আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া, সেলিব্রিটি বা ফিটনেস ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে নানা ‘ট্রেন্ডি ডায়েট’ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোর প্রধান ফেকাস থাকে দ্রুত ওজন কমানোর ওপর। কিন্তু কিছু ডায়েট আমাদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। জেনে নিন এমন কিছু জনপ্রিয় ও ঝুঁকিপূর্ণ ডায়েট বিষয়ে-
Advertisement
১. জুস ডায়েট
এই ডায়েট অনুসরণ করলে মানুষ কয়েকদিন শুধুমাত্র ফল ও সবজির রস খেয়ে থাকে। শুনতে স্বাস্থ্যকর মনে হলেও, এতে শরীরের জন্য জরুরি পুষ্টি যেমন প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, এবং স্বাস্থ্যকর চর্বির অভাব দেখা দেয়। এভাবে চললে শরীরে শক্তির ঘাটতি, রক্তশূন্যতা এমনকি হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হয়। এমনকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কেউ জুস ডায়েট করলে রক্তে চিনির পরিমাণ হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে, যা বিপজ্জনক।
এই খাদ্যতালিকায় কোনো ফাইবার নেই, যার কারণে পরিপাক ও মাইক্রোবায়োম ভারসাম্য নষ্ট হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র তিন দিনের জুস ডায়েটেও অন্ত্র ও মুখের ব্যাকটেরিয়ার পরিবর্তন হয়ে প্রদাহ এবং মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে।
Advertisement
২. সুগার-ফ্রি ডায়েট
কিছু ডায়েট আছে, যেগুলোতে শুধু পরিশোধিত চিনি বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়, যা আসলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আবার কিছু ডায়েটে ফল বা দুগ্ধজাত খাদ্যের প্রাকৃতিক চিনিও পুরোপুরি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এভাবে খাওয়া-দাওয়ার ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
ফল বাদ দিলে শরীর নানা প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থেকে বঞ্চিত হয় এবং দুধ বাদ দিলে হাড়ের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামের অভাব হয়। এই ডায়েট দীর্ঘমেয়াদে শরীর দুর্বল করে তোলে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বা রক্তশূন্যতার কারণ হতে পারে।
একদিকে অতিরিক্ত চিনি কমানো হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও স্থূলতার ঝুঁকি কমায়। কিন্তু অন্যদিকে শস্যজাত শর্করা বাদ দিলে এনার্জি কমে যায়, ক্লান্তি ও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। দুধ বাদ দিলে ক্যালসিয়ামের অভাবে অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি বাড়ে।
Advertisement
৩. ডিটক্স ডায়েট
ইদানিং মাস্টার ক্লিন্স বা এলিমিনেশন ডায়েটের মাধ্যমে শরীর থেকে ‘টক্সিন’ বের করার এক ধরণের ডায়েটের কথা প্রায়ই শোনা যায়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এই ডায়েটগুলোতে সাধারণত নানা ধরনের চা, রস বা সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দেয়, যা শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। কিন্তু সত্যিটা হলো, আমাদের লিভার আর কিডনি এমনিতেই প্রতিদিন শরীর পরিষ্কার রাখে। কোনো চা বা ডিটক্স পানীয় আসলে এই কাজগুলো আরও ভালো করে করতে পারে না, বরং অতিরিক্ত কিছু পদার্থ শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। বেশি দিন এই ধরনের ডায়েট অনুসরণ করলে পুষ্টির অভাব, ক্লান্তি, হজমের সমস্যা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
৪. কিটো ডায়েট
বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত হলো কিটো ডায়েট। এই ডায়েটে সব ধরণের কার্বহাইড্রেট বা শর্করা বাদ দিতে বলা হয়। এই ডায়েট অনুসরণ করলে শরীর কম কার্বোহাইড্রেট এবং বেশি চর্বি গ্রহণ করে। শরীর তখন শক্তির উৎস হিসেবে গ্লুকোজের বদলে ফ্যাট পোড়াতে শুরু করে।
যদিও এতে শুরুর দিকে ওজন কমে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি টিকিয়ে রাখা কঠিন। আবার এতে হজমের সমস্যা, ক্লান্তি, হৃদযন্ত্রে প্রভাব এবং ভিটামিনের ঘাটতির মতো ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে যারা হৃদরোগে ভুগছেন, তাদের জন্য এটি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
এই ডায়েটের ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট প্রায় সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে মূলত ফ্যাট ও প্রোটিন বেশি খাওয়া হয়; ফলে শরীর কেটোসিস নামক অবস্থায় যায়, যেখানে ফ্যাটই জ্বালানি।
তবে কোনো নতুন ডায়েট শুরু করার আগে খাদ্যতত্ত্ববিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৫. ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং হলো দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় খাওয়া এবং বাকি সময় ফাস্টিং বা না খেয়ে থাকা। এটি কিছু ক্ষেত্রে উপকারি হতে পারে, যেমন ওজন নিয়ন্ত্রণ ও ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে। তবে এরও কিছু ঝুঁকি রয়েছ, যেমন – দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, মনোযোগে সমস্যা ইত্যাদি। বিশেষ করে যদি না খাওয়ার সময় খুব দীর্ঘ হয় অথবা কেউ আগে থেকেই দুর্বল থাকে।
এই সব ডায়েটের মূল সমস্যা হলো এগুলো শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদে তা শরীর ও মনের ক্ষতি করে। তাই কোনো ডায়েট শুরু করার আগে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
নতুন কোনো ফ্যাশনেবল ডায়েট ট্রেন্ড আকর্ষণীয় হলেও এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বুঝে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
সূত্র: হার্ভার্ড হেল্থ, অক্সফোর্ড অ্যাকাডেমিক, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ভেরিওয়েল হেল্থ, কেমব্রিজ নিউট্রিশন রিভিউজ, মেডিকেল নিউজ টুডে, দ্য গার্ডিয়ান
এএমপি/এএসএম