ফিচার

শিশুকে কখনোই ভয় দেখাবেন না

আমরা প্রায়ই শিশুকে ভয় দেখাই। যদি খেতে, খেলতে, পড়তে, কথা শুনতে না চায় বা শিশুকে রেখে আমরা যদি কোনো কাজে ব্যস্ত থাকতে চাই; তখন শিশুকে নানা বিষয়ে ভয় দেখিয়ে বাধ্য করতে চাই। শিশুকে এমন ভয় দেখানোর বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জোবায়ের মিলন-

Advertisement

শিশুকে বাধ্য করাতে বা ভয় দেখানোতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। থাকলেও কার্যক্ষেত্রে ভুলে যাই। শিশুটি হয়তো খেতে চাচ্ছে না বলে তাকে ভয় দেখচ্ছি ভূতের। বলছি বড় বড় দাঁতের কথা, চোখের কথা, কুচকুচে কালো রঙের কথা, বিকট চেহারার কথা। সেই সঙ্গে নিজের মুখভঙ্গীও ভূতের মতো করছি। ভয় পেয়ে শিশুটি খাবার খাচ্ছে। পড়তে না চাইলে হয়তো তাকে ডায়নোসরের কথা বলছি। ডায়নোসরের বিকৃত শরীর আর গর্জনের কথা বলছি, অভিনয় করে তাকে ডায়নোসরের রূপটি দেখানোর চেষ্টা করছি। ভয় পেয়ে হয়তো শিশুটি পড়তে বসছে বা পড়ছে। কথা শুনতে না চাইলে তাকে হয়তো ব্যাঙ, টিকটিকি, সাপ, বাঘ ইত্যাদি আরও ভয়ানক কিছুর কথা বলে ভয় পাইয়ে দিচ্ছি। আমরা যা চাই; তা আদায় করিয়ে নিচ্ছি শিশুটির কাছ থেকে। কিন্তু এর ফলস্বরূপ শিশুটির ওপর ভয়ের কী প্রভাব পড়ছে, তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? না চিন্তা করেছি?

কেস স্টাডি- একধরা যাক, সৌর্যের বয়স তিন। একটু চঞ্চল প্রকৃতির। পড়ার টেবিলে বসতে চায় না। খাওয়ার সময় খেতে চায় না। ঠিক সময়ে ঘুমোতে চায় না। বেশ ছটফটে সারাক্ষণ। সৌর্যের মা সৌর্যকে খাওয়ানোর সময় হঠাৎ করে একদিন ‘তেলাপোকা আসে’ বলায় সৌর্য আর তেমন অনীহা না করে দ্রুত মায়ের কাছে এসে জরোসরো হয়ে গেল এবং খাবার খেয়ে নিল। সৌর্যের মা তা খেয়াল করলেন এবং একটি পথ পেয়ে গেলেন। এরপর সৌর্য কোনো কথা শুনতে না চাইলেই তাকে তেলাপোকার কথা বলে কাজটি করিয়ে নেন। সৌর্যও আর আগের মতো অনীহা বা কথা না শোনার মতো কিছু করে না। কিন্তু তার চাঞ্চল্য হারিয়ে গেল! এক রুম থেকে আরেক রুমে যেতে সে এখন মাকে ছাড়া নড়ে না। ঘুমের মধ্যে ‘তেলাপোকা’ বলে চিৎকার করে ওঠে। একা বাথরুমে পাঠানো যায় না। ঘরে সামান্য অন্ধকার হলেই সে চেঁচিয়ে জানান দেয়। অল্পতে ভয়ে কাঁপে।

কেস স্টাডি- দুইতামাররার গল্পটাও প্রায় এরকমই। তামাররা বেশ চটপটে। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করলেও টিভি, ট্যাব, কার্টুনের প্রতি অনেক আকর্ষণ। খাওয়ার সময়, ঘুমের সময়, গোসলের সময়, স্কুলে যাওয়ার সময় কার্টুন, গেমস্। গেমস্, কার্টুন ছাড়া তার একমুহূর্ত কাটে না। না দিতে চাইলে কান্নাকাটি করে অস্থির। এমন করতে করতে একদিন তামাররার বাবা হরোর ছিনেমা দেখার সময় লক্ষ্য করলেন তার সাথে সিনেমা দেখতে থাকা তামাররা কেমন যেন কুচকে যাচ্ছে, চোখে-মুখে ভয়। তিনি টিভি বন্ধ করে দিলে তামাররা আবার স্বাভাবিক কথা বললো এবং হাসতে থাকলো। বিষয়টি তিনি মার্ক করলেন এবং ঘুমের সময় তামাররা গেমস খেলতে চাইলে তাকে সিনেমার ভূতের কথা বলে ভয় দেখালেন। তামাররা কোনো শব্দ না করে বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেল। এরপর তামাররা কোনো কথা শুনতে না চাইলে তাকে সিনেমার ভয় দেখানো হয়। গুটগুটে অন্ধকারের ভয় দেখানো হয়। ভয় পেয়ে তামাররাও আগের মতো বিরক্ত করে না। কিন্তু তামাররার মধ্যে নেই আগের মতো ফুরফুরে ভাব। নেই হাসিখুশি স্বচ্ছতা। একা একা কোনো কিছুই সে আর করতে চায় না। বাবা-মাকে ছাড়া এক মিনিটও সজাগ থাকতে চায় না। স্কুলে গিয়ে খেলতে চায় না, কথা বলতে চায় না, টিচার কিছু বলা মাত্রই কান্না শুরু করে। বাসায় অতিথি দেখলে লুকিয়ে থাকে, না হয় দরজা বন্ধ করে পালিয়ে থাকে! চোখে-মুখে জড়তার একটা ছাপ স্পষ্ট দেখা দেয়। চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন, ভয় দেখানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই এমনটি হয়েছে।

