প্রান্তিকা এবং রেবেকা ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে বড় হয়েছে। এখন বয়স কুড়ি পেরিয়ে।‘বকুলতলায় ফুল কুড়ানোর স্বভাবটা তোর আর পরিবর্তন হলো না। সেই ছেলেবেলার মতো আজও স্বভাব-চরিত্র একই রয়ে গেলো। বলি, রোজ রোজ এত ফুল কুড়িয়ে কার জন্য মালা গাঁথিস সখি?’প্রান্তিকা বান্ধবী রেবেকার দিকে তাঁকিয়ে বললো, ‘শুধু কি মালা গাঁথার জন্যই আমার এই ফুল কুড়ানো সখি। আমি কেন রোজ রোজ বকুল কুড়াই, সে কথা আমি আর ওই মহাজন ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউই জানে না সখি।’‘তাহলে আমাকেও বল না তোর এই ফুল কুড়ানোর রহস্যের কথা।’ বান্ধবী রেবেকার কথায় মুচকি হাসে প্রান্তিকা। তার মধু মেশানো মিষ্টি সুরে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ বলবো। সময় হলে একদিন সবই তোকে খুলে বলবো। তবে আমার কুড়িয়ে জমানো প্রতিটি বকুলের সাথে একটি করে স্মৃতি জমা আছে।’
Advertisement
প্রান্তিকার কথায় অবাক হয় রেবেকা। নীরব হয়ে ভাবতে থাকে, বকুল কুড়ানো প্রতিটি ফুলের সাথে একটি করে স্মৃতি জড়ানো। এটা আবার কেমন অদ্ভুত কথা। আমার বান্ধবীর কিছু হলো না তো? নাকি জিন-পরির আছড় পড়েছে। প্রান্তিকাকে নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে যায় রেবেকা।
রেবেকার বিস্মিত হওয়া দেখে খিলখিলিয়ে ওঠে প্রান্তিকা। হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আমি জানি সখি, তুই আমার কথা শুনে অবাক হয়েছিস। ভাবছিস আমি এসব কী বলছি। তাহলে চল আমার সাথে। ফুল কুড়িয়ে আমি আমার স্বপ্নে সাজানো পৃথিবীটা তোকে দেখাবো।’ প্রান্তিকার কথায় ভয়ে কেঁপে ওঠে রেবেকা। মনে মনে বড় খতমের দোয়া পড়ে বুকের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিলো। তার ভয়টা যাতে কেটে যায়। অনেকটা ভিতু কণ্ঠে প্রান্তিকার উদ্দেশ্যে বললো, ‘তোর স্বপ্নের পৃথিবীটা আরেক দিন দেখবো। আমি এখন যাই রে সখি, মা ডাকছে।’ বান্ধবীর কাছ থেকে মিথ্যা অজুহাতে কোনো রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে বিদায় নিলো রেবেকা। প্রান্তিকা সেই বকুলতলায় বসে তার স্বপ্নের প্রহর গুনে যাচ্ছে।
বাড়ির উত্তর কোণে বিশাল একটি বকুল গাছ। গাছে অনেক ফুল ফোটে, ঝরে। প্রান্তিকার ছোটবেলা থেকেই বকুল কুড়ানোর ভীষণ শখ। সেগুলো দিয়ে সুঁই-সুতায় মালা গেঁথে গলায় পরে। বকুল কুড়ানোর মাঝে প্রান্তিকার স্বপ্ন মিশে আছে। ফুল ফুটলেই কুঁড়িয়ে মালা গাঁথে। মালা শুকিয়ে গেলে ডায়েরির পাতার ভাঁজে স্মৃতি করে রেখে দেয়। যার জন্য রোজ রোজ বকুল কুঁড়িয়ে মালা গেঁথে রাখে; একদিন হয়তো তার মনের ভালোবাসার কথাগুলো প্রকাশ হলে ডায়েরির প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে এক এক করে ভালোবাসার গভীরতা জানান দেবে।
Advertisement
ছেলেবেলা থেকেই প্রান্তিকা একটু ভারী স্বভাবের। শত কষ্ট হলেও নিজের কষ্টটা কাউকে বুঝতে দেয়নি। অন্যের ভালোর জন্য নিজের কষ্টটা খুব সহজেই হজম করে নিতে পারে। স্কুলে নবম শ্রেণির এক গ্রীষ্মের দুপুরে প্রান্তিকার জীবন খানিক বদলে গিয়েছিল। তখন ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়েছিল একটি ছেলে, অরিত্র। লাজুক, চুপচাপ স্বভাবের। গায়ের রঙে ঝকঝকে কিছু না থাকলেও চোখ দুটো গভীর আর স্বপ্নময়।
প্রথমদিনেই ক্লাসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলেছিলো, ‘আমি অরিত্র হাওলাদার। বাবা রেলওয়েতে চাকরি করেন। এখানে বদলি হয়ে এসেছি।’ প্রান্তিকা জানে না, কেন সেই মুহূর্তে তার বুকের গভীরে এক অদ্ভুত ঢেউ উঠেছিল। অরিত্রের চোখে ছিল এক ধরনের নীরব আত্মবিশ্বাস। তারা ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। তবে কেউ কখনো কারো খুব ঘনিষ্ঠ হয়নি। প্রান্তিকার ভেতরে জমে থাকে অরিত্রকে ঘিরে না-বলা হাজারো কথা, অনুভবের জট।
