বিশেষ প্রতিবেদন

কারসাজি রোধে প্রয়োজন ‘দুর্নীতি-চাঁদাবাজি বন্ধ’

আত্মশুদ্ধির মাস রমজান। মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র মাস এটি। পাপ ও অপবিত্রতা থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং নিজের আত্মা ও হৃদয়কে সংযত রাখাই এ মাসের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এ মাসকে মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। ফলে অন্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এ মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়।

Advertisement

অসাধু এ চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে এবং পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে বাজারে যাতে পর্যাপ্ত পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত হয় সেজন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এজন্য ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) দক্ষ ও ভালো কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে টিসিবির কার্মক্রম তদারকি করতে স্বাধীন কমিটি গঠন করতে হবে- এমনটি মনে করছেন তারা।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোজার সময় কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে, যে কারণে ওই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কারণ চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। দাম নিয়ন্ত্রণের কথা বলে কোনো লাভ হয় না।’

‘তবে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিলে ভোক্তাদের কম দামে রোজার প্রয়োজনীয় পণ্য দেয়া সম্ভব। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পণ্য সংগ্রহে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে যাতে কোনো দুর্নীতি না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। কারণ আমরা দেখেছি ১০ টাকার চাল নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। এমনটি হলে কোনো ভাবেই দাম বাড়ানো বন্ধ করা সম্ভব হবে না’- বলেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

Advertisement

তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবেনই। তবে সরকার যদি ভালোমানের পণ্য সংগ্রহে রাখতে পারে, তবে ব্যবসায়ীরা ভয়ে থাকবেন। কারণ তখন তারা ভাববেন, সরকার তো কম দামে ভোক্তাদের পণ্য দিচ্ছে সুতরাং বেশি মুনাফা করা যাবে না। মোট কথা, দুর্নীতি বন্ধ করে সরকারের পক্ষ থেকে যদি ন্যায্যমূল্যে ভোক্তাদের পণ্য দেয়া যায়, তাহলে দাম বাড়ানোর কারসাজি বন্ধ হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোজার আগে বড় ব্যবসায়ীরা পণ্য স্টক (মজুদ) করেন। যে কারণে দাম বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা যাতে পণ্য স্টক করতে না পারেন সেজন্য সরকারকে মনিটরিং করতে হবে। প্রয়োজনে যে গুদামে তারা পণ্য রাখেন সেখানে মনিটরিং টিম পাঠাতে হবে। কেন তারা গুদামে পণ্য মজুদ করছেন তার জবাবদিহি করতে হবে।’

‘আবার পণ্য পরিবহনের সময় চাঁদাবাজি হয়- এমন অভিযোগ তুলেও ব্যবসায়ীরা রোজার সময় দাম বাড়িয়ে দেন। দেখা গেল, যে চাঁদাবাজি হয় ব্যবসায়ীরা তার চেয়ে বাড়িয়ে চাঁদাবাজি হওয়ার কথা তুলে ধরেন। এটা দাম বাড়ানোর একটি কৌশল। তবে চাঁদাবাজি যাই হোক পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে চাঁদাবাজির পথ বন্ধ করতে হবে’- বলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি আরও বলেন, ‘ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। একবারে পণ্য না কিনে অল্প অল্প করে পণ্য কিনতে হবে। তবে এজন্য সরকারকে ভোক্তাদের নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, বাজারে পর্যাপ্ত পণ্যের সরবরাহ থাকবে। টিসিবির মাধ্যমে ভালোমানের পণ্য ভোক্তাদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে টিসিবিতে দক্ষ ও ভালো লোক বসাতে হবে। মনিটরিংয়ের জন্য স্বাধীন কমিটি রাখতে হবে। যাতে কোনো দুর্নীতি না হয়। এসব পদক্ষেপ নেয়া গেলে রোজার মাসে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় থাকবে বলে আশা করা যায়।’

Advertisement

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোজার সময় পণ্যের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তারাও দায়ী। ক্রেতারা (ভোক্তা) একবারে পণ্য কিনে রাখেন, তখন বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। আমরা বার বার বলি, পণ্য একবারে কিনবেন না। সবাই চান কারও ঘাড়ে দোষ চাপাতে। এখন ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা অনেকবার দেখিয়েছি, শুধু ব্যবসায়ীদের দোষ নয়, ক্রেতারাও এজন্য দায়ী।’

কতিপয় ব্যবসায়ীর হাতে খেজুর ও ডালের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। এ বিষয়ে মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘এটা ঠিকই আছে। এমনটিই হয়। কমোডিটি বিজনেসের নিয়ন্ত্রণ থাকবে চার-পাঁচজনের হাতে, এটাই স্বাভাবিক। তারাও দেশপ্রেমিক। ওই চার ব্যবসায়ীর হাত ধরেই পণ্য চার হাজার ব্যবসায়ীর হাতে চলে যায়। জাহাজ বোঝাই করে মাল আনা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের (ব্যবসায়ীদের) ডেকে এনে মন্ত্রীর সামনে বসাই। তারা দাম বাড়াবে না বলে কমিটমেন্ট (অঙ্গীকার) করেন। গতবার আমরা দেখেছি তারা দাম বাড়াননি, আমরা আশাবাদী এবারও তারা দাম বাড়াবেন না।’

বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সফি মাহমুদ বলেন, ‘ছোলা, ডাবলি ও খেসারি- এ তিন পণ্যের ৬০-৭০ শতাংশ চাহিদা থাকে রমজান মাসে। তাই রমজান মাসে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম হলে দাম বেড়ে যায়। এসব পণ্য দেশে যে পরিমাণ পাওয়া যায় এর ৯০ শতাংশের বেশি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমরা যখন অধিক পণ্য আমদানির আগ্রহ দেখাই তখন বিদেশের ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। যে কারণে দাম কিছুটা বাড়ে। দাম বাড়ার পেছনে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কোনো কারসাজি নেই।’

তিনি বলেন, ‘রোজার সময় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে পর্যাপ্ত পণ্য বজারে সরবরাহ করতে হবে। সেই পণ্য অবশ্যই মানসম্পন্ন হতে হবে। পচা গমের মতো হলে হবে না। আর মানসম্পন্ন পণ্য রোজার আগেই আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখি, বাজারে যখন চাহিদা বাড়ে তখন সরকার পণ্য আমদানির পরিকল্পনা করে। সরকারের আমদানি করা পণ্য দেশে আসতে আসতেই রোজা শেষ হয়ে যায়। ফলে সরকারের সেই উদ্যোগের সুফল ভোগ করতে পারেন না সাধারণ ক্রেতারা।’

বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি নেছার উদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ান- রোজার সময় এমন অভিযোগ একটু বেশি ওঠে। এ অভিযোগ সঠিক নয়। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ান না। মূলত ব্যবসায়ীদের যখন বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই দাম একটু বাড়ে। রোজার সময় দাম যাতে না বাড়ে সেজন্য ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। ভোক্তাদের উচিত একবার সব পণ্য কিনে মজুদ না করে অল্প অল্প করে কিনতে। তাহলে পণ্যের সংকট হবে না, দামও বাড়বে না।’

এমএএস/এসআই/এমএআর/পিআর