Advertisement

দুটি পরিবার থেকে তুলে আনা ঘটনা এগুলো। আমাদের চারপাশে এমনটি হচ্ছে অহরহ। অনেক সময় আমরা লক্ষ্য করি না বা জানি না বলে বিষয়টি ধরতে পারি না। আমাদের শৈশব যদি আমরা স্মরণ করি, তবে দেখবো আমাদের সঙ্গেও আমাদের ছোটবেলায় এমন করা হয়েছে। অনেকটা সময় পর্যন্ত আমরা অনেকেই একা ঘরে ঘুমোতে পারতাম না বা এখনও পারি না। অন্ধকার পথে চলতে গেলে গা ছমছম করে। ভূতের ভয় মনের মধ্যে গেঁথে আছে আজও। নিশ্চিত করে বলা যায়, এগুলো ছোটবেলার ভয়ের প্রভাব, যা বড়বেলায় এসেও কাটেনি। তাই আমাদের শিশুকে ভয় দেখানোর সময় খুব ভেবেচিন্তে ভয় দেখানো উচিত। ভয় দেখিয়ে শিশুটিকে বাধ্য করানোর ক্ষেত্রে তার উপর কী প্রভাব পড়বে তা ভাবা উচিত। না হলে অজান্তেই শিশুর অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে আমাদেরই অজ্ঞতা আর অসচেতনতায়।

ভয় দেখালে যা হয়১. ভয় দেখানোর প্রভাবে শিশুর মধ্যে কঠিন জড়তা তৈরি হতে পারে।২. শিশুর মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে যে চঞ্চলতা ছিল, তা বিনষ্ট হয়ে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।৩. ভয়ের প্রভাব শিশুটির বুদ্ধির স্বাভাবিক গতি থামিয়ে দিতে পারে।৪. আঁৎকে ওঠার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। ৫. মুক্তমনে নেতিবাচক ছবি তৈরি হয়ে সে ছবির প্রতি আজীবন আতঙ্ক দেখা দিতে পারে।৬. নিজের মতো কাজ করার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।৭. অসত্য কল্পনায় তাকে ভীতু করে তুললে অন্যকিছুর প্রতিও ভয় দানা বাঁধতে পারে।৮. শিশুর নিজের প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতভাগ।৯. অনেক সময় শিশু অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় ভুগতে পারে।১০. প্রকৃত বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে শিশু অনেক সময় প্রতিবন্ধীরূপ ধারণ করতে পারে।

যা করবেনশিশুকে খাওয়ানো, পড়ানো, ঘুমপাড়ানো বা নিজের কাজের ব্যস্ততার জন্য অকারণে মনে ভয় ধরিয়ে দিয়ে তার বিকাশে ক্ষতিকর দেয়াল তুলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। একটু সময় ব্যয় করলেই শিশুকে খাওয়ানো যায়, পড়ানো যায়, ঘুমপাড়ানো যায়। ভয়ের গল্প ছাড়াও শিশুকে কনভেন্স করার মতো অনেক কিছু নিশ্চয়ই আছে। অনেক খেলনা দিয়ে, প্রকৃতির অনেক কিছুর কথা বলে শিশুকে শান্ত করা সম্ভব। তাড়াহুড়ো না করে ধৈর্য নিয়ে সময় দিলে স্বাভাবিকভাবেই শিশুকে খুশি করা যায় বা অনেক কিছু থেকে দূরে রাখা যায়।

অপরাধশিশুকে ভয় দেখানো শুধু একটি মন্দ কাজের মধ্যেই পড়ে না, এটি একটি অপরাধমূলক কাজও। শিশুর শুধু শারীরিক ক্ষতির জন্যই প্রচলিত আইন নয়, ভয়-ভীতি দেখিয়ে মানসিক ক্ষতিসাধনের জন্যও প্রচলিত আইনে দণ্ড রয়েছে। আর সে অপরাধ বাবা মা ভাই বোন প্রতিবেশি যে-ই করে থাকুক তা শাস্তির আওতায় পড়ে। তাছাড়া যে কোনো একটি ক্ষতির পেছনে কৃত-কাজকে নিশ্চিত অপরাধ হিসেবে প্রহণ করা যায়। সচেতনতার কথা চিন্তা করলেও শিশুকে ভয় দেখানো একটি বিপজ্জনক কাজ। শিশুর সুস্থ বিকাশ, মানসিক স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের জন্য এমন কাজ না করাই উত্তম।

Advertisement

লেখক : কবি, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক

এসইউ/এমএস