ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্টের পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তা বাস্তবায়নে ১১টি কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের ১৩টি (মূলত ১১টি) সংস্কার প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এসব প্রস্তাবের বিষয়ে প্রথম সভা হয়।
Advertisement
জানা গেছে, গত ২৩ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের আয়োজনে পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত সুপারিশ বাস্তবায়নবিষয়ক প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। পুলিশ কমিশনারের আশু বাস্তবায়নযোগ্য বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এতে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, আলোচনা ও সিদ্ধান্তগ্রহণ
থানায় জিডি বাধ্যতামূলকপুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে আনা হয়েছে, থানায় জিডি রেকর্ড, মামলা রুজু তদন্ত ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে থানায় জিডি বাধ্যতামূলক, কোনোক্রমেই জিডি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সমস্যা সমাধানে অনলাইন জিডি গ্রহণ সর্বোত্তম সমাধান কারণ অনলাইনে জিডি দায়ের করা হলে তা গ্রহণ না করার কোনো অবকাশ নেই।
Advertisement
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, এরইমধ্যে ৭৫ শতাংশ থানা ইউনিটে অনলাইন জিডি কার্যক্রম চালু হয়েছে। সব থানায় পর্যায়ক্রমে অনলাইন জিডি কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এফআইআর গ্রহণে কোনোরকম অনীহা বা বিলম্ব করা যাবে নাফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) গ্রহণে কোনোরকম অনীহা বা বিলম্ব করা যাবে না, সংস্কার কমিশনের এ প্রস্তাবের ব্যাপারে বলা হয় নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়া অনলাইন এফআইআর চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এরইমধ্যে পুলিশ অধিদপ্তর থেকে অনলাইন এফআইআর চালু করার জন্য প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ফৌজদারি কার্যবিধিতে সংশোধনী প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনলাইন এফআইআরের ফরমেট তৈরির কার্যক্রম চলছে। এ কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
ফৌজদারি মামলার তদন্তে বিশেষায়িত দল গঠনফৌজদারি মামলার তদন্তের জন্য একটি বিশেষায়িত দল গঠন করতে হবে যাদের তদন্ত সংক্রান্ত ইউনিট ও থানা ব্যতীত অন্যত্র বদলি করা যাবে না। ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনা ও তদন্ত একটি ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের অধীনে পরিচালিত হতে হবে এবং ফৌজদারি মামলা প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত একটি বিশেষ তদন্ত দল হবে। এ সংস্কার প্রস্তাবের ব্যাপারে বলা হয়, বর্তমানে সিআইডি এবং পিবিআই বিশেষায়িত ইউনিট হিসেবে ফৌজদারি মামলা তদন্ত করছে। সভায় উপস্থিত স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজিপির ভাষ্যমতে, প্রতিটি থানায় মামলা তদন্তের জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। বিদ্যমান কাঠামোতে আলাদা বিশেষায়িত দল গঠন করা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এর জন্য নতুন নিয়োগের প্রয়োজন হবে এবং পৃথক ক্যারিয়ার প্লানিংয়ের প্রয়োজন হবে। তবে বিদ্যমান কাঠামোতে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় এ বিষয়ে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে অন্ততপক্ষে পাইলটভিত্তিক হলেও পৃথক বিশেষায়িত তদন্ত ইউনিট প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করতে হবে।
নিয়োগ-পদোন্নতিতে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় জানাবিদ্যমান কাঠামোতে কর্মরতদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। চাকরিপ্রার্থীর বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষা সনদপত্র যাচাই-বাছাই করার দায় দায়িত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে। এগুলো পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হবে না। পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা বন্ধ করাসহ এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংস্কার করা যেতে পারে। তবে চাকরিপ্রার্থী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা সংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে তা ভেরিফিকেশন রিপোর্টে প্রতিফলিত করতে হবে, চাকরির জন্য সব ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে এবং অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সবার মতামতের ভিত্তিতে চাকরিপ্রার্থীর বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষা সনদপত্র ট্রান্সক্রিপ্ট, মার্কশিট যাচাই-বাছাই পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
Advertisement
