কৃষি ও প্রকৃতি

সখীপুরে ১ টন ওজনের গরু ব্রাহমা

‘ব্রাহমা’ জাতের মাংসল গরু দেশে পালন করা হচ্ছে। মাত্র তিন বছর বয়সে এ জাতের ষাঁড় গরু পালনে ওজন দাঁড়াবে ১ টন (২৭ মণ)। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ‘বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু করেছে। আমেরিকা থেকে ব্রাহমা জাতের সিমেন (প্রজনন) সংগ্রহ করে সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জেলা ও উপজেলাতে খামারি বা কৃষকদের গরু পালনের প্রণোদনা দিচ্ছে।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ব্রাহমা জাতের এই গরু পালিত হলে দেশের মাংসের চাহিদার ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ হবে। বাংলাদেশে প্রথম টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলায় এমনই এক আধুনিক মাংসল জাতের গরু পালনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের উদ্যোগে সখীপুর উপজেলায় ২০০ জন খামারিকে নির্বাচন করে পাঁচ শতাধিক গাভিকে প্রজনন দেওয়া হয়। এরইমধ্যে ১৪৫টি বাছুর জন্মেছে। মাত্র দুই থেকে আড়াই বছর বয়সী ষাঁড় ও বকনা বাছুরগুলো মাকে ছাপিয়ে অনেক উঁচু হয়েছে। মায়ের চেয়ে আকারে বেশ বড়, আবার দুই থেকে আড়াই বছরের বাছুরের ওজন মিলেছে ৭৬০ থেকে ৭৪০ কেজি! গায়ে-গতরে তাগড়া এই গরুর জাতের নাম ব্রাহমা।

সখীপুর উপজেলা ও পৌরসভার বিভিন্ন গ্রামে এখন আমেরিকার ব্রাহমা নামের উন্নত জাতের গরু লালন-পালন করা হচ্ছে। দেশে দুধের জন্য শংকর জাতের গরু লালন-পালন করা হলেও এই প্রথম মাংস বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগ আমেরিকা থেকে সিমেন এনে ব্রাহমা জাতের গরু পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। এক বছরের মধ্যে দেশি গরুর চেয়ে তিনগুণ বেশি মাংস বৃদ্ধি ঘটায়। ভিন্ন জাতের এই গরু দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই সখীপুর পৌরসভার বিভিন্ন গ্রামে ছুটে আসছেন।

Advertisement

প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের মাংসের ঘাটতি দূর করার জন্য ২০০৮ সালে আমেরিকা থেকে উন্নত ব্রাহমা জাতের গরুর সিমেন নিয়ে এসে নির্বাচিত দেশীয় জাতের গাভিকে প্রজনন দিয়ে এই জাতের গরু পালন করা হচ্ছে।

সরেজমিনে গ্রামগুলো ঘুরে দেখা যায়, দুই থেকে প্রায় আড়াই বছর বয়সের বাছুরগুলোর ওজন হয়েছে ৭৪০ থেকে ৭৬০ কেজি। বিরাট আকৃতির নাদুস-নুদুস গরুগুলোর এখনো শিং গজায়নি। পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের গড়গোবিন্দপুর গ্রামের আখতার হোসেন ব্রাহমা জাতের গরু পালন করছেন। তার দুই বছর চার মাস (২৮মাস) বয়সী ষাঁড় বাছুরটির ওজন হয়েছে ৭৬০ (১৯ মণ) কেজি।

তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে আঁখি সময় বিশেষ গরুটির দেখভাল করেন। আঁখি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সদস্য ষাঁড়টি খুবই শান্ত স্বভাবের। পড়াশোনার ফাঁকে মাঝেমধ্যে আমি এই ষাঁড়ের খাবার-দাবার আর যত্নের পেছনে ব্যয় করি। ভালোবেসে নাম দিয়েছি ‘মধু’। ষাঁড়টি এখন আমার প্রিয় বন্ধু। চলতি বছরের জুনে এই জাতের আরো একটি ষাঁড় বাছুর আমাদের পরিবারের সদস্য হয়েছে। ওকেও খুব আদর-সোহাগে নাম রেখেছেন ‘রাজা’। এখন আমার দু’টি প্রিয় বন্ধু।’

খামারি আখতার হোসেন বলেন, ‘এই ষাঁড় গরুটি দেখার জন্য টাঙ্গাইল জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা ও রাজধানী থেকে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের বাড়িতে এসেছেন। ফোন নম্বর নিয়ে যান। ষাঁড়টি কিভাবে পালন করছি কিংবা এর ওজন কত কেজিতে দাঁড়িয়েছে এসব জানতে চেয়ে কত মানুষই যে ফোন করে তার ইয়ত্তা নেই।’

Advertisement

ওই গ্রামের নূরুল ইসলামের দুই বছর ৩ মাস (২৭ মাস) বয়সী ষাঁড়ের ওজন হয়েছে ৭৪০ (সাড়ে ১৮ মণ) কেজি। প্রতিমা বংকী গ্রামের বিল্লাল হোসেনের ষাঁড় গরুর ওজন হয়েছে ৬৮০ (১৭ মণ) কেজি। সানবান্ধা গ্রামের আবদুর রহমান তালুকদারের গরুর ওজন হযেছে ৬৪০ (১৬ মণ) কেজি। সখীপুর পূর্বপাড়া গ্রামের আয়নাল হকের গরুর ওজন হয়েছে ৬৪৫ (প্রায় ১৭ মণ) কেজি।

