বিশেষ প্রতিবেদন

সফিউল আহমেদ বাবুলের মুখে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো

১৯৭১ সালে দেশের জন্য কাঙ্ক্ষিত বিজয় ছিনিয়ে আনতে কখনও কখনও পাকবাহিনীর অস্ত্রের মুখে পড়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। চোখের সামনে অনেক সহযোদ্ধাকে মরতে দেখেছি। ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা মুক্ত দিবসে যে কয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহরে বীরবেশে প্রবেশ করেছিলেন তাদের অন্যতম একজন সদস্য হলেন কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল।

Advertisement

জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তুলে ধরেন দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা। যুদ্ধকালীন স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, সেদিন বিজয়ের উল্লাসে উল্লাসিত হাজার হাজার কুমিল্লাবাসী রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুলের মালা এমনকি টাকার মালা দিয়ে জড়িয়ে ধরে বিপুলভাবে অভিনন্দন জানাতে লাগলো আমাদেরকে। সেই এক অভাবনীয় অকল্পনীয় দৃশ্য, যার অনুভূতি সহজে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না কখনই। গলা ভার হয়ে আসছিলো, আর কখন যে চোখ থেকে অশ্রু ঝড়ে গাল বেয়ে পরছিল তা টেরই পেলাম না আমি। বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিউল আহমেদ বাবুল একান্ত এক সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। তখন সবেমাত্র কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। ওইসময়ে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। থাকতাম পরিবারের সবার সঙ্গে বাবার কর্মস্থল কুমিল্লা শহরের টমছমব্রিজ এলাকার ভেটেরিনারি অফিস কম্পাউন্ডের ভেতরের একটি আবাসিক ভবনে।

২৫ মার্চ কালরাত্রিতে আমার বড় ভাই রেজাউল আহমেদ রেজাসহ পরিবারের সকলে ছিলাম ওই বাসাতেই। ওইদিন রাতে স্বচক্ষে কুমিল্লায় গণহত্যা দেখে ২৭ মার্চ সকালে রেজা ভাই উনার বন্ধু সিরাজ ভাই, সেলিম ভাইসহ অন্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রশিক্ষণের জন্য কারফিউর ফাঁকে ফাঁকে কুমিল্লা ছেড়ে চলে যান বর্ডার পেড়িয়ে ভারতের আগরতলার সোনামুড়ায় এলাকায়।

এর আগে ২৬ মার্চ ভোরে আমাদের বাসার পাশে অবস্থিত আনসার ক্যাম্পের সব আনসারকে গুলি করে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়। পাকিস্তানিদের হাত থেকে রেহাই পায়নি রাস্তার পাগলও। এমনকি প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া মানুষজন এবং মসজিদের মুসুল্লিরা। পরে ১ এপ্রিল আমি, বন্ধু কামাল এবং তার বড় বোন কুমিল্লা মহিলা কলেজের ছাত্রনেত্রী মঞ্জু আপাসহ (সেলিনা হক) যুদ্ধে অংশ নিতে চৌদ্দগ্রাম বর্ডার পেড়িয়ে রাধানগর গ্রাম হয়ে সোনামুড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যাই। এ পুরো এরিয়াটিই ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে এবং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ।

Advertisement

মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এবং যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সোনামুড়া থেকে ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ আমাকে ভারতের ত্রিপুরার কাঁঠালিয়াতে অস্ত্র চালানো এবং যুদ্ধবিষয়ক উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান ক্যাপ্টেন রেজা। ট্রেনিং থেকে ফিরে আসার ২ দিন পর অর্থাৎ ৯ মে বিরাট এক যুদ্ধের মুখোমুখি হলাম আমরা, কুমিল্লার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের কটক বাজারে।

কুমিল্লার বিবির বাজার স্থানটি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকায় হওয়ায় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ছিল স্থানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন রেজাউল আহম্মেদের (রেজা ভাই) নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, মুজাহিদ, ছাত্র, আনসার এবং কুমিল্লা জেলার মুক্তিযোদ্ধারা মিলে তৈরি করেন এক বিরাট প্রতিরক্ষা বলয়। কিন্তু ৩১ পাঞ্জাব এবং ৩৯ বেলুচ রেজিমেন্ট মিলে আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এতো যে সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান বাহিনী আমাদেরকে আক্রমণ করবে প্রতিরক্ষা বলয় ভাঙ্গার জন্য, তা আমাদের সম্পূর্ণ কল্পনার বাইরে ছিল।