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব সুপারিশে গ্রেফতার তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অবিলম্বে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ করা হয়। অধিকন্তু রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক দায়েরকৃত আপিল বিভাগের পুনঃবিবেচনার আবেদনটি প্রত্যাহার কিংবা দূরত্ব নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে এর আলোকে প্রয়োজনে ফৌজদারি কার্যবিধিসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি প্রবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় পুলিশ সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশটি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স ২০২৫ জারি হয়েছে। আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া একটি আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ অবশ্যই থাকবে। নির্মিতব্য/নির্মাণাধীন থানার সময়ে এ ধরনের জিজ্ঞাসা বাদকক্ষ স্থাপন করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যান্য সব থানায় এ ধরনের কক্ষ স্থাপনের সম্ভাব্যতার বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা ক্রমে প্রতিবেদন প্রদান করার জন্য বলা হয়। পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানা ও কোট হেফাজতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং বন্দিদের কোর্ট থেকে আনা নেওয়ার সময় ব্যবহারকারী যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়। পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানা, কোর্ট হাজতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং বন্দিদের কোর্ট থেকে আনা নেওয়ার ব্যবহৃত যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। নারী আসামিকে যথেষ্ট শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, এ মর্মে পুলিশ মহাপরিদর্শক সভাকে অবহিত করেন। বিষয়টি অব্যাহত রাখতে হবে এবং এর যেন কোন ব্যত্যয় না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
তল্লাশির সময় জরুরি কল সার্ভিস চালুতল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে অথবা সার্চ ওয়ারেন্ট না থাকলে জরুরি যোগাযোগের জন্য নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে একটি জরুরি কল সার্ভিস চালু করা যায় বলে প্রস্তাবে বলা হয়। এছাড়া জব্দকৃত মালামালের যথাযথ তালিকা না হলে এবং তল্লাশি কার্যক্রমটি সন্দেহজনক মনে হলে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর জন্য মেট্রো এলাকায় ডেপুটি পুলিশ কমিশনার জেলা পুলিশ সুপারের বরাবর জরুরি কল সার্ভিস চালু করা যায় বলে উপস্থাপনায় বলা হয়। পৃথক হেল্পলাইন চালু পরিবর্তে বর্তমানে জাতীয় জরুরি সভা ট্রিপল নাইন এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রস্তাবিত সুপারিশ ট্রিপল নাইনের সংযুক্ত করা যেতে পারে। ট্রিপল নাইনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এরইমধ্যে একটি প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। অভিযান পরিচালনা করার সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের কাছে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসহ ভেস্ট পোশাক পরিধান করতে হবে।
সভায় পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে এটি শুরু হয়েছে। সারাদেশে কার্যক্রমটি শুরু করতে প্রায় ৪০ হাজার জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসহ ভেস্ট পোশাক প্রয়োজন হবে। সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। রাতের বেলায় (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়) বৃহৎ তল্লাশি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট/স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি/স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে বলে প্রস্তাবে বলা হয়। বর্তমানে প্রচলিত আইনে বিষয়টি সন্নিবেশিত আছে এবং এর কার্যকর প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
থানায় মামলা রুজু তথা এফআইআর গ্রহণ ও তদন্ত কঠোরভাবে সার্কেল অফিসার বা পুলিশ সুপার কর্তৃক নিয়ম করা হচ্ছে মর্মে পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। কেস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশ ব্যতীত কোনোক্রমেই এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেফতার করা যাবে না বলে সুপারিশে বলা হয়। এ বিষয়ে সিনিয়র সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, প্রতিক্ষেত্রে কেস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশক্রমে আসামি ধরতে হলে প্রকৃত অপরাধীর পালিয়ে যাওয়ার অবস্থা, ধরা না পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতি অধিক কার্যকর বিধায় তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
ভুয়া গায়েবি মামলাভুয়া গায়েবি মামলায় মৃত, নিরপরাধ নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য করতে হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। সভায় জানানো হয়, প্রচলিত আইনের বিধান রয়েছে এর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। প্রয়োজনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। অজ্ঞাতপরিচয়ের আসামির নামে মামলা দেওয়ার অপচর্চা পরিহার করতে হবে। কোনো পুলিশ সদস্য যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কাউকে এ ধরনের মামলা বা হয়রানি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। টিআই প্যারেডের মাধ্যমে অজ্ঞাতপরিচয়ের আসামি শনাক্তকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এর অপপ্রয়োগ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে উপস্থাপনবিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়।
উশৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি আইন, ১৮৬১ সালে পুলিশ আইন, ১৯৪৩ সালের বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন (পিআরবি) এর যথাযথ অনুসরণ করে এবং সেই সঙ্গে সময়ের ব্যবধানে আধুনিক বিশ্বে উশৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে যে সব প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করা হয় তা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক ৫ ধাপে বল প্রয়োগের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রণীত ধাপগুলোকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক বল প্রয়োগের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। এই পদ্ধতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসরণের লক্ষ্যে আইনগত বৈধতা দেওয়ার জন্য কমিশন সুপারিশ করেছে। এতে নূন্যতম ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির ঝুঁকি এড়িয়ে চলা সম্ভব পর হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। ইউনাইটেড ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বেসিক পুলিশ টেকনিক ম্যানুয়াল অনুযায়ী পাঁচ ধাপে বল প্রয়োগের বিষয়টি বাংলাদেশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বেসিক পুলিশ টেকনিক ম্যানুয়াল এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলছে এবং তা প্রতিপালিত হচ্ছে মর্মে পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান। এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তআইন প্রয়োগকারী সংস্থান সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য সরাসরি সব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করার জন্য পুলিশ সংস্কার কমিশনের তরফ থেকে জোর সুপারিশ করা হয়। কমিশন গঠিত হওয়ার পর নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন-২০১৩ এবং মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুপারিশ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে সিদ্ধান্ত হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা বা তাদের প্ররোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ স্থাপিত হলে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রধান নিজেই যাতে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান কার্যালয়েও একটি মানবাধিকার সেল কার্যকর থাকার বিষয়ে কমিশন সুপারিশ করে। বর্তমানে পুলিশ সদর দপ্তরে স্থাপিত আইজিপিস কমপ্লেন সেল এ মানবাধিকারসহ পুলিশ সদস্য কর্তৃক সংঘটিত যে কোনো অপরাধের বিষয়ে অভিযোগ করা যায়। অনুরূপ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে স্থাপন করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। সংবিধান, বিভিন্ন আইন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পুলিশ কর্তৃক অমান্য করার দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়ার জন্য নতুন হেল্পলাইন চালু করা কিংবা ট্রিপল নাইনের সেবার মধ্যে ধরনের অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়। ট্রিপল নাইনের প্রদত্ত সেবার মধ্যে এ ধরনের কার্যক্রম এরইমধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষাভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষার জন্য একটি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা উচিত যা জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। ডিসক্লোজার অব পাবলিক ইন্টারেস্ট ইনফরমেশন (প্রটেকশন) অ্যাক্ট-২০১১ এ সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। ভুক্তভোগীর সুরক্ষা ও সাক্ষীর সুরক্ষার জন্য আইন ও বিচার বিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাপুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং জনবান্ধব পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে র্যাবের অতীত কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনঃমূল্যায়ন করা যেতে পারে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং জনবান্ধব পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে র্যাবের অতীত কার্যক্রমও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পর্যালোচনা করে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের কার্যক্রম চলমান আছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যাজুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করার জন্য দোষী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, সাবেক আইজিপিসহ পুলিশ কনস্টেবল পর্যন্ত ৩৩ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে এবং ৪৭ জন বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আদালতের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানায় ইস্যু করা হয়েছে। দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পরীক্ষামূলকভাবে ৮টি বিভাগীয় মেট্রোপলিটন এলাকায় করোনার নিয়োগপুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা/ইউনিট শক্তিশালী করতে পরীক্ষামূলকভাবে আটটি বিভাগীয় মেট্রোপলিটন এলাকায় করোনার নিয়োগ এবং তার অফিস স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান যে একটি বিভাগীয় মেট্রোপলিটন এলাকায় করোনার নিয়োগ এবং পুলিশ অধিদপ্তর কর্তৃক অফিস স্থাপন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা শিগগির পেশ করা হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাব পাওয়ার পর সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠামামলার আলামত চিহ্নিতকরণ, সংগ্রহ পরিবহন ও সংরক্ষণের পেশাগত জ্ঞানের উন্নয়নের জন্য একটি ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, সব বিভাগীয় শহরে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং প্রতিটি বিভাগে একটি ক্রাইম সিন ইউনিট/ব্যালেস্টিক শাখা গঠন, প্রতিটি বিভাগে জাল নোট ও অন্যান্য জাল দলিলাদি শনাক্তকরণের জন্য ইউনিট গঠন করা, প্রতিটি বিভাগে একটি পদচিহ্ন শাখা, একটি হস্তলিপি শাখা ও ও একটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট শাখা গঠন করা ও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অটোমেটেড ডিএনএ ল্যাব স্থাপন করার সুপারিশ করা হয়। সভায় জানানো হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। ছয়টি বিভাগীয় শহরে এরইমধ্যে সাইন্টিফিক ইন্টিগ্রেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ সেন্টারগুলোতে একত্রে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরি, ক্রাইম সিন ইউনিট, ব্যালেস্টিক শাখা, জাল নোট ও অন্যান্য জাল দলিলাদি শনাক্তকরণ ইউনিট, পদচিহ্ন হস্তলিপি ফিঙ্গারপ্রিন্ট শাখা এবং অটোমেটেড থাকবে।
নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিবাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের জন্য বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থাকে গতিশীল এবং কাঠামোগত দক্ষতা বৃদ্ধির স্বার্থে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আওতায় সহকারী পুলিশ সুপার নিয়োগ যেভাবে করা যেতে পারে তা হলো
বর্তমানে সরকারি পুলিশ সুপার নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা প্রয়োজন তা উপেক্ষিত হচ্ছে। এজন্য বর্তমান বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগের জন্য আলাদাভাবে শারীরিক যোগ্যতা (উচ্চতা ও ওজন) পরিমাপ ফিজিক্যাল অ্যান্ড ডিউরেন্স টেস্ট, ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে আবেদনের যোগ্যতা নিরূপণ করা যায়। এতে আগ্রহী ও যোগ্য প্রার্থীরা আবেদন করার জন্য সহজে বিবেচিত হতে পারবেন। এক্ষেত্রে দ্যা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস অ্যান্ড ফোর্সমেন্ট পুলিশ কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুলস ১৯৮০-সহ সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়নের সুপারিশ করা হয়। বিদ্যমান নীতিমালায় পুলিশ ও আনসার ক্যাডারের জন্য আলাদা শারীরিক যোগ্যতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অবশিষ্ট সুপারিশ বাস্তবায়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনাপূর্বক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতিবেদন প্রদান করবে বলে সভায় বলা হয়।
সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভায় বাংলাদেশ পুলিশের এজেন্ডা থাকলে আইজিপিকে বোর্ডে উপস্থিত রাখার সুপারিশ করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে এরইমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির বিষয়গুলো পর্যালোচনা পূর্ব প্রতিবেদন প্রদান করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বিশেষত পুলিশ যথা (সিআইডি সাইবার অপরাধ বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন ফিঙ্গারপ্রিন্ট) স্ব স্ব বিভাগের ভেতরে বা সংশ্লিষ্ট পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রদান করতে হবে বলে সুপারিশ করা হয়। যে সব পুলিশ সদস্য সিআইডি, সাইবার অপরাধ, বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন করেছেন তাদেরকে বিবেচ্য সময়ে পদায়নে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। কনস্টেবল থেকে এএসআই এবং এএসআই থেকে এসআই পদোন্নতিতে প্রতিবছর পরীক্ষা দেওয়া এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার রীতি বাতিল করে একবার উত্তীর্ণ হলে তাকে শারীরিক যোগ্যতার সাপেক্ষে পরবর্তী তিন বছরের জন্য পদোন্নতির যোগ্য বিবেচনায় সুপারিশ করা হয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, যে দীর্ঘদিনের প্রচলিত রীতি হঠাৎ করে বাতিল করলে সার্ভিসের অপেক্ষাকৃত নবীন সদস্যরা পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং তাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হবে। বিষয়টি ফোর্সের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ হতে পারে মর্মে তিনি জানান। এমতাবস্থায় সুপারিশটি বাস্তবায়নের সমস্যা ও সম্ভাবনা উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তর একটি প্রতিবেদন প্রদান করবে বলে তিনি জানান। বিভাগীয় পদোন্নতি নীতিমালা সংস্কার করে কনস্টেবল এসআই নিয়োগ তরফ থেকে একটি ক্যারিয়ার প্ল্যানিং প্রণয়ন করতে হবে যাতে সদস্যদের মধ্যে পেশাদারত্ব উন্নয়ন দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় বলে সুপারিশ করা হয়।
