জাতীয়

জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি শক্তিশালী হতে পারে না

জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি শক্তিশালী হতে পারে না

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে কার্যকর ও সময়োপযোগী করতে হলে আগে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সহমত গড়ে তুলতে হবে। একটি সুসংহত জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি শক্তিশালী হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: পররাষ্ট্রনীতি শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্ততায় এ কথা বলেন তিনি।

হুমায়ুন কবির বলেন, পররাষ্ট্রনীতি কেবল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এর মূল নির্দেশনা আসে সরকার প্রধানের কাছ থেকে। কিন্তু যদি দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতভেদ ও দ্বন্দ্ব থেকে যায়, তাহলে সেই নির্দেশনাও দুর্বল হয়ে পড়ে।

তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি নতুন জাতীয় আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আমরা সেই আত্মবিশ্বাসকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরতে পারছি না, কারণ অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করতে পারিনি।

Advertisement

হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশের কূটনীতির সবচেয়ে জটিল ক্ষেত্র হলো ঢাকা। রাজধানী যদি অস্থিতিশীল থাকে, রাজনৈতিক নির্দেশনায় যদি দ্বিধা থাকে, তাহলে বিদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকদের পক্ষে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব।

তিনি আরও বলেন, আমরা দলীয় স্বার্থে বাইরের শক্তিকে ব্যবহার করার ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতা দেখছি, যা রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে দুর্বল করে দেয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করে তোলে। যতদিন এই প্রবণতা চলবে, ততদিন পররাষ্ট্রনীতি শক্তি পাবে না।

হুমায়ুন কবির সমালোচনা করে বলেন, বাংলাদেশ গত ৫৪ বছরে মাত্র দুবার—১৯৮২ ও ১৯৯৫ সালে—পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ বিশ্বে বহু দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন নিয়মিত তাদের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির রিভিউ করে থাকে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশেও এখন যেহেতু নানা ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম চলছে, তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা উচিত।

Advertisement

যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিকে সময়োপযোগী করে তুলতে পারছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের অবস্থান দুর্বল থাকবে, বলেন তিনি।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবির বলেন, ভারত আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। ভৌগোলিক বাস্তবতায় আমাদের সম্পর্ক রাখতেই হবে। কিন্তু এই সম্পর্ক কী কাঠামোর ভিত্তিতে হবে, সে ব্যাপারে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহমত প্রয়োজন।

তিনি নেপালের উদাহরণ দিয়ে বলেন, নেপাল যখন শান্তি প্রক্রিয়ায় ফিরেছিল এবং মাওবাদীদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, তখন সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল—নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেবে। এই আত্মনির্ভরতা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

বর্তমান বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য একটি স্পষ্ট ও কার্যকর কৌশল প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রদূত।

তিনি বলেন, আজকের বিশ্বে বোঝা কঠিন কে বন্ধু আর কে শত্রু। বাইপোলার বিশ্বব্যবস্থার দিকে আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে।

সবশেষে হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশ মানুষের দেশ। পররাষ্ট্রনীতি হতে হবে মানুষের সম্মান, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তিতে। পররাষ্ট্রনীতি অর্ধেক নিজের, অর্ধেক বিশ্বের। তাই আমাদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও শক্তিই হতে পারে একটি কার্যকর পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি।

জেপিআই/এমআইএইচএস/জেআইএম