দেশজুড়ে

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের অচলাবস্থা কাটেনি, রাজস্ব ঘাটতি

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও লেবার হ্যান্ডলিং ঠিকাদারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্বের জেরে অচলাবস্থা চলছে তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে। আমদানিকৃত পণ্য ওঠানামায় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের প্রতিবাদে ভারত এবং নেপাল থেকে সব রকম পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছেন আমদানিকারকরা।

Advertisement

এতে কমে গেছে সরকারি রাজস্ব আদায়। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শ্রমিকসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সংকট নিরসনে সোমবার বিকেলে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, আমদানি-রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, ব্যবসায়ী নেতা, শ্রমিক নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা বৈঠকেও কোনো সুরাহা হয়নি। পরে আগামী ৬ জুলাই পর্যন্ত বৈঠক মুলতবি করা হয়।

উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ে তেঁতুলিয়া উপজেলার সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। চতুর্দেশীয় এই বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার পণ্য আমদানি-রফতানি করা হয়। স্থলবন্দরের কার্যক্রমের শুরু থেকে ব্যবসায়ীরা বন্দরের কুলি শ্রমিক দিয়ে টন প্রতি ৩২ টাকায় পণ্য আনলোড এবং টন প্রতি ৫০ থেকে ৫২ টাকা দিয়ে পাথরসহ যেকোনো পণ্য লোড করতেন।

কিন্তু ১ এপ্রিল থেকে এটিআই লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থলবন্দরের লেবার হ্যান্ডলিংয়ের ইজারা নেয়। ১৪ এপ্রিল থেকে প্রতিষ্ঠানটি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভ্যাটসহ পণ্যের ওঠানামা বাবদ টন প্রতি ১২০ টাকা করে নেয়া শুরু করে।

Advertisement

কিন্তু স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এটিআই শুধু পণ্য আনলোড করে দেয়। অজ্ঞাত কারণে তারা বন্দরের ইয়ার্ডে বা বাইরে থাকা পণ্য লোড করে দেয় না। দেড় মাস ধরে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে বন্দরের বাইরের শ্রমিক দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যের লোড করতে লোকসানের মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা।

এ নিয়ে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, লেবার হ্যান্ডলিং ঠিকাদার এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এ ঘটনায় ব্যবসায়ীরা ঈদের পর থেকে পাথরসহ সব রকম পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়।

ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা নির্দেশনা অনুযায়ী টাকা দিতে রাজি। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী পাথরসহ আমদানিকৃত পণ্য লোড করে দিতে হবে। অপরদিকে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার বন্দর ইয়ার্ডের বাইরে পণ্য লোড করে দিতে নারাজ। স্থলবন্দরে এই অচলাবস্থার কারণে গত মে মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।

এছাড়া জুন মাসে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ আরও কম হবে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। এ নিয়ে আমদানি-রফতানিকারক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টসহ বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

Advertisement

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানিকারক হারুন উর রশিদ বাবু বলেন, এর আগে আমরা ৮০ থেকে ৮২ টাকার মধ্যে পাথরসহ সব রকম পণ্য লোড-আনলোড করতাম। এখন ভ্যাটসহ ১২০ টাকা দিয়েও বন্দর কর্তৃপক্ষ আর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আমাদের পণ্য শুধু আনলোড করে দেয়। আমরা তাদের দাবি অনুযায়ী টাকা দিচ্ছি। আমরা চাই শর্ত মোতাবেক তারা যেন আমদানিকৃত পণ্য আনলোড এবং লোড করে দেন। বর্তমানে এই বন্দর দিয়ে আমদানি করা পাথর আমাদের ১০৫ টাকা সিএফটি দরে বিক্রি করতে হয়। অন্যদিকে পাশের স্থলবন্দর বুড়িমারিতে একই পাথর ৯৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সম্ভাবনাময় এই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নাসিমুল হাসান নাসিম বলেন, আমাদের মাধ্যমে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ চাহিদামত টাকা নিচ্ছে। কিন্তু তারা সেই অনুযায়ী সেবা দিচ্ছে না। আমরা এ নিয়ে একাধিকবার তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা আমাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখান। এ কারণে আমদানিকারকরা পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে গত এক দেড় মাসে কী পরিমাণ রাজস্ব কমে গেছে, তা বলে বোঝাতে পরব না।

বাংলাবান্ধা ইউপির চেয়ারম্যান কুদরত এ খুদা মিলন বলেন, বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেছি। একাধিকবার বৈঠকও করেছি। কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ জন্য আমি বন্দর রক্ষায় জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছি। জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আমি আশা করি।

স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. বজলুর রশিদ বলেন, বন্দরে রফতানিসহ অন্যান্য কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। এর মধ্যে ভুটানের ২৮টি পাথরের গাড়ি ছাড়া ঈদের পর আর কোনো আমদানিকৃত পণ্যের গাড়ি বন্দরে ঢুকেনি। এখানে গড়ে প্রতি মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ৫৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। নানা কারণে আমদানি কম হওয়ায় মে মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক কোটি ৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা। জুন মাসে আমদানি শুল্ক আদায়ের পরিমাণ আরও কমতে পারে।

বন্দরের লেবার হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটিআই লিমিটেডের কর্ণধার ও লালমনির হাটের পাটগ্রাম উপজেলা চেয়্যারম্যান রুহুল আমিন বাবুল বলেন, আমরাও সব রকম সেবা দিতে চাই। সেক্ষেত্রে পাথরসহ আমদানিকৃত সব পণ্য বন্দর ইয়ার্ডে লোড-আনলোড করতে হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বন্দরের বাইরে পাথর আনলোড করলে আমাদের লোড করতে সমস্যা হয়। এ জন্য আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে স্থলবন্দরটি সচল রাখার চেষ্টা করছি। সবার সহযোগিতায় দ্রুত সংকট কেটে যাবে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, অবস্থানগত কারণে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সম্ভাবনাময়। এ জন্য স্থলবন্দর রক্ষায় আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। বন্দরে ব্যবসায়ীবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে আমদানি- রফতানিকারকসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি বৈঠক করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও হয়েছে। আশা করা যায়, অল্প সময়ের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

সফিকুল আলম/এএম/জেআইএম