নিয়োগের সুপারিশবর্তমানে থানাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সংখ্যা শতকরা মাত্র ৮ শতাংশ যা জনসেবা বৃদ্ধিতে নিতান্তই অপ্রতুল। থানাসহ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন এবং সব অন্যান্য ইউনিট ও অফিসে কাঙ্ক্ষিত নারী পুলিশের সংখ্যা বর্তমানে ১৬ হাজার ৮০১ থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৯ হাজার ২৪৮ জন করার জন্য সুপারিশ করা হয়। সংস্কার অগ্রাধিকার হিসেবে ৮ হাজার এসআই নিয়োগের প্রস্তাব সরকার কর্তৃক বিবেচনাধীন। তন্মধ্যে ১০০০ নারী পুলিশ সদস্য নিয়োগের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানানো হয়।
পুলিশের জন্য একটি পরিপূর্ণ মেডিকেল সার্ভিস গঠনের প্রস্তাবস্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জানান, মেডিকেল সার্ভিস গঠন করা হলে এর আওতায় নিয়োগকৃত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পদোন্নতি ও পদায়নের বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হবে। ফলে তাদের মধ্যে পেশা নিয়ে হতাশা তৈরি হবে এবং তাদের কাছ থেকে সেবা প্রাপ্তি ব্যাহত হবে। এমতাবস্থায় নিচের দিকের পদে চিকিৎসক নার্স ও টেকনোলজিস্টসহ সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্যসেবা থেকে প্রেষণে এবং সিনিয়র পর্যায়ে প্রেষণে/চুক্তিভিত্তিক কনসালটেন্ট নিয়োগ করে স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি নিশ্চিত করা যায় মর্মে সিনিয়র সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ প্রস্তাবটি পর্যালোচনাপূর্বক একটি প্রতিবেদন প্রদান করবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
ভাসমান থানা গঠনবরিশাল, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা ও ভোলাসহ সমগ্র দেশে আনুমানিক ২৪ হাজার ১৪০ বর্গ কিলোমিটার জলপথমণ্ডিত এলাকা নৌ-নেটওয়ার্কভুক্ত রয়েছে। তাই এই অঞ্চলে নদীপথে দস্যুতা চোরাচালান ও মানবপাচারসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে এ সব জেলায় ভাসমান থানা গঠন করার সুপারিশ করা হয়। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ভাসমান থানা চিহ্নিত করে এ সব এলাকায় বিদ্যমানসহ অন্যান্য লজিস্টিকস এর সংখ্যাও পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় প্রকল্প প্রণয়ন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। সভায় বলা হয়, একটি আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে নৌ পুলিশকে শক্তিশালী করণপূর্বক এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এর আওতায় ভাসমান থানা গঠনের পরিবর্তে নৌফাঁড়িগুলো সুসংগঠিত করা এবং নৌযানসহ অন্যান্য লজিস্টিক সরবরাহ করা যেতে পারে। কমিশনের সুপারিশের আলোকে নৌ পুলিশকে শক্তিশালী করার একটি পরিকল্পনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাখিল করবে। এর ভিত্তিতে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাধ দমনপার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাধের ধরন শুধু ভূমি বিরোধ ও দৈনন্দিন ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয় বরং সশস্ত্র সংঘাত ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঝুঁকির সৃষ্টি করে। চিটাগাং হিল অ্যাক্ট রেগুলেশন-১৯০০ অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক বিচার আচার সম্পন্ন হওয়ার সংস্কৃতি এখনো চালু আছে। এ অবস্থায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত পুলিশ তাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ সম্পাদন করতে উদ্যোগী থাকবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। পার্বত্য এলাকায় শালিস ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, সামাজিক বিচার আচার এবং সংস্কৃতি সমতল এলাকা থেকে ভিন্নতর উল্লেখ করে পার্বত্য এলাকার এ বিষয়গুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইন প্রয়োগ জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি আরও জানান, পার্বত্য শান্তি চুক্তির আওতায় স্থানীয় ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে আলাদা পুলিশ বাহিনী গঠনের দাবি রয়েছে। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীকে পার্বত্য এলাকার সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইন প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওরিয়েন্টেশন ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
