সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত একের পর এক প্রবাসী নারী শ্রমিকদের দেশে ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে আবারও আলোচনায় এসেছে, প্রবাসে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি। প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা নারী শ্রমিকরা বলছেন, কর্মস্থলে তাঁরা নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। জীবনের সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসা এসব নারীদের গল্প শুনে চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন।
Advertisement
অধিক বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে নেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে কম বেতন দেওয়া, ঠিকমতো বেতন না দেওয়া, মানসিক নির্যাতন, জোরপূর্বক যৌনকাজে নিযুক্ত করা, গৃহকর্তার মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হওয়া, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে না দেওয়া, পর্যাপ্ত খাবার ও বিশ্রামের সুযোগ না দেওয়া, ওয়ার্ক পারমিট আটকে রাখা, দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য করা, দেশে স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করতে না দেয়াসহ ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অতঃপর তারা প্রাণ বাঁচাতে কর্মস্থল থেকে পালিয়ে পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে দেশে ফিরে আসছেন।
তেমনই একজন আকলিমা বেগম। গৃহকর্মীর কাজ করতে গত বছরের নভেম্বর মাসে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। মাসপ্রতি একহাজার রিয়াল বেতন দেয়ার কথা থাকলেও ফিরেছেন একেবারে শুন্যহাতে। এসবের সাথে শারীরিক- মানসিক নির্যাতন যেন ছিল তার বাড়তি পাওনা। সৌদি আরবে তিনি যেখানে কাজ করেছেন, সেখানে তাকে ঠিকমত খাবার দেয়া হতো না। কারণে অকারণে মারধোর শিকার হতেন তিনি। মাস শেষে বেতন চাইলেই শুরু হতো তার উপর আরো নির্যাতন। খুন্তির গরম ছ্যাঁকাও পড়েছে তার পিঠে।
কর্মস্থলের অমানসিক এই নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে তিনি সেখানকার পুলিশের কাছে আশ্রয় চেয়েছেন, পুলিশ তাকে জেলে দিয়েছে। তারপর নানা প্রক্রিয়া পার হয়ে শেষ পর্যন্ত শূন্যহাতে দেশে ফিরেছেন। যে পরিবারের শান্তির জন্য তিনি অজানার পথে পাড়ি দিয়েছিলেন, রেখেছিলেন জীবন বাজি, সেই পরিবারেই আজ তার ঠাঁই নেই। এটি বরিশালের আকলিমা বেগমের গল্প। এরকম হাজারো গাঁ শিউরে উঠা গল্প আছে মধ্যপ্রাচ্য ফেরত আকলিমাদের, যা লিখে শেষ করা যাবে না।
Advertisement
অল্প পরিমাণ টাকা খরচ করে বিদেশে শ্রমিক হিসেবে পাড়ি জমানোর সুযোগ তৈরি হওয়ায় এই সময়ে প্রবাসী নারী শ্রমিকের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। পরবর্তী জীবনে একটু নিশ্চিন্ত সুখের আশায়, প্রিয় সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, সন্তান- স্বামী আর আত্মীয়- স্বজন ছেড়ে ভিন দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন তাঁরা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (আইওএম) ২০১৩ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বিদেশ ফেরত ১০১ জন নারী শ্রমিকের মতামতের ভিত্তিতে একটি স্টাডি রিপোর্ট তৈরি করে। এতে দেখা যায়, প্রতি তিনজনে দুজন অভিবাসী নারী শ্রমিক তাদের নিয়োগকর্তা দ্বারা কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার। এ নির্যাতনকে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন হিসেবে ভাগ করা হয়েছে।
বিভিন্নসূত্রে আমরা জানতে পারি, গৃহশ্রমিক, নার্স, পরিচ্ছন্নতা কর্মী কাজের জন্য আকর্ষণীয় বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের দেশের যেসব নারী শ্রমিকদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়, তাদের অধিকাংশকেই মূলত সেখানে নিয়ে দেহব্যবসায় বাধ্য করা হয়। যাদের বাসাবাড়িতে কাজ দেওয়া হয় তারাও সেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। কোথাও কোথাও একইসাথে পিতা- পুত্রের যৌন লালসার শিকার হয়েছেন তাঁরা। এর প্রতিবাদ করলে কিংবা চলে আসতে চাইলে তাঁদের ওপর নেমে আসতো অমানসিক শারীরিক নির্যাতন।
বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই কাজ করছেন সৌদি আরব, মরিশাস, ওমান, লেবানন, সিঙ্গাপুর, জর্ডান ও হংকংয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ থেকে গত প্রায় তিন দশকে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক গিয়েছে ৭ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। সরকারি হিসাবে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক গিয়েছে সৌদি আরবে।
Advertisement
সাম্প্রতিক সময়ে সেই সৌদি থেকে ফিরে এসেছে কয়েকশো নারী শ্রমিক। আর ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের দুঃখ জাগানিয়া বিবরণ শুনে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করা নারী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে সরকার কী করছে, নির্যাতিত নারী শ্রমিকদের হৃদয়ের আর্তনাদ কি তাদের কানে পৌঁছাচ্ছে না?
