দেশের সরকারি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হয় চাঁচ নামের শক্ত একটি পদার্থ। দেশে সহজলভ্য না হওয়ায় মালয়েশিয়া, ভুটান, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হতো পদার্থটি। তবে গত তিন বছর হলো রাজশাহী বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত হয়েছে আমদানিকৃত পদার্থটি তৈরির প্রযুক্তি। যা ব্যাবহার করে দেশীয় চাহিদা দেশেই মেটানো সম্ভব হয়েছে। বিদেশ থেকে আর পদার্থটি আমদানি করতে হচ্ছে না বাংলাদেশ সরকারের।
Advertisement
শুধু চাঁচ নামক পদার্থ নয় বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় ভুট্টার দানাধারী ডাটা (কর্ণকব) থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতে ব্যবহৃত কার্বোক্সিমিথাইল সেলুলোস (সিএমসি) নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ তৈরির প্রযুক্তি। এটিও বিদেশ থেকে আমদানি করতে বছর বছর বেশ অর্থ লাগে দেশের। তবে এখন এই প্রযুক্তিটি কাজে লাগানো গেলে বিদেশ থেকে সিএমসি আমদানি করা প্রয়োজন হবে না বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া রাজশাহী বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন প্রচেষ্টার ৫০ বছরে এসে এমন প্রযুক্তি সংখ্যা এখন দেড় শতাধিক। যেগুলোর অধিকাংশই শিল্পে ব্যবহারের উপযোগী এবং বাজারজাতের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বিসিএসআইআর সূত্রে জানা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের সহজলভ্য কাঁচামালভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণাগার (বিসিএসআইআর) নামের এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিবছরই ৪ থেকে ৫টি শিল্পে ব্যবহার উপযোগী পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতা রেখেছেন রাজশাহী বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা।
Advertisement
প্রতিষ্ঠার এই ৫০ বছরে প্রায় ১৬৮টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। যে প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষ ও প্রাণীর খাদ্যজাত পণ্য, কীটনাশক, কসমেটিকস সামগ্রী, ভেষজ ওষুধ সামগ্রী এবং গার্মেন্ট ব্যবহার্য সামগ্রী।
গবেষণাগার সূত্র জানায়, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ইজারা নেওয়ার পর সহজে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব। একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে ইজারা বাবদ যে অর্থ প্রদান করতে হয় তার বাইরে সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে শিল্প প্রতিষ্ঠান ভেদে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব বলে জানান তারা।
ইজারার বিষয়ে তারা বিসিএসআইআরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মইনুদ্দিন বলেন, সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকায় বিসিএসআইআর ইজারা প্রদান করে থাকে। প্রযুক্তি ভেদে ইজারার জন্য অর্থ বাড়ে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ইজারা প্রদান করা হয়। নিজস্ব অর্থায়নে শিল্প প্রতিষ্ঠান দাঁড় করতে হয় ইজারা গ্রহণকারীকে। তবে যাবতীয় পরামর্শ গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা প্রদান করে থাকেন।
গবেষণাগারের বিজ্ঞানী আব্দুল জলিল জানান, গবেষণাগারে তেল চর্বি ও মোম, ফাইবার ও পলিমার, ফলিত প্রাণীবিদ্যা, ন্যাচারাল প্রোডাক্টস, খাদ্য, ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ, ড্রাগ অ্যান্ড টক্সিক ও ফলিত উদ্ভিদবিজ্ঞান গবেষণা এই ৭টি বিভাগে কাজ করা হয় এখানে। প্রায় ৩৩ জন বিজ্ঞানী নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
Advertisement
এদিকে উদ্ভাবনে সফলতা দেখালেও কিছু সমস্যা দৃশ্যমান গবেষণাগারটিতে। তথ্য মতে উদ্ভাবিত মোট প্রযুক্তির মধ্যে মাত্র ৩৫টি প্রযুক্তি বাজারজাতের জন্য ইজারা দিতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ। বাকি ১৩৩টি পদ্ধতি এখনও বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভব হয়নি। উদ্যোক্তার অভাবে সেগুলো ইজারা দিতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এ বিষয়ে বিজ্ঞান গবেষণাগারের পরিচালক ড. হুসনা পারভীন নূর বলেন, বিজ্ঞানীরা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন। প্রযুক্তিগুলো ইজারা দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত। তবে কাঙ্ক্ষিত উদ্যোক্তা আমরা পাচ্ছি না। মূলত উদ্যোক্তা না পাওয়ায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বাজারজাত হচ্ছে না। তবে এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোক্তাদের চাহিদা মাফিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথা জানান তিনি।
বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রদত্ত সেবা
এদিকে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন নাগরিক সেবা দেওয়া হয় রাজশাহীর এই গবেষণাগার থেকে। করা হয় গবেষণা ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক কাজও। গবেষণাগার ব্যবহারের সুযোগ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল ও পিএইচডি গবেষকদের।
আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্য উাপাদান, খাদ্য দ্রব্যের ভেজাল ও ক্ষতিকারক উপাদান নির্ণয় এবং শিল্পে ব্যবহৃত কাচামাল বিশ্লেষণের কাজ করা হয় গবেষণাগার থেকে। থাকে হালাল-হারাম নির্ণয় ও রোগ জীবাণু নির্ণয় সেবার সুযোগ। এছাড়া ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে প্রতিবারই বড় আয়োজনে থাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলার।
গবেষণাগার সম্পর্কে জানা গেছে, ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের একটি ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই গবেষণাগারের নাম ছিল ‘নর্থ-স্টে রিজিওনাল ল্যাবরেটরি’। স্বাধীনতার পরে গবেষণাগারের নাম বদলে রাখা হয় বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণাগার (বিসিএসআইআর) রাজশাহী।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এফএ/পিআর