ওই দিন প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় সেখানে। একই ব্যাংকার থেকে আমি, ভিপি শাহ আলম ভাই, কমান্ডার সিরাজ ভাই, সুবেদার মান্নান মিলে অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করি শত্রুর সঙ্গে। কিন্তু একপর্যায়ে আমাদের গোলাগুলি শেষ হয়ে গেলে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই আমরা। অবশ্য এর মধ্যে মতিনগর থেকে ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম আর নির্ভয়পুর থেকে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান তাদের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসলে আমরা আবার কাউন্টার এ্যাটাকে যাই। কিন্তু ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করার পর সুবিধা করতে না পেরে পুরোপুরি পশ্চাদপসরণ হয়ে ইন্ডিয়ার ধনবাড়ী ক্যাম্পে চলে যায় আমাদের একটা বড় গ্রুপ। এ যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর ১শ’ থেকে ১৫০ জন নিহত হয়।

আর মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার জুম্মা খান, ল্যান্সনায়েক আব্দুল কাদের মোল্লা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইমতিয়াজউদ্দিনসহ ৭ জন শহীদ হন। পরবর্তীতে ২১ নভেম্বর যৌথ বাহিনী (মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী) সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী ঝাঁপিয়ে পরে সাড়া দেশব্যাপী চারিদিক থেকে পাক হানাদার বাহিনীর ওপরে।

Advertisement

স্থল, নৌ, বিমান ও বিভিন্নমুখী আক্রমণে পাক বাহিনী দিশেহারা হয়ে পশ্চাদবরণ করতে থাকে। আর আমরা আমাদের কাঙ্খিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। ৬ ডিসেম্বর আমাদের ২শ’ জনের টিমটি ৩ ভাগ হয়ে একভাগ ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে চলে যায় ভারতীয় গুরখা ব্যাটালিয়নের সঙ্গে চৌদ্দগ্রাম, মিয়ার বাজার, সুয়াগাজী হয়ে লাকসামের দিকে শত্রুমুক্ত করতে। আর আমাদের গ্রুপটি ৭ ডিসেম্বর শেষ রাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন শর্মার বাহিনীর সঙ্গে নির্ভরপুর থেকে সোনামুড়া হয়ে রওনা হলাম কুমিল্লা শহরের উদ্দেশ্যে।

ভারতের ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনস্থ ৬১ ব্রিগেড এবং আমাদের ৯ বেঙ্গল ওইদিন সারারাত যুদ্ধ করে কুমিল্লা শহরকে শত্রু মুক্ত করে সম্পূর্ণভাবে। ওই সময় ক্যাপ্টেন শর্মা ছিলেন তার আর্মি জীপে আর আমরা ছিলাম অন্য একটা গাড়িতে। ক্যাপ্টেন শর্মা আমাদেরকে (আমি, শাহ আলম, রেজাউর রহমান বুলবুল) তার জীপে উঠিয়ে নিলেন। আমরা ছাড়াও তার সঙ্গে ছিল ড্রাইভার আর একজন ইন্ডিয়ান সৈনিক। আমরা ৬ জন উনার জীপে করে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে ৮ ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে কুমিল্লা শহরের চকবাজার পৌঁছি। সে এক অভাবনীয় অকল্পনীয় দৃশ্য, যার অনুভূতি সহজে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না কখনই।

এদিন কুমিল্লা শহরের জনসাধারণ, সিভিল প্রশাসন, সব বীর মুক্তিযোদ্ধা, মিত্র বাহিনী এবং ৯ বেঙ্গল এর অধিনায়ক মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল এবং বীর প্রতীকে ভূষিত) আইনুদ্দিন সাহেবের উপস্থিতিতে তৎকালীন পশ্চিম পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী দলীয় পতাকা এবং কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন কুমিল্লা টাউন হল ময়দানে। মুক্ত হয় কুমিল্লা। এ যে কতো বড় আনন্দ এবং পাওয়া তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না কখনই। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে সফিউল আলম বাবুল আরও বলেন, অনেক অপারেশনে আমরা সফলতা পেয়েছি, আবার ব্যর্থও হয়েছি অনেকটিতে। এমনকি হাতে-নাতে কুমিল্লা শহরের কালিয়াজুরিতে অস্ত্রসহ আমি আর সেলিম ভাই ধরা পরার পরেও আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রক্ষা করেছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে।

কামাল উদ্দিন/এমএএস/আরআইপি