পত্রিকার মারফতে জানতে পারি, গত তিন বছরে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে দেশটিতে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি নারী কর্মীদের সাড়ে তিন হাজার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এসব ঘটনায় সৌদি নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্বাভবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যেখানে রাষ্ট্রের দূতাবাসগুলো নির্যতিত কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ নারী শ্রমিকদের পাশে থাকছে না, এই অবস্থায় তাঁদের পক্ষে ন্যায় বিচার পাওয়া কতটুকু সম্ভব?
বাংলাদেশী অভিবাসী মহিলা শ্রমিকদের সংগঠন বলছে, গত ৬-৭ মাসে মাসে চার থেকে সাড়ে চার হাজার নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন সুমাইয়া ইসলাম, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর বক্তব্য থেকে জানতে পারি, শ্রীলংকা, ফিলিপাইনের মত দেশ নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রেখে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কঠোর অবস্থান নিয়ে এখন আবার সেই বাজারে ফিরে গেছে, ফলে তাদের দরকষাকষি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেদিকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ফিলিপাইন, শ্রীলংকার শ্রমিকদের উপর টর্চার হয়, কিন্তু সংখ্যাটা কম কারণ তাদের সরকার খুব স্ট্রং, তাদের রিক্রুটিং এজেন্সি দায়বদ্ধ। এ কারণে তাদের নির্যাতনের পরিমাণটা অনেক কম। তাদের বারগেইনিং পাওয়ার বেশি। সেই জায়গাটাতে আমরা পিছিয়ে আছি।
এই মুহূর্তে জরুরি হয়ে পড়েছে বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর আগে কার্যকর কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা। যেমন সংশ্লিষ্ট দেশে শ্রমিক পাঠানোর আগে তাঁদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে। নারী শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক ও সুস্থ কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সিকে বাধ্য করতে হবে নিয়ম মেনে কাজ করতে। কর্মীদের পাঠানোর আগে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে হবে। প্রবাসে নারী শ্রমিকদের প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সাড়া দিতে হবে সংশ্লিষ্ট এজেন্সি, লেবার উইংস ও দূতাবাসগুলোকে। চুক্তির শর্ত মেনে শ্রমিকদের কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে প্রেসার দিতে হবে। আর এই কাজগুলো সরকারকেই করতে হবে। যদি উপরোক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যায়, তাহলেই কেবল প্রবাসে নারী শ্রমিক নির্যাতন কমে আসবে। শ্রমিকরা কাজ করতে উৎসাহিত হবে, রেমিটেন্স বেড়ে শক্তিশালী হবে আমাদের দেশের অর্থনীতি। আমাদের মনে রাখতে হবে, নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের নারীরা বিদেশে কাজ করতে গেলেও এতে পরোক্ষভাবে দেশই কিন্তু লাভবান হচ্ছে। সংগত কারণেই সরকারকে এবিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে, দায়িত্বে অবহেলা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এই সময়ে যে সকল নারী শ্রমিক নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, কিন্তু পরিবারে জায়গা পাচ্ছেন না,তাঁদেরকে রাষ্ট্রের উদ্যোগে শেল্টার হোমে রেখে তাঁদের শারিরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যাঁরা অসুস্থ হয়ে ফিরছেন তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
আর এখনও যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশের পথে চেয়ে আছেন তাঁদেরও ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁরা যেন যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায় সে উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। সেইসাথে সরকারকে খোঁজে বের করতে হবে কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফিলিপাইন কিংবা শ্রীলংকার অভিজ্ঞতা সামনে নিয়ে কাজ শুরু করে দিতে হবে এখনই।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি