মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর বেশকিছু দিন পার হয়ে গেছে। নগরবাসী অনেকটাই স্বাভাবিক কাজকর্ম, আনন্দ-আয়োজনে যোগ দিয়েছি। কিন্তু ওই স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে যে তীব্র ট্রমা সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠাই এখন সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করার পথগুলো নিয়েই এই আলোচনা।
Advertisement
একদিন আগে আয়ান চলে গেল, ওর বাবা-মা, আত্মীয়রা বুকে পাথর বেঁধে দুর্ঘটনার দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত আইসিইউ এর সামনে অপেক্ষা করেছিলেন সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু বিধি বাম, তারা আয়ানের নিথর দেহ নিয়ে ফিরে গেলেন। ওর মা-বাবার কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ। কোনোভাবে শুধু বেঁচে থাকা। আয়ানের মামা বললেন, আমার বোনকে মনে হয় বাঁচানো যাবে না। আপা ক্রমাগত সবকিছু গ্রহণ করতে অস্বীকার করছে।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরাজ বললো, “চোখের সামনে অনেক ছোট ভাই-বোনকে পুড়তে দেখেছি। কারও শরীর ছিন্নভিন্ন। বুঝতেই পারছিলাম না যে আমি স্বপ্ন দেখছি, নাকি সত্যি! সেই স্মৃতি থেকে আমি বের হতে পারছি না।” একই কথা বলেছে ওই স্কুলের ছাত্রী নাঈমা। ছোট ছোট ভাইবোনদের অগ্নিদগ্ধ মুখ, শরীর চোখে ভাসছে। এই দৃশ্য ভুলতে চাইছি কিন্তু পারছি না। এভাবেই শিশুদের মনে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক আঘাত সৃষ্টি হয়েছে। শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “শিশু-কিশোরদের স্মৃতিতে এই ধরনের ট্রমার অভিজ্ঞতা একটি অস্বাভাবিক গড়ন ও মাত্রা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে যেতে পারে। এর ফলে শিশুদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা, ভয়, দুঃস্বপ্ন, এবং স্কুলে ফিরে যাওয়ার অনীহা দেখা দিতে পারে।”
পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখলাম মাইলস্টোন স্কুলের একজন শিক্ষক বলছেন, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর তিনি সাত-আটজন শিক্ষার্থীসহ একটি কক্ষে ধোঁয়ায়। আটকে পড়েছিলেন। “আমি এখনো ট্রমার মধ্যে আছি। শিশুর পোড়া দেহ, বিচ্ছিন্ন অঙ্গ, এবং রক্তাক্ত পরিবেশ দেখেছি, যা এখনো মনে গভীর ক্ষত হয়ে আছে।”
Advertisement
মাইলস্টোন দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানান রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ, নানান আন্দোলন, দোষ-ত্রুটির বিচার, নানান অব্যবস্থাপনার কড়চা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু এখান আমাদের সবচাইতে বড় আলোচনা হওয়া উচিত বেঁচে থাকা শিশু ও শিক্ষক ও অভিভাবকদের ট্রমা। যে অভিভাবকরা সন্তান হারিয়েছেন, যারা আহত সন্তানের পাশে বসে ক্রমাগত কেঁদেই চলেছেন এবং যারা সেইসময় স্কুলের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারও ভয়াবহ ট্রমা হয়েছে।
ঠিক এই অবস্থায় খবরে দেখলাম সীমিত পরিসরে এত তড়িঘড়ি করে ক্লাস শুরুর কথা ভাবছেন মাইলস্টোন স্কুল কর্তৃপক্ষ। পরে অবশ্য তারা বলেছেন, এখনো অসংখ্য বাচ্চা মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। কারো কারো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষক অভিভাবকদের মানসিক অবস্থার কথা ভেবে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রশ্নই আসে না।
যে শিশুরা বেঁচে গেছে, তারা কীভাবে তাদের সহপাঠীদের চলে যাওয়া এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে? এই ট্রমা তাদের তাড়া করে ফিরবে আরো বহু সময়। এই ভয়াবহ ট্রমাকে উপেক্ষা করে স্বাভাবিক অবস্থা দেখাতে চাওয়া খুব কঠিন। পড়াশোনা খুব জরুরি কিন্তু এতো জরুরি না যে, মানবিক বিপর্যয়কে অস্বীকার করতে হবে।
যে শিশুরা বেঁচে গেছে, তারা কীভাবে তাদের সহপাঠীদের চলে যাওয়া এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে? এই ট্রমা তাদের তাড়া করে ফিরবে আরো বহু সময়। এই ভয়াবহ ট্রমাকে উপেক্ষা করে স্বাভাবিক অবস্থা দেখাতে চাওয়া খুব কঠিন। পড়াশোনা খুব জরুরি কিন্তু এতো জরুরি না যে, মানবিক বিপর্যয়কে অস্বীকার করতে হবে।
Advertisement
বাংলাদেশ এমনই একটি দেশ যেখানে ট্রমা বিষয়টা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষিত ও অবহেলিত। অধিকাংশ মানুষ বুঝতেই পারেন না বা বুঝতে চেষ্টা করেন না ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কষ্ট। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর আমরা দেখেছি কতটা অসংবেদনশীলভাবে ট্রমাটাইজড মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে, বর্ণনা দেয়া হচ্ছে, ছবি-ভিডিও প্রকাশ করা হচ্ছে, যা ভীষণ কষ্টের।
ছোট থেকে বয়স্ক মানুষ এসব দেখছেন, শুনছেন এবং দারুণভাবে মর্মাহত হচ্ছেন। কীভাবে এরকম একটি পরিস্থিতির খবর ও ছবি ব্যবহার করা উচিত বা কীভাবে আহত ও তাদের পরিবারের সাথে কথা বলা উচিত সেটা নিয়েও আমরা সচেতন নই। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যে শিশু আহত হয়নি, ঐ শিশুরও ইন্টারভিউ নেয়া যাবে না।