খামারিরা জানান, এই গরু পালন করে তারা খুবই খুশি। দেশি গরুর মতো এই গরু সবকিছুই খায়। এই গরু পালন খুবই লাভজনক মনে হচ্ছে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম শেখ মানিক বলেন, ‘প্রকল্পের অধীনে গরু লালন-পালনের জন্য আমরা খামারিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ওষুধপত্র, ভ্যাকসিন বিনামূল্যে সরবরাহ করছি। ১৮ মাস পর এই গরুর মাংস খাওয়ার উপযোগী হবে। খামারিরা এই গরু লালন-পালন করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।’

এ ব্যাপারে সখীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এসএম উকিল উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বছরে একজন মানুষের ৮১ কেজি মাংসের চাহিদা রয়েছে। সেই হিসেবে দেশে মাংসের চাহিদা ৬.৪ মিলিয়ন টন। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১.৪ মিলিয়ন টন। জনপ্রতি মাংস পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৭.৩ কেজি। অথচ চীনে ৫০ কেজি, জার্মানিতে ১০০ কেজি, আর্জেন্টিনায় ৭০ কেজি, আমেরিকায় ১০০ কেজি জনপ্রতি মাংস পাচ্ছেন। মাংসের এই ঘাটতি দূর করার জন্য সরকার ব্রাহমা জাতের গরু পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্রাহমা সখীপুরের খামারিদের মাঝে ম্যাজিক সৃষ্টি করেছে। অল্প সময়ে গরুর প্রচুর পরিমাণে মাংস বৃদ্ধির ঘটায় খামারিরা আমাদের সাধুবাদ জানিয়েছে।’

বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী ব্রাহমা দেশে আমিষের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, ৩ বছর বয়সী ১ টন ওজনের ষাঁড় কিংবা বকনা গরু খামারিরা ৪ থেকে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন।

প্রকল্প পরিচালক এমএ সামাদ জানান, ২০০৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে প্রথম ব্রাহমা নামের মাংসল জাতের ষাঁড়ের সিমেন আমদানি করে একটি শংকর মাংসল জাত সৃষ্টি করা হয়। এতে সফলতাও পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় গবাদিপশু উন্নয়নের কলেবর বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, ব্রাহমা জাতের গরুর সিমেন দিয়ে দেশি গাভির মাধ্যমে ওই জাতের গরু পালন করা হচ্ছে। অনেক আগেই দেশের বেশকিছু উপজেলায় এই প্রকল্প চালু হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলায় যাদের ন্যুনতম দুটি গাভি আছে এমন ১৩০ জন খামারিকে নির্বাচন করা হয়েছে। এদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। গাভি প্রজননের উপযুক্ত হলে বিনামূল্যে এই সিমেন দেওয়া হচ্ছে। সফলতা পেলে এর আকার আরো বৃদ্ধি করা হবে। উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে খামারিদের পরামর্শ, সহায়তা ও উৎসাহী করছেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক অজয় কুমার রায় বলেন, ‘এ জাতের গরু আমাদের দেশে আবহাওয়ার উপযোগী। এতে সফলতা পেলে অনেক বেশি মাংস উৎপাদন সম্ভব হবে। এরই মধ্যে এই প্রকল্প চালু হওয়া বিভিন্ন উপজেলা থেকে আমরা জানতে পেরেছি সফলতার খবর। পর্যায়ক্রমে এর আকার আরো বৃদ্ধি করা হবে। বিভিন্ন উপজেলায় খামারির সংখ্যাও বাড়ানো হবে। আসন্ন কোরবানির ঈদে এই প্রকল্পের অধীনে ব্রাহমা জাতের ষাঁড় কিংবা বকনা গরু খামারিরা বিক্রি করবেন বলে আশা করছি।’

ব্রাহমা জাতের গরুর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশি জাতের গরুর দৈহিক বৃদ্ধি প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। কিন্তু মাংসল জাত ব্রাহমা গরুর দৈহিক বৃদ্ধি এক থেকে দেড় কেজি। বাণিজ্যিকভাবেও এর পালন অনেক লাভজনক। এর মাধ্যমে মাংস উৎপাদনের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। এর আগে বাংলাদেশে কমবয়সে এত বেশি ওজনের মাংসল জাতীয় গরু উৎপাদিত হয়নি কখনো। এ জাতের গবাদিপশুর শরীরের আকার মাঝারি ধরনের হয়ে থাকে। জন্মের সময়ে বাচ্চার ওজন হয় ২৪ থেকে ২৫ কেজি। পূর্ণবয়স্ক গাভির ওজন ৬৫০ থেকে ৭০০ কেজি। শিং সাধারণত ছোট আকৃতির হয়। গরুর গায়ে ছোট ও মোটা লোমযুক্ত চকচকে চামড়া থাকায় বেশ গরম সহ্য করতে পারে এরা। গলার নিচে দীর্ঘ ও লম্বাকৃতির তুলতুলে গলকম্বল থাকে। গায়ের রঙ বাছুরের হালকা ধূসর থেকে লাল হয়। আবার অনেক সময় কালো হয়ে থাকে। পূর্ণবয়স্ক ষাঁড় সাদা ও কালো রঙের হয়। স্বভাবে শান্ত প্রকৃতির হলেও কর্মঠ। এ জাতের গরু পরিবেশের তাপমাত্রার তারতম্যের সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাছাড়া খাদ্য সঙ্কটের সময়ও খুব সাধারণ মানের খাদ্য খেয়ে দৈহিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ জাতের গরু ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও স্বাভাবিক আচরণ ও খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। অন্যান্য জাতের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন এই গরুর মাংসে চর্বির পরিমাণও কম। এই গরু নিয়ে স্বপ্ন দেখছে সখীপুরের কৃষকরা।

এসইউ//আইআই