ব্রিটিশ আমলে প্রণীত কিছু কিছু আইন ও প্রবিধান যুগের প্রয়োজনে সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কমিশন নিম্নলিখিত আইনগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তা যোগ্য উপযোগী করার সুপারিশ করছে।
পুলিশ আইন ১৮৬১পুলিশকে জনবান্ধব ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক বাহিনীর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য এ আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমার্জন অথবা নতুন আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।
ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮বল প্রয়োগ ও মানবাধিকার সুরক্ষা আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়। পিআরপি-১৯৪৩ জনবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গঠনে এ প্রবিধানমালায় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিবর্তন/পরিবার জন অথবা নতুন প্রভিধানমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। পুলিশকে জনবান্ধব ও জনগণের কাছে জবাবদিহি মূলক বাহিনী/প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য পুলিশ আইন ১৮৬১ ফৌজদারি কার্যবিধি ও ১৮৯৮ এবং পিআইবি-১৯৪৩ যুগোপযোগী করার বিষয়ে সবাই মতামত প্রকাশ করেন। তবে প্রতিটি আইন একটি অন্যটির সঙ্গে এবং বর্ণিত আইনসমূহ ছাড়া অন্যান্য আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় এর পরিবর্তন সহজসাধ্য নয়। এরইমধ্যে বল প্রয়োগ ও মানবাধিকার সুরক্ষায় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রস্তাব করা হয়েছে। অপর দুইটি আইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমাপের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন ও বিচার বিভাগ ও পুলিশ সদর দপ্তর এ বিষয়ে পর্যালোচনাপূর্ব একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স ২০২৫ জারি হয়েছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন সামগ্রিক বিষয়ে ধর্তব্য নিয়ে একটি নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করা হয়। প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে নাকি সাংবিধানিক কাঠামোভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান হবে তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে হওয়া বাঞ্চনীয়। পুলিশ কমিশনের গঠন কার্য পরিধি সাংবিধানিক ও আইনগত বাধ্যবাধকতা আইনে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয়াদি বিচার বিশ্লেষণ ও যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। সুপারিশসমূহ পর্যালোচনাপূর্বক মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর একটি প্রতিবেদন প্রদান করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় মামলা প্রদানের ক্ষেত্রে বডি ওর্ন (bodyworn) ক্যামেরাসহ উন্নত প্রযুক্তির সন্নিবেশ করা যেতে পারে। মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে মনিটরিং ব্যবস্থার জোরদার করতে হবে। রাস্তায় যানবাহনে নির্মিত চেকিং বা চেকপোস্টের মাধ্যমে চেকিং এর ক্ষেত্রে বডি ওর্ন যে ক্যামেরা বা সিসি ক্যামেরায় সন্নিবেশন বা প্রয়োগ নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান যে, সারাদেশে কার্যক্রমটি শুরু করতে প্রায় ৪০ হাজার জিপিএস ট্রাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসহ ভেস্ট পোশাকের প্রয়োজন হবে।
কারাগারে নিরাপত্তা বৃদ্ধিকারাগারে নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামীতে নতুন কারাগার ও পুলিশ লাইন্স এর মধ্যবর্তী দূরত্ব যথাসম্ভব কম রাখতে হবে যাতে একটি সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় এক্ষেত্রে ফৌজদারি বিচার প্রশাসন ও জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়। ভবিষ্যতে কারাগার/পুলিশ লাইন স্থাপনের ক্ষেত্রে সুপারিশটি বিবেচনা করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
মাদক সংক্রান্ত অপরাধ দমনে নিয়োজিত সংস্থার জন্য একটি সফটওয়্যার বা ডাটাবেজ তৈরি করার সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যার মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অধিদপ্তরের নিজস্ব সিডিএমএস তৈরি ও জনগণের প্রবেশের অধিকার প্রদানের সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সিপিএমের সফটওয়্যারে অনেক স্পর্শকাতর তথ্য সংরক্ষিত থাকে। এ সফটওয়্যার এ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাইরে যে কারো প্রবেশাধিকার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে মর্মে পুলিশ মহাপরিদর্শক উল্লেখ করেন। এ কারণে সফটওয়্যারটিতে জনগণের সরাসরি প্রবেশাধিকার প্রদান করা যুক্তিযুক্ত হবে না। তিনি জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নিজস্ব সিডিএমএস তৈরি করতে পারে এবং এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে পারে। তবে জনসাধারণের অ্যাকসেস সংরক্ষিত থাকাটাই যৌক্তিক।
এমইউ/এসএনআর/জেআইএম