বিশেষ প্রতিবেদন

তিন বছরে এমপিদের ১১৩ বার বিদেশ ভ্রমণ

বিগত সংসদে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম তিন বছরে এমপিরা ১১৩ বার বিদেশ সফর করেছেন। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম দরিদ্রতম দেশ ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশও ছিল এসব সফরের মধ্যে। এভাবে পৃথিবীর ৭০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন তারা। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে সফর করেছেন ২২টি প্রতিনিধি দল। এতে ব্যয় হয়েছে তিন কোটি ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৯৩০ টাকা।

Advertisement

জাতীয় সংসদের ইন্টার পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স (আইপিএ) অধিশাখা ১ ও ২, হিসাব এবং সেবা শাখা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে দীর্ঘ তিন মাস অনুসন্ধান চালানো হয়। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নবম জাতীয় সংসদ গঠনের পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সংসদ সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই তিন বছরে মোট ১১৩টি প্রতিনিধি দল ছাড়াও শুধুমাত্র সংসদের কর্মকর্তারা একটি বিদেশ সফর করেন।

সংসদ তাদের ওই সফর ‘অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানোর পথ’ বললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘তারা কী ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন এর কোনো প্রতিফলন নেই। জনগণের টাকায় তারা বিদেশ যান। তারা কী উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন এবং সেই উদ্দেশ্য আদৌও সফল হয়েছে কিনা- তা জানার অধিকার জনগণের আছে।’

Advertisement

সূত্র জানায়, ১১৩টি প্রতিনিধি দলের মধ্যে বিএনপির এমপিরা ৩৫টিতে ঠাঁই পেয়েছিলেন। ওই সংসদে জামায়াতে ইসলামীর দুই সদস্য থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় তারা বিদেশ সফরে যাওয়ার সুযোগ পাননি।

১১৩টি প্রতিনিধি দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটি অংশ নেয় ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) সম্মেলনে। ওই দুই ফোরামে যোগ দিতে সংসদের সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয়। আইপিইউ’র ১২৪তম সম্মেলনে অংশ নিতে জাতীয় সংসদের খরচ হয় ৯৫ লাখ ১৮ হাজার ২৭৭ টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমপিরা সংসদে, সংসদের বাইরে ও বিদেশে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তারা বিভিন্ন ফোরামে অংশ নেন এবং সেই অভিজ্ঞতা দেশে এসে কাজে লাগান। এটি একটি ইতিবাচক দিক।’

‘তারা (এমপিরা) যেখানেই যান না কেন, জনগণের টাকায় যান। তারা কী উদ্দেশ্যে বিদেশ গেছেন এবং সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা- তা জানার অধিকার জনগণের আছে। সংসদ সদস্যরা নিজ উদ্যোগেই তা প্রকাশ করতে পারেন।’

Advertisement

সূত্র জানায়, ২২টি প্রতিনিধি দল সংসদের নিজস্ব টাকায় গেলেও মন্ত্রণালয়ের টাকায় বিদেশ সফর করেছে পাঁচটি প্রতিনিধি দল। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের টাকায় সংসদীয় কমিটির জন্য থাইল্যান্ড সফরের ব্যবস্থা করা হয়। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল থাইল্যান্ডের সমুদ্র বন্দর সফর করেন।

বিদেশ সফরে সংসদ থেকে যাওয়া প্রতিনিধি দলে কে থাকবেন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদের প্রধান হুইপ ও সিনিয়র সচিব তা নির্ধারণ করেন। সেই সময় স্পিকার ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। এর বাইরেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তিনটি প্রতিনিধি দলের মনোনয়ন দেয়া হয়। এর দুটিতে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির একজন করে এমপিকে রাখা হয়।

২০০৯ সালের এপ্রিলে চীনে অনুষ্ঠিত ‘দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক দলসমূহের সেমিনার’-এ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মনোনয়নে সরকারি দলের চার এমপি বিদেশ গেলেও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির কোনো এমপিকে সেই দলে নেয়া হয়নি। তবে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৪তম অধিবেশনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির একজন করে প্রতিনিধি দল অংশ নেন। ৬৫তম সম্মেলনেও জাতীয় পার্টি ও বিএনপির এক সদস্যকে রাখা হয়।

এছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ২০০৯ সালের ১১ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত টানা পাঁচটি দেশ সফর করেন এমপিরা। আট সদস্যের ওই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন প্রায়ত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আইন মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রকল্প থেকে তাদের যাবতীয় ব্যয় বহন করা হয়। ওই প্রতিনিধি দল জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, নর্দান আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সফর করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে একজন এমপি যুক্তরাজ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে দু’জন এমপি যুক্তরাষ্ট্র, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল জার্মান সফর করেন। ওই দলের সবাই এ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের আমন্ত্রণে বিএনপির একজন এমপিসহ তিন সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দল সেখানে যান। ২০০৯ সালের ২৭ থেকে ২৯ এপ্রিল লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘ভিজিট টু ওয়েস্টমিনস্টার ফাউন্ডেশন ফর ডেমোক্রেসি’ সেমিনারে যোগ দেন তারা।

বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রতিনিধি যান থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত আইপিইউ’র ১২২তম সম্মেলনে। ২০১০ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে ১৭ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর নেতৃত্বে বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও ওয়ার্কার্স পার্টির একজন করে এমপি ছাড়াও সংসদের চার কর্মকর্তা ওই সফরে অংশ নেন। বাকিরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি।

এর আগে ২০০৯ সালের ৭ থেকে ১৮ ডিসেম্বর ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-১৫) ১৬ জন এমপি অংশ নেন। সাবের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে সেখানে বিএনপির দু’জন এবং জাতীয় পার্টির একজন প্রতিনিধি ছিলেন।

বিগত সংসদে আওয়ামী লীগের ২৭৪ জন, বিএনপির ৩৭ জন, জাতীয় পার্টির ২৮ জন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির দু’জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের তিনজন, জামায়াতে ইসলামীর দু’জন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন, জাতীয় পার্টির (বিজেপি) একজন এবং স্বতন্ত্র দু’জন এমপি ছিলেন।

ওই সংসদে জামায়াত থেকে নির্বাচিত আ ন ম শামশুল ইসলাম (চট্টগ্রাম-১৪) ও এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ (কক্সবাজার-২) ওই তিন বছরে বিদেশ সফরের কোনো সুযোগ পাননি। ওই সময় সংসদ থেকে পাকিস্তান সফরে যায় একটি প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের এমপি শওকত আরা বেগম ওই সফরে উপস্থিত ছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাতীয় সংসদের ক্ষমতায়নে ইউএসএইড, এশিয়া ফাউন্ডেশন, ইউএনডিপির কতগুলো প্রকল্প ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সংসদ ও সংসদের ক্ষমতা বাড়ানো। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, অতিরিক্ত বিদেশ ভ্রমণ ও দুর্নীতির কারণে সবগুলো প্রকল্প বাতিল হয়েছে। তারা (এমপিরা) সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করেন কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগান না। বিদেশ সফর যেন তাদের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহৃত হয়!’

‘সংসদের টাকায় এত বিদেশ সফর করেও তাদের সক্ষমতা বেড়েছে কিনা- এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। কারণ এর কোনো প্রতিফলন আমরা দেখি না’- যোগ করেন তিনি।

এমপিদের বিদেশ সফর প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারিমন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমপিদের বিদেশ সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন কারণে এমপিরা বিদেশ সফর করেন। অভিজ্ঞতা বিনিয়ম ও অর্জন এর একটি অংশ। বিদেশ সফরের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা যেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তেমনি ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষও উপকৃত হন। দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়।’

বিশেষজ্ঞদের দাবি অনুযায়ী এমপিদের বিদেশ সফরের উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞতা অর্জন সংসদে প্রকাশ করা হয় না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সংসদ তথ্য উন্মুক্তকরণ নীতিমালা করতে যাচ্ছে। এ নীতিমালার মাধ্যমে সব প্রকাশ করা হবে। আগ্রহীরা চাইলে তথ্যও পাবেন।’

এমপিদের বিদেশ সফর প্রসঙ্গে সেই সময়ের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘কতবার বিদেশ সফর করেছেন সেটা বড় কথা নয়, কী অর্জন হলো সেটাই বড় কথা।’

এমপিদের বিদেশ সফরে দেশ কী পেয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এমপিরা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আইন প্রণয়ন করছেন। দেশের শাসন ব্যবস্থায় এর প্রতিফলন ঘটছে।’

এইচএস/এমএআর/জেআইএম