ইনিংসের ১৩তম বলে নামতে হলো মাঠে, স্কোরবোর্ড তখন ৩ রানে ২ উইকেট দেখালেও টেকনিক্যালি বাংলাদেশ তখন ৩ রানে ৩ উইকেট হারানো দল। মুখোমুখি প্রথম বলে লাকমলের ওভারে নিলেন একটি সিঙ্গেল। পরের ওভারে মোকাবেলা করতে হলো সেরা ছন্দে থাকা মালিঙ্গাকে। প্রথম দুই বল তেমন স্বচ্ছন্দে খেলতে পারলেন না।
Advertisement
তৃতীয় বলে করতে গেলেন ফ্লিক, হয়ে গেল লিডিং এজ, চলে গেল মিড অনে দাঁড়ানো অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজের হাতে। লেট ডাইভ দেয়ায় বল হাতে রাখতে পারলেন না ম্যাথুজ। ব্যক্তিগত ইনিংসের চতুর্থ বলেই জীবন পেলেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন ছুটছে সমালোচনার তীর। একেকজনের ভাষ্য, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার যোগ্যই নন তিনি’, ‘মুমিনুলের চেয়ে ভালো পানি টানতে পারতেন তিনি’, ‘শুধু শুধু এসব ব্যাটসম্যানদের সুযোগ দেয়ার কোন প্রয়োজনই নেই।’ মাঠে বসে বা ম্যাচ শেষেও এসব দেখার সুযোগ ছিলো না তার।
সে ওভারে তার ক্যাচ ছুটলো আরও একবার। তবে এবার ওয়েস্ট হাই নো বলে। জুসি ফুলটস বাউন্ডারি ছাড়া করার বদলে ফাইন লেগ সীমানায় ক্যাচ দিয়ে বসেছিলেন তিনি। ভাগ্য ছিলো তার সাথে। ক্যাচ ছেড়ে দেন সেখানকার ফিল্ডার, আম্পায়ারও ডান হাত প্রসারিত করে জানান দেন অবৈধ ছিলো মালিঙ্গার করা এ ডেলিভারিটি। নো বল।
Advertisement
তার দু’বার জীবন পাওয়াটা যেন ভালোভাবে নিতে পারলো না বাংলাদেশ ক্রিকেটের অতি ‘জাজমেন্টাল’ সমর্থকেরা। আগের চেয়েও বাজেভাবে চলতে থাকে তার সমালোচনা। পরে সুরাঙ্গা লাকমলের বিপক্ষেও তেমন সুবিধা করতে পারলেন না ক্যারিয়ারের মাত্র চতুর্থ ওয়ানডে খেলতে নামা এ ব্যাটসম্যান।
অপরপ্রান্তে মুশফিকুর রহীমকেও মনে হচ্ছিলো খানিক নড়বড়ে। তাই রানের চিন্তা বাদ দিয়ে মুশফিক ঢুকে যান খোলসে, বুঝতে চেষ্টা করেন উইকেটের চরিত্র। ওদিকে মালিঙ্গার পুরো একটি ওভার খেলে ফেলেন লেখার আলোচ্য ব্যাটসম্যান। বেশ নড়বড়ে মনে হলেও শেষের দুই বলে নেন ৩ রান। তখনো পর্যন্ত খেলা ১৪ বলে তার রান মাত্র ৬। অপর প্রান্তে মুশফিকের সংগ্রহ ২১ বলে ৫। পরের ওভারে ইনিংসের প্রথম বাউন্ডারিটি মারেন মুশফিক।
নবম ওভারে প্রথমবারের মতো স্পিনার আনেন লঙ্কান অধিনায়ক ম্যাথিউজ। এতেই সাহস ভর করে ১৩ নম্বর বলে উইকেটে আসা সে ব্যাটসম্যানটির ওপর। তবু অপেক্ষা করেন প্রথম পাওয়ার প্লে শেষ হওয়া পর্যন্ত। পাওয়ার প্লে’র দশ ওভারে বাংলাদেশের সংগ্রহ ‘মাত্র’ ২৪ রান। তার সংগ্রহ ১৯ বলে ৯! এগারোতম ওভারের শেষ বলে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে লং অফ ফিল্ডারকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে হাঁকান ইনিংসের প্রথম ছক্কা। একইসাথে জানান দিলেন নিজের জড়তার সমাপ্তির কথাও।
অপর প্রান্তে মুশফিক যখন একপাশ আগলে রাখার মিশনে ব্যস্ত, তখন তিনি শুরু করেন রানরেট ঠিক করার মিশন। আগের খেলা তিন ম্যাচে ব্যাট করেছিলেন দুই ইনিংসে। সর্বোচ্চ ইনিংস ছিলো ২৬ রানের।
Advertisement
নিজের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসকে ছাড়িতে দিতে লং-অফের উপর দিয়ে বিশাল এক ছক্কা হাঁকান তিনি। বল চলে যায় গ্যালারীর দোতলায়। সে ছক্কার পরে মারেন আরও দুটি চার। তার ব্যক্তিগত স্ট্রাইকরেট তখন ১০০, দলের রানরেট প্রথমবারের মতো ছাড়িয়ে যায় চারের কোটা। মুশফিকের সাথে জুটিটাও পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ।
ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতকের সামনে দাঁড়িয়ে খেলতে থাকেন দেখেশুনে। এক-দুই নিয়ে পৌঁছে যান ৪৬রানে, নামের পাশে বল সংখ্যা ৫১। বল হাতে প্রস্তুত সুরাঙ্গা লাকমাল। তার করা বাউন্সার মিস করেই মাঠ ছাড়েন তামিম। উইকেটে আসতে বাধ্য হন তিনি।
অফ-স্ট্যাম্পের বাইরে খানিক জায়গা দিয়ে বলটা করেন লাকমল। সুযোগ পেয়ে কিপারের পাশ দিয়ে আলতো টোকায় গ্লাইড করে দেন প্রথম ফিফটির অপেক্ষায় থাকা ব্যাটসম্যান। শর্ট থার্ডম্যান ফিল্ডারকে সহজেই পার করে বল চলে যায় বাউন্ডারিতে। সে ব্যাটসম্যান ব্যাট উঁচিয়ে ধরেন আকাশ পানে, ধন্যবাদ জানান সৃষ্টিকর্তাকে। ক্যারিয়ারের মাত্র তৃতীয় ইনিংসেই প্রথম হাফসেঞ্চুরি বলে কথা!
পরের ওভারেই তৃতীয় উইকেট জুটিটা ছাড়িয়ে যায় শতরান। যা কিনা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের ১৫০তম শতরানের জুটি। তার দেখাদেখি পঞ্চাশ তুলে নেন মুশফিকও। ফিফটি পেরিয়ে আরও বেশ কিছুক্ষণ ব্যাট করে সেই মালিঙ্গার হাতেই ধরা পড়েন ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি পাওয়া ব্যাটসম্যান। নামের পাশে তখন ৫ চার ও ২ ছক্কার মারে সাজানো ৬৮ বলে ৬৩ রানের ঝলমলে ইনিংস।
তার বিদায়ে নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী বনে যান মুশফিক। মাহমুদউল্লাহ, মোসাদ্দেকদের ব্যর্থতায় আবারো ঘটে বিপর্যয়। মেহেদী মিরাজ, মাশরাফি মর্তুজা, মোস্তাফিজুররা খানিক সঙ্গ দিলে ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সেঞ্চুরিটি পেয়ে যান মুশফিক।
আর পরে ভাঙা কব্জি নিয়েই এক হাতে ব্যাট করতে তামিম নেমে পড়লে বাড়তি সাহস পান মুশফিক। তিনটি করে চার ও ছয়ের মারে করেন ৩২ রান। নিজে থামেন ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ১৪৪ রানে, যা কিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে যান ২৬১ রানে লড়াকু সংগ্রহে।
ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের ১৩৭ রানের বিশাল জয়ে সকল বাহবা পান মুশফিক ও তামিম। তারা এর যোগ্য বলেই পেলেন। তবে আড়ালে পড়ে যান কঠিন চাপের মুখে ব্যাট করতে নেমে ক্যারিয়ারের প্রথম হাফসেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানটি।
মুশফিকের বীরত্ব ও তামিমের সাহসীকতায় ঢাকা পড়ে যায় তার ৬৩ রানের অসাধারণ ইনিংসটি। অথচ জীবন পাওয়ার পরে তিনি যদি তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হতেন, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা হতে পারতো আরও খারাপ। তামিম ইকবাল হাসপাতাল থেকে ফেরার আগেই গুটিয়ে যেতে পারতো দল।
মাত্র ৩ রানের ইঞ্জুরিগ্রস্ত তামিমসহ তিন ব্যাটসম্যানকে হারানো বাংলাদেশকে প্রাথমিক ভরসা দেন তিনিই। তার ব্যাটেই মালিঙ্গার শুরুর ঝড় সামলে নিরাপদ সংগ্রহের ভীত পায় বাংলাদেশ। মুশফিকের বীরত্ব ও তামিমের সাহসিকতার পাশাপাশি তার এই দায়িত্বশীল ইনিংসের মাহাত্ম্য কোনো অংশে কম নয়।
অথচ তাকে ঘিরে নেই কোন আলোচনা, মাতামাতি বা প্রশংসাবাক্য; কিন্তু তার খারাপ সময়ে মাত্র ১-২ ইনিংসের ব্যর্থতাতেই তাকে ব্যঙ্গাত্মক সুরে ডাকা হয়েছে ‘স্যার’ বা ‘লর্ড’ নামে। সে সবের তোয়াক্কা না করে তিনি শানিয়েছেন নিজেকে, রানের ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন ঘরোয়াতে, রান করেছেন ‘এ’ দলের হয়েও।
যার ফলশ্রুতিতে সুযোগ মেলে জাতীয় দলে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রথম ম্যাচেই খেলে ফেলেন দলের সম্মান বাঁচানো ইনিংস। দলকে দেন ভরসার অভয়বাণী। তার এমন ব্যাটিংয়ে পর উচ্চস্বরে বলাই যায়, ‘অভিনন্দন মোহাম্মদ মিঠুন আলী’।
এসএএস/আইএইচএস/