিরে সবসময়েই ভালো-মন্দ, নানা স্বার্থের জনগোষ্ঠীর টানাপড়েন থাকে। যে বা যেসব গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি সংঘবদ্ধ থেকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে, নীতি-কর্মসূচি যা-ই থাকুক সেই দিকেই সরকার ঝুঁকে পড়ে। চাপ প্রয়োগ ও স্বার্থ আদায় ক্ষমতার রাজনীতিতে স্বাভাবিক।
এটা তো ঠিক যে, দখলে রয়েছে গণশত্রুর স্বার্থ আর দখল উচ্ছেদ অভিযানে রয়েছে গণস্বার্থ। সরকারের কাজে দেশের স্বার্থে যদি জনগণ সচেতনতা নিয়ে সংঘবদ্ধ না হয়, তবে ভূমিদস্যুরা যেহেতু প্রভাবশালী এবং মন্দ-চেইন যেখানে সক্রিয়, সেখানে নদীর পাড়গুলো পুনঃমুসিক ভব হতেই পারে। কোনো কোনো নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলেন, ‘সরকারের কর্মসূচির পক্ষে দাঁড়ালে তো সরকার পক্ষ হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত হয়ে যেতে হবে। তাতে সমদূরত্বের নীতি নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হওয়া যাবে না।’
এই মত যথার্থ সুশীল সমাজ হওয়ার ক্ষেত্রে চরমতম বাধা। ভালো কাজের পক্ষে, খারাপ কাজের বিরুদ্ধে এটাই তো জাতির বিবেক সুশীল সমাজের নীতি হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে তাল কাটছে। প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে প্রবাদের মতো সরকারের ভালো কাজের পক্ষে দাঁড়াবে কে? সর্বোপরি এটাই দুর্ভাগ্যজনক হলেও তো বাস্তব সত্য যে, সরকারি দলও অবৈধ দখলমুক্ত করার কর্মযঞ্জে সরকারের কাজের পক্ষে মাঠে নামেনি। ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলের নেতাকর্মী বিশেষত কমিটিগুলোর উচিত, মানুষের প্রতি কান পেতে বোঝা দরকার কী বলেন তারা!
এখানে এককথায় বলতেই হয়, সিপিডি সরকারের ১০০ দিনের ভালো কাজের কথা যা বলেছে, তা বাদেও ভালো কাজ যেমন আরো আছে, তেমন অনভিপ্রেত কাজও হয়তো আরো খুঁজে পাওয়া যাবে। আর তথ্য ও পরিসংখ্যান! এদিক-ওদিক সাজিয়ে দিনকে রাত ও রাতকে দিন করা খুবই সহজ। তাই মানুষের জীবন ও জীবিকার দিকে তাকাতে হয়। গণবিচ্ছিন্নতা তথা কেবল বইয়ের পাতা সবকিছুকে বুঝতে দেয় না। অতীতের দিকে তাকিয়ে অন্তত এটুকু বলা যায়, মানুষের জীবন ও জীবিকার সমস্যা ও সংকট এখন অন্তত ‘আর্মি ও সুশীল সমাজ ব্যাকড’ মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের মতো এখন নেই।
যে সময়ে মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে সুশীল সমাজ ড. ইউনূসকে নিয়ে কিংস পার্টি গঠনে উৎসাহী ও উদ্যোগী হয়ে উঠেছিল। তবে দ্বিধাহীন চিত্তে বলতেই হয়, সাধ ও সাধ্যের পার্থক্য চিরায়ত। সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা থেকে কখনো সাফল্য ও সবলতাকে পৃথক করা যায় না। ক্ষমতায় থেকে কেউ যদি গণস্বার্থে কিছু করার চিন্তা করেন, তবে সেই পার্থক্য অনুধাবন করতে পারবেন।
নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এবারের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমরা সংকল্পবদ্ধ। তিনি নির্বাচনের আগে এটাও বলেছিলেন, মন্ত্রী-নেতাদের কাছে তিনি ইশতেহার দিয়ে দেন এবং মাঝে মাঝেই পর্যালোচনা করা হয়, কতটুকু বাস্তবায়িত হয় নির্বাচনী ইশতেহার।
যদি তেমনটা হয়, তবে বাস্তবায়িত হবে না কেন এবারের নির্বাচনী ইশতেহার? কেন ইশতেহার হবে কল্পনাবিলাসী? প্রকৃত বিচারে কল্পনা নিয়ে মাথা ঘামানো বা দোদুল্যমানতার সময় এখন নয়। এখন বাস্তবায়নের সময়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী জাতি পালন করতে চায় সফলতা ও সার্থকতা এবং গৌরবের ঝাণ্ডা উড়িয়ে।
লেখক : রাজনীতিক।
এইচআর/জেআইএম