সাহিত্য

বিব্রত ময়ূর : মানবিক বোধের ভিন্নস্বর

তরুণ কবিদের মধ্যে রাসেল রায়হান তার অবস্থানটা ধীরে ধীরে শক্ত-পোক্ত করে চলেছেন। ভিন্ন আঙ্গিক, ভিন্ন মাত্রা, ভিন্নতর উপস্থাপনা তাকে অনন্য ভিন্নতায় নিয়ে যাচ্ছে। তার দুটি কাব্যগ্রন্থই পাঠকপ্রিয়তার দাবি রাখে। পাঠকের মধ্যে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়েই কাব্যচর্চা করে যাচ্ছেন রাসেল রায়হান। খুব অল্প সময়েই তার নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে স্বীকৃতি। এগিয়ে যাবেন বহুদূর।

Advertisement

‘সুখী ধনুর্বিদ’র সফলতার পর তরুণ কবি রাসেল রায়হানের ‘বিব্রত ময়ূর’ পাঠককে শুধু বিব্রত করে না, প্রফুল্লও করে। ময়ূর বিব্রত হলেও পাঠক বিব্রত হবেন না। কেননা রাসেল রায়হানের কবিতায় মানবিক বোধের ভিন্নস্বর পরিলক্ষিত হয়। যেটা তার প্রথম কাব্যগ্রন্থেও আমরা দেখেছি।

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সুখী ধনুর্বিদ’র চেয়ে ‘বিব্রত ময়ূর’কে বেশি সাবলীল বা বোধগম্য মনে হয়েছে। স্বল্পায়তনের একটি কাব্যগ্রন্থ এতো বেশি ব্যপ্তি লাভ করেছে যে, পাঠের রেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকবে।

বিব্রত ময়ূরের পাণ্ডুলিপির জন্য কবি রাসেল রায়হান গ্রন্থ প্রকাশের আগেই জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৫ লাভ করেছেন। যতটুকু জানি, তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘সুখী ধনুর্বিদ’ হলেও পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতে ‘বিব্রত ময়ূর’ প্রথম। আরো সুখবর হচ্ছে, প্রকাশের পরপরই বইটির প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গেছে।

Advertisement

এবার তবে বইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করি, বিব্রত ময়ূরের কবিতা ‘কাঁটাতার’ পড়ে মনে হলো কবি হেলাল হাফিজের কথা। তিনি একটি বাক্যে অনেক কথা বলেছেন। এছাড়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি।’ তবে আমরা রাসেল রায়হানের ভাষা বোঝার আশা জলাঞ্জলি দিতে পারিনি।

কবি কথার জাদুতে পাঠককে আকৃষ্ট করে রেখেছেন। একবার পাঠের পর সেই মোহ রয়ে যাবে আজীবন। এখানেই কবির সার্থকতা। ‘পরম্পরা’ কবিতায় কবি নিটোল গল্প বলে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিতায় গল্প বলার ঢং আত্মস্থ করেছেন রাসেল রায়হান। যে গল্প ছুঁয়ে যায় প্রতিটি মানুষের মন। স্মরণ করিয়ে দেয় বাবার স্মৃতি। পরম্পরা কবিতার মতোই ‘মধ্যবিত্ত’, ‘পরিত্রাত্রী’ এবং ‘হারানো নগরী’। তবে ‘পরিত্রাত্রী’ কবিতাটি দীর্ঘ। অনেকটা ছোটগল্প সদৃশ।

তবে রাসেল রায়হানের একেকটি কবিতা একেক ধাঁচের। ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের দিকে যাত্রা। কাঁটাতারের মতোই ‘সন্ধ্যা’। অল্প কথায় অনেক আবেদন। তাঁর কাব্যভাষা নিছক সাদামাটা নয়, সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় রহস্যের গন্ধ। অমিত সম্ভাবনাময় এই তরুণ কবি পুরোটাই ধরে রাখতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

বিব্রত ময়ূরের আবেগময় পঙক্তিবিন্যাস পাঠককে মুগ্ধ করবে-১. ‘মানুষ বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে। দেখতে দেখতে ক্রমশ সে গুলিয়ে ফেলে-’ (বিবর্তন)

Advertisement

২. ‘শিকারি— ঘুমিয়ে আছি, তোর কাছে আরও গাঢ় তুই’ (ক্যামোফ্লেজ)

৩. ‘সেলাইগুলোর উহ্য গল্প থাকে— প্রতিটি ফোঁড় বলে দেয়, তারা কেমন আছে’ (দর্জি)

৪. ‘তোমার গন্ধে বাঘ এলে আমি গুলি ছুড়ে দেব অস্তিত্ব ও অস্থি বরাবর আমাদের পশ্চাতেই বন্দুক তাক করে, কে বলবে নেই— রাশি রাশি ঈশ্বরের চর?’ (টোপ)

৫. ‘এখনো সন্ধ্যা হলে খুব পাই টের জিরাফের ভাষা শুধু একা জিরাফের’ (সন্ধ্যা)

৬. ‘জিরাফ, শরীরভর্তি এত এত মানচিত্র! কাঁটাতার কই?’ (কাঁটাতার)

এমনতর বহু পঙক্তি পাঠককে মোহাবিষ্ট করবে। তাঁর ব্যক্তিগত সুতীব্র অনুভূতিও ধরা পড়বে কবিতার গায়ে। কবি বলেন, ‘বয়সের ঘ্রাণ নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে থাকি ক্রমে...’ (যুবতীকে)। অথবা ‘দুই বছরের রাসেল বলে ওঠে আড়ষ্ট জিবে, টঅঅঅ’ (উৎসর্গ)। কবি নিজেকে চিনিয়ে দেন নিজের ভাষায়, কবিতার চরণে।

কবিতার চুলচেড়া বিশ্লেষণে নাইবা গেলাম। সে দায়ভার পাঠকের কাঁধেই থাক। আমি শুধু প্রত্যেককে পড়বার আহ্বান জানাতে চাই। প্রচলিত অর্থে কবিতার বই নাকি বেশি বিক্রি হয় না। সেক্ষেত্রে বিব্রত ময়ূরের দ্বিতীয় সংস্করণ কবিতাপ্রেমী এবং কবিতাশ্রমিককে আশা জাগায়। এ সংস্করণ থেমে না যাক। বিব্রত ময়ূর প্রফুল্ল করুক সবার মনময়ূরকে।

প্রচ্ছদ : মাসুক হেলালপ্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০১৬প্রকাশনী : প্রথমা প্রকাশনমূল্য : ১২০ টাকা

এসইউ/জেআইএম