৬১ থেকে ১৪৩৯। এক দুই বছর নয়। গুনে গুনে ১৩৭৮ বছর। পেরিয়ে গেছে সুদীর্ঘ সময়। কিন্তু কালের গর্ভে বিলীন হয়নি কারবালার ঘটনা। হারিয়ে যায়নি ইমাম হোসেনের মহান আত্মত্যাগের কথা। শুধু মুসলমানদের মাঝে নয়, পৃথিবীর তাবৎ মানুষের হৃদয়ে দারুণভাবে জাগরুক আছে ইমাম হোসেন। কুচক্রী, পাপাচার ইয়াজিদ ও তার দোসরদের কাছে নির্মমভাবে শহীদ হলেও আপস করেননি। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে একচুলও সরে দাঁড়াননি।
Advertisement
মহান আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হজরত মোহম্মদ (সা.) পরিবার-পরিজনের ওপর পাপাত্মা ইয়াজিদের অত্যাচারের কথা দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে এখনো স্মরণ করে বিশ্ব। ভর্ৎসনা পায় ইয়াজিদ ও তার পক্ষ। আর তার হাত থেকে ইসলামকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে অকারতরে প্রাণ দেয়া ও নিজেকে উৎসর্গ করা ইমাম হোসেন, তার পরিবার ও অনুসারীদের জন্য অব্যাহত আছে গভীর শ্রদ্ধা, অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সম্মান। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সারা বছরই ইমাম হোসেনের প্রতি সম্মান পোষণ করেন।
আর প্রতি মহররমের চাঁদে তাকে ঘিরে আয়োজিত হয় নানা স্মরণ অনুষ্ঠান। বিশ্বের সর্বত্র আশুরার দিন ইমাম হোসেন স্মরণে অনুষ্ঠিত হয় সভা ও সেমিনার। শুধু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার বন্দনা। পাপিষ্ঠ, দুরাচার ও ব্যভিচারী ইয়াজিদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করা পুণ্য আত্মার স্মরণে ১০ মহররম আশুরার দিন মুসলিম বিশ্বে আয়োজিত হয় শোক মিছিল। যাতে কোটি কোটি ইমামভক্ত প্রকাশ করেন হৃদয় নিংরানো ভালোবাসা।
নগ্নপদে পবিত্র তাজিয়া, নিশান সমেৎ সাজানো হয় মিছিল। বাংলাদেশেও ইমাম হোসেনের স্মরণে বহু মিছিল বেড় হয়। রাজধানী ঢাকার হোসনি দালান, বিবিকা রওজা, মোহাম্মদপুর ইমামবাড়ি থেকে বের হয় তাজিয়া মিছিল।
Advertisement
রাজধানীর অদূরে মানিকগঞ্জের গড়পাড়া ইমামবাড়ি থেকেও স্মরণাতীতকাল হতে মহররমের মিছিল বের হয়। শুধু শোক মিছিল বের করা নয়, ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে কারবালার শোকবিধুর ঘটনা, শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আসছে গড়পাড়া ইমামবাড়ি।
পবিত্র মহররম উপলক্ষে গড়পাড়া ইমামবাড়িতে ১০ দিনের ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এবারও ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ‘মহররমের’ চন্দ্রোদয়ের দিন থেকে ইমামবাড়ি প্রাঙ্গণ রূপ নিয়েছে শোকসংকুল ক্ষেত্রে। চন্দ্রোদয়ের দিন সন্ধ্যায় বেজে উঠেছে ইমামবাড়ির দামামা। কারবালার যুদ্ধের স্মরণে প্রায় শতবর্ষ যাবৎ সংরক্ষিত আছে এ বিশাল ডঙ্কা। এরপর ইমামবাড়ির দ্বার উদ্ঘাটন করা হয়। শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন কার্যক্রম। প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় আয়োজিত হচ্ছে মিলাদ, ফাতেহা, নেয়াজ, মার্সিয়া-মাতম। এর সঙ্গে ইমাম হোসেনের সততা ন্যায় নিষ্ঠার কথাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে।
মহররমের ১ তারিখ থেকে বের হয়েছে ২৮টি কাসেদের দল। কারবালার বেদনা-বিধুর ঘটনা জারি-মার্সিয়ার মাধ্যমে প্রচারের জন্য ইমামবাড়ি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মানিকগঞ্জ জেলার প্রায় সর্বত্র, বৃহত্তর ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, পাবনা, রাজশাহী, নাটোর জেলার লালপুরসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গেছে কাসেদের দল।
সপ্তাহকালের বেশি সময় পর আশুরার দিন ইমামবাড়িতে ফিরে আসবে ওইসব কাসেদের দল। আগামীকাল রোববার (১ অক্টোবর) আশুরার দিন জোহরের নামাজের পর পবিত্র নেয়াজ পর্ব শেষে বের হবে বিরাট শোক মিছিল। বাংলা একাডেমির এক সমীক্ষায় জানা গেছে, গড়পাড়া ইমামবাড়ির মহররমের মিছিলটিই সম্ভবত দেশের বৃহত্তম শোক মিছিল।
Advertisement
‘হায় হোসেন-হায় হোসেন’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মানিকগঞ্জ শহরের উদ্দেশে বিশাল মিছিলের যাত্রা শুরু হবে বেলা ৩টায়। পবিত্র তাজিয়া-তাবুৎ, দুলদুল ও কারবালার স্মৃতিবহনকারী হাজার হাজার লাল সবুজ ও কালো নিশান সম্বলিত মিছিল মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে মাগরিবের নামাজের সময় গিয়ে উপস্থিত হবে। হাজার হাজার ইমাম ভক্ত রোজা শেষে ইফতার করবেন কলেজ মাঠে। তারপর শুরু হবে ইমাম হোসেন ও তার ৭২ সঙ্গীর স্মরণে শোকসভা।
গড়পাড়া ইমামবাড়ি দরবার শরিফের খাদেম শাহ্ মোখলেছুর রহমানের সভাপতিত্বে ওই স্মরণসভায় স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত থাকবেন। কারবালার মহান শহীদদের আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি মুসলমানদের শান্তি, সম্প্রীতি ও সংহতি এবং বিশ্ব শান্তির জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হবে।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজি, সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়, দেশবরেণ্য বাউল শিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম ও কুড়িগ্রামের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ রুহুল আমিন, মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক নাজমুছ সাদাত সেলিম, মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মহিউদ্দীন, মানিকগঞ্জ পৌর মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিম, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম, সাবেক পৌর মেয়র রমজান আলী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ইকবাল খানসহ দেশের ও মানিকগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণও এবার আশুরা উপলক্ষে গড়পাড়া ইমামবাড়িতে যাবেন এবং হজরত ইমাম হোসেন স্মরণে নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নেবেন।
এআরবি/বিএ/আরআইপি