অরিত্র প্রায়ই মাঠে খেলতো, হাসতো, গল্প করতো। প্রান্তিকা দূর থেকে দেখতো। শুধু একবার, বৃষ্টিভেজা এক বিকেলে স্কুলের বারান্দায় অরিত্র ছাতা না পেয়ে ভিজে যাচ্ছিল; তখন প্রান্তিকা চুপচাপ নিজের ছাতাটা তার হাতে দিয়ে সরে গিয়েছিল।সেইদিনের স্মৃতি আজও ডায়েরির পাতায় লেখা আছে, ‘আজ আমি তাকে ছুঁয়ে দিলাম। যদিও সে জানলো না, এই ছোঁয়ার অপেক্ষায় কত বছর ধরে বসে আছি।’ এভাবেই প্রায় সময় অরিত্রকে ভেবে ডায়েরিতে ভালো লাগার কথাগুলো লিখে রাখে। প্রান্তিকার ডায়েরি যেন একান্ত তার প্রেমপত্রের থলে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় বকুল ফুলের শুকনো পাঁপড়ি সেঁটে আছে। তার নিচে লেখা অনুভবের শব্দ। ‘আজও চোখে পড়েনি মালাটা। কালকে আবার একটা রেখে যাবো। হয়তো কখনো একটিবারের জন্য হলেও সে বুঝবে, মালাগুলো শুধু তার জন্যই।’ প্রতিদিন সকালে প্রান্তিকা বকুল ফুল কুড়িয়ে গলায় মালা পরে স্কুলে যেতো। কেউ জানতো না, সেই মালাটা সে পরে রাখে যতক্ষণ না অরিত্রকে একটিবার দেখে। পরে বাড়ি ফিরে ডায়েরিতে রেখে দিতো সেই মালা। একটি মালা, একটি দিন, একটি দেখা।
ক্লাস টেনের শেষদিকে স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠান হয়। অরিত্র এক গানে গিটার বাজিয়ে অংশ নেয়। সেদিনই প্রথম প্রান্তিকা নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করেছিল। গানের মাঝে যখন অরিত্র কারো চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। প্রান্তিকা মনে মনে প্রার্থনা করেছিল, হয়তো ওর হাসিটা আমার জন্যই। হয়তো আজ ও বুঝবে, আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু কিছুই হয়নি। সেদিন অরিত্র চলে যায় অন্য শহরের কলেজে ভর্তি হতে। প্রান্তিকা পড়ে থাকে স্মৃতির দোলনায়।
Advertisement
প্রান্তিকা এখন একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করে। মুখে হাসি, চোখে নীরবতা। কিন্তু সেই পুরোনো অভ্যাস, বকুল কুড়ানো, মালা গাঁথা, ডায়েরিতে রেখে দেওয়া, সবই চলতে থাকে।একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরিচিত মুখ দেখে শ্বাস আটকে আসে তার।‘প্রান্তিকা? তুই!’ প্রান্তিকা থমকে দাঁড়ায়।‘অরিত্র?’‘হ্যাঁ। আমি এখানে বদলি হয়ে এসেছি। শুনলাম তুই এই কলেজেই পড়াস।’সেদিন দুজন হাঁটতে হাঁটতে একটা বকুল গাছের নিচে আসে। চারপাশে নিস্তব্ধতা। গাছের নিচে বসে অরিত্র হঠাৎ বলে বসলো, ‘প্রান্তিকা, তুই জানিস? স্কুলে থাকতেই আমি বুঝতাম, তুই আমার জন্য কিছু করিস। কিন্তু বলতে পারিনি কিছু। কারণ আমি নিজেও ভয় পেতাম এজন্য যে, এই ভালোবাসা যদি একপাক্ষিক হয়!’প্রান্তিকার গলায় যেন কথা আটকে যায়। চোখে পানি জমে আসে। হঠাৎ সে ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে অরিত্রের হাতে দিয়ে বললো, ‘এইটা তোর জন্য রেখেছি এতদিন। এখন সময় হয়েছে তোকে দেওয়ার।’
অরিত্র ডায়েরির পাতাগুলো ওল্টায়। প্রতিটি পাতায় একেকটা শুকনো বকুল ফুল, একেকটা তার নামে লেখা অনুভব। সে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিচু গলায় বলে, ‘প্রান্তিকা, আজ আমি জানলাম, ভালোবাসা সব সময় বলে দিতে হয় না। কেউ কেউ শুধু অনুভব করেও জীবনের সব অর্থ খুঁজে পায়।’প্রান্তিকা মুখ তুলে তাকায়। এই প্রথমবার তার অপ্রকাশ্য ভালোবাসা শব্দে রূপ নেয়। চারপাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বকুলের মৃদু সুবাস। গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো যেন দু’জনের হৃদয়ের মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করে। প্রান্তিকা একটি সাদা নরম কুড়িয়ে পাওয়া বকুল এগিয়ে দেয় অরিত্রের হাতে। বলে না কিছু। তবুও অরিত্র বুঝে নেয়, এই বকুলই তার উত্তর। অরিত্র হাত বাড়িয়ে ধরে প্রান্তিকার আঙুল।প্রান্তিকা চোখ বন্ধ করে, দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহরগুলোর সবটুকু নিঃশ্বাসে মিশিয়ে দেয়। এবার আর কোনো ডায়েরির পৃষ্ঠা নয়। তার ভালোবাসা এখন সশব্দ, দৃশ্যমান, বকুলের মতোই সত্য।
ঝরে পড়া হাজারো বকুলের পাঁপড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে দুটি আত্মা। একটি প্রেম, দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পরে অবশেষে পূর্ণতা পায়।
এসইউ/জিকেএস