দেশজুড়ে

নূর হোসেনই ভারতের ‘গোপাল’

ভারতের কলকাতার সদর স্ট্রিটে ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর পালিয়ে ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন। ভারত থাকার সময় ‘গোপাল’ নাম ধারণ করে রাধা নামে এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করেন নূর হোসেন। সেই সংসারে তার একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।আলোচিত সাত খুনের ঘটনার পরই উঠে আসে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের উচ্ছৃঙ্খল জীবনের নানা কাহিনী। তার বেপরোয়া জীবনের চিত্র তুলে ধরে সাবেক বান্ধবী ও সাবেক নারী কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস নীলা তার বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলেছেন। যদিও নীলা বরাবরই দাবি করে আসছেন, তার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নূর হোসেন তাকে বিয়ে করেছিলেন। একপর্যায়ে নূরকে ভালোও বেসেছিলেন নীলা।নূর হোসেনের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, নূর হোসেন ট্রাক হেলপার থেকে অবৈধ অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে কোটি টাকার মালিক বনে যান। নারীদের প্রতি আলাদা নেশা ছিল তার। সুন্দরী নারী দেখা মাত্রই তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে দখলে নেয়ার একটা নেশা ছিল তার। তার জীবনে অনেক নারী এলেও কেবল পাঁচজনকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন নূর হোসেন।এর মধ্যে প্রথম স্ত্রী লিলির বাড়ি ঢাকার মিলব্যারাক এলাকায়। তিনি এখন নূরের সংসারে নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী লিপির বাড়ি নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুরে। তার সংসারে বিপ্লব নামের এক ছেলে ছিল। কলেজপড়ুয়া এ ছেলে বাপের বসানো মদের দোকান থেকে মদ পান করতে করতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়েও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মদ সেবন করতে করতে নির্মমভাবে তার মৃত্যু হয়। তৃতীয় স্ত্রী পারুলের বাড়ি ডেমরার সারুলিয়ায়। তিনিও এখন নূরের সংসারে নেই। আর চতুর্থ স্ত্রী কাঁচপুরের রুমা। তার সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। রুমার সঙ্গেই সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে বসবাস করতেন নূর হোসেন। তার এই স্ত্রীর নামে অনেক সম্পদ গড়ে তোলেন।এছাড়া পঞ্চম স্ত্রী রাধার বাড়ি ভারতের কলকাতার সদর স্ট্রিটে ২০০১ থেকে প্রায় ৬ বছর ভারতে পালিয়ে থাকার সময় ‘গোপাল’ নাম ধারণ করে রাধাকে বিয়ে করেন নূর হোসেন। তখন ভারতের সবাই নূর হোসেনকে গোপাল বলেই জানতেন। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র আরও জানায়, ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের দিন ১ অক্টোবর রাতে নূর হোসেন পালিয়ে যান ভারতে। তাকে গ্রেফতার করতে ইন্টারপুলে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত বিফলে যায়। ভারতে ছয় বছরের মতো থেকে নূর হোসেন। সেখানে নিজের নাম-পরিচয় গোপন রেখে ‘গোপাল’ নাম পরিচয় দিয়ে এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে একটি ছেলে সন্তান হয়। শেষপর্যন্ত ওই নারীকে সেখানে রেখেই দেশে ফিরেন নূর হোসেন।মূলত বিএনপি-জামায়াত সরকারের ক্ষমতা শেষে ২০০৭ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে নূর হোসেন দেশে চলে আসেন। এরপর ফিরে যান তার আগের সাম্রাজ্যে। শুরু হয় তার সেই আগের রাজত্ব।  পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের লেখা ‘অতি জরুরি’ উল্লেখ করা একটি চিঠি পাল্টে দেয় নূর হোসেনের জীবন। চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে মেয়র মর্যাদায় পৌরসভার প্রশাসক পদে বসাতে এলজিআরডিমন্ত্রীকে তিনি এ চিঠি দেন।  ২০০৯ সালের ৮ জুন লেখা এ চিঠির জোরে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড ওয়ারেন্ট থেকে নূর হোসেনের নামকাটা হয়। চিঠিতে এইচ টি ইমাম নবগঠিত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভায় নূর হোসেনকে প্রশাসক পদে নিয়োগ দিতে এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ‘বিশেষ অনুরোধ’ জানান। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ হওয়ার পরই পাল্টে যায় পরিবেশ। অপহৃতদের স্বজনরা ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী করেন একসময়ের সন্ত্রাসীর গডফাদার নূর হোসেনকে। ২০১৪ সালের ১৪ জুন দুই সহযোগীসহ কলকাতায় গ্রেফতার হন নূর হোসেন। শেষ পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরদিন তাকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠান।২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার নূর হোস্সেহ ৩৫ আসামির বিচার শুরু হয়।  এর ১১ মাসের মাথায় রায় দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন, তাতে নূর হোসেনসহ ২৬ আসামির ফাঁসির রায় আসে। এমএএস/এএম/এমএস

Advertisement