আমরা দেখছি দুর্ঘটনা পর যে শিশুরা বেঁচে গেছে, তারা গভীর মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। আগুন, ধোঁয়া, অগ্নিদগ্ধ মানুষ, ছুটাছুটি, ভয়ার্ত চিৎকার এবং সহপাঠীদের মৃত্যু বা আহত হওয়ার দৃশ্য তাদের মনে দীর্ঘমেয়াদি ভয় ও ট্রমার সৃষ্টি করেছে।
অভিভাবকদের শোক এবং সমাজে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতারতাও শিশুদের মানসিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলছে। হয়তো আগামী কয়েক মাস বা বছর বাচ্চারা এই ট্রমা বহন করবে। এত ভয়াবহ দুর্ঘটনা শিশুদের জন্য চারপাশের পরিবেশকে আরও জটিল করেছে। এই ঘটনা শিশুদের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। তারা অনেকেই হয়তো বেশ কিছুদিন স্কুলে যেতে ভয় পাবে।
যে শিশুরা বেঁচে আছে, যারা আহত হয়েছে, যে অভিভাবকরা সন্তান হারিয়েছেন, যারা হারাননি এমন সব মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কাউন্সেলিং সেবা খুব জরুরি। এই ট্রমা কীভাবে কাটাবে? মনোবিজ্ঞানীরা কী বলেন? ট্রমা কাটিয়ে ওঠার জন্য মনোবিজ্ঞানীরা কী কী কার্যকর পদ্ধতি ও পরামর্শ দিয়েছেন, তা সবাইকে জানাতে হবে।
মাইলস্টোন দুর্ঘটনা শিশু, অভিভাবক, শিক্ষক, প্রত্যক্ষদর্শী, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ সাধারণ মানুষের উপর বিভিন্ন ধরনের মানসিক প্রভাব ফেলেছে। অনেকেই হয়তো বুঝতে পারছেন না কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষয় হচ্ছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্ন, ভয়, ঘুমের সমস্যা, স্কুলে যাওয়ার অনীহা, মনোযোগের অভাব, এবং আচরণগত পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এরমধ্যে একটি শিশুর মুখে শুনলাম “সে আর স্কুলে যেতে চায় না।”
শুধু শিশুরা নয়, অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সন্তান হারানোর শোক তাদের অবিন্যস্ত ও পাগল করে তুলেছে। তারা ভাবছেন অমূল্য সম্পদ হারিয়ে কীভাবে জীবন কাটাবেন? এই শোক তাদের মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ ও রাগ তৈরি করেছে। হয়তো এই স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য তারা নিজেদেরই দায়ী মনে করছেন। তারা আশঙ্কায় ভুগছেন এধরনের দুর্ঘটনা হয়তো আবার হবে। অভিভাবকদের মধ্যেও ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগ কাজ করছে। তারা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়।
আমরা উত্তেজনার বশে বারবার শিশুদের কাছে ঘটনার বিবরণ শুনতে চাই। কিন্তু মনোচিকিৎসকরা বলেন, দুর্ঘটনার কথা শিশুদের বলতে বাধ্য করা উচিত নয়, কারণ এটি ট্রমাকে আরও গভীর করতে পারে। এমনকি “সব ঠিক হয়ে যাবে” এধরনের আশ্বাসও দেয়া ঠিক নয়। কারণ এটা শিশুকে এতোটাই আশাবাদী করে তুলতে পারে যে পরবর্তীতে কোনো দুর্ঘটনা তাদের আরো বেশি আহত করতে পারে।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনও পর্যাপ্ত নয়। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী দেশে মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলরের সংখ্যা খুবই কম, এবং সেইসাথে মানসিক সাপোর্ট গ্রহণ করা নিয়ে জনসচেতনতার অভাব রয়েছে। তবে, মাইলস্টোনের মতো ঘটনার পর সরকার ও এনজিওগুলো কাউন্সেলিং সেবা চালু করতে পারে। বিশেষ করে ট্রমার লক্ষণগুলো, যেমন অতিরিক্ত নীরব হয়ে যাওয়া, একা সময় কাটানো, রাগ বৃদ্ধি পাওয়া, বা নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি ইস্যুগুলো উপেক্ষা করা উচিত নয়।
শিশুদের সঙ্গে দুর্ঘটনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত। তাদের মনের ভয়, আচরণগত পরিবর্তন ও অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। স্কুলে পাঠানোর জন্য জোরজবরদস্তি করা উচিত হবে না। শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও ট্রমা বিষয়ে কাউন্সেলিং করা দরকার।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হওয়া উচিত, কিন্তু মাইলস্টোনের ঘটনা দেখে মনেহয়েছে যেকোনো স্কুল ঝুঁকির মুখে থাকতে পারে। স্কুলগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, জরুরি প্রস্থান পথ, এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ থাকা দরকার।
গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মাধ্যমগুলো যেহেতু ঘটনার পর পরই দ্রুত তথ্য ছড়িয়ে দেয়, তাই এমন কোনোকিছু ছড়িয়ে দেয়া উচিত নয়, যা ঘটনার কষ্টদায়ক রুপ ও প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে। কখনো কখনো তথ্যের অতিরঞ্জন বা গুজব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে। ঘটনা ঘটার পরপরই নানারকম গুজব জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ বাড়ায়। সেই সাথে শিশুদের আরো ট্রমাটাইজড করে। এখন সময় এই দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষকে ট্রমা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করা।
লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/জেআইএম