লাইফস্টাইল

তরুণদের স্ট্রোক বাড়ছে কেন

তরুণদের স্ট্রোক বাড়ছে কেন

স্ট্রোক একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যেখানে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। এতে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ অক্সিজেন ও পুষ্টি না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকেই মনে করেন, এটি কেবল বয়স্কদের সমস্যা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন তরুণদের মধ্যেও স্ট্রোকের ঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

Advertisement

কেন হঠাৎ এই প্রবণতা বাড়ছে? কীভাবে বুঝবেন আপনার স্ট্রোক হচ্ছে কি না? এমন পরিস্থিতিতে কী করবেন? জেনে নিন এসব প্রশ্নের উত্তর-

তরুণদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রবণতা বাড়ার কারণ ১. ভাজাপোড়া ও প্রসেস করা খাবার

আজকাল তরুণদের খাদ্য তালিকায় বেশি জায়গা দখল করে আছে তেলে ভাজা স্ন্যাক্স, ট্রান্স ফ্যাট, চিপস, ফাস্ট ফুড ও সোডিয়ামসমৃদ্ধ খাবার।

তেলে ভাজা স্ন্যাক্স, ট্রান্স ফ্যাট, চিপস, ফাস্ট ফুড ও সোডিয়ামসমৃদ্ধ খাবার ধমনীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়। ছবি/প্রতীকী

Advertisement

এসব খাবার রক্তনালিতে চর্বি জমাতে সাহায্য করে, যাকে বলে ‘আথেরোসক্লেরোসিস’। এটি ধমনীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং সময়ের সঙ্গে ধমনীর গায়ে ক্ষত সৃষ্টি করে। ফলাফল – স্ট্রোকের ঝুঁকি।

২. শরীরচর্চার অভাব ও দীর্ঘ সময় বসে থাকা

কম্পিউটার বা মোবাইলের সামনে দীর্ঘসময় বসে থাকা তরুণদের জন্য এক ভয়ংকর রুটিন হয়ে উঠেছে। এটি শরীরের রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা তৈরি করে।

পেশি দীর্ঘক্ষণ নড়াচড়া না করলে রক্তে শর্করা বা চর্বির ভারসাম্য থাকেনা। ছবি/প্রতীকী

পেশি যখন নড়াচড়া করে না, তখন শরীর রক্তে শর্করা বা চর্বি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এতে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এবং ওবেসিটি বা স্থূলতা দেখা দেয় – যার প্রত্যেকটিই স্ট্রোকের জন্য দায়ী।

Advertisement

৩. ধূমপান ও অতিরিক্ত ক্যাফেইন

তামাকের নিকোটিন ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয় এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। এটি রক্তনালিতে ক্লট বা রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা বাড়ায়।

নিকোটিন ও ক্যাফেইন রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বাড়ায়। ছবি/প্রতীকী

পাশাপাশি এনার্জি ড্রিংক বা একাধিক কাপ কফির অতিরিক্ত ক্যাফেইন হার্টবিটের ছন্দ নষ্ট করে এবং স্নায়ুতে অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন এ অভ্যাস থাকলে তা স্ট্রোকের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

৪. মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা

দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ শরীরে কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তচাপ ও প্রদাহ বাড়ায়। উদ্বেগ ও হতাশা অনেক সময়েই অপরিকল্পিত খাওয়ার প্রবণতা, ধূমপান বা মাদকগ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত – যা পরোক্ষভাবে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

উদ্বেগ ও হতাশা থেকেও বাড়ে স্ট্রোকের ভয়। ছবি/প্রতীকী

অনেক তরুণই ‘মিনি স্ট্রোক’ বা ট্রান্সিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক (টিআইএ) এর শিকার হন, যা বড় স্ট্রোকের পূর্বাভাস হতে পারে।

স্ট্রোকের যেসব লক্ষণ তরুণদের মাঝেও দেখা যায়-

>> মুখ, হাত বা পা হঠাৎ এক পাশে অবশ হয়ে যাওয়া।

>> কথা বলায় সমস্যা, জড়িয়ে যাওয়া বা অস্পষ্ট উচ্চারণ।

>> হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখা বা অন্ধকার হয়ে যাওয়া।

তরুণদের মধ্যে যারা দৈনন্দিন জীবনে অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকেন, তাদের সাবধান হওয়া দরকার। ছবি/প্রতীকী

>> ভারসাম্য হারানো, মাথা ঘোরা বা গুরুতর মাথাব্যথা।

>> স্মৃতিভ্রান্তি বা পরিস্থিতি অনুধাবনে সমস্যা।

তরুণদের মধ্যে যারা ধূমপান বা মাদক গ্রহণ করেন, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে ভোগেন, ওবেসিটি বা স্থূলতাজনিত সমস্যা আছে, পরিবারে কারও আগে স্ট্রোক বা হৃদরোগ ছিল এবং দৈনন্দিন জীবনে অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকেন, তারা অল্প বয়সে স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকেন সবচেয়ে বেশি।

প্রতিরোধে যা করবেন- ১. সুষম খাবার গ্রহণ

ফল, সবজি, বাদাম, মাছ ও ফাইবারযুক্ত খাবার খেলে ধমনী সুস্থ থাকে। বিশেষ করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছের তেল হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের জন্য উপকারী।

স্বাস্থ্যকর খাবার ও নিয়মিত ব্যায়াম শরীরকে সচল রাখে। ছবি/প্রতীকী

২. নিয়মিত ব্যায়াম

প্রতিদিন ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো বা জগিং করলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। ব্যায়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়।

৩. ঘুমের যত্ন

ঘুমের অভাব কর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। নিয়মিত রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। মোবাইল বা স্ক্রিন টাইম রাত ১০টার পরে কমিয়ে ফেলুন।

৪. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ

ধ্যান, বই পড়া, প্রকৃতিতে সময় কাটানো কিংবা কথা বলার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যায়। কেউ বিষণ্নতা বা উদ্বেগে ভুগলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করলে ও ধূমপান ত্যাগ করলে কম বয়সে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। ছবি/প্রতীকী

৫. ধূমপান ও মাদক বর্জন

এই দুটি অভ্যাস ধমনী ও স্নায়ুকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে। সেগুলো পরিহার করাই সুস্থ জীবনের প্রথম পদক্ষেপ।

স্ট্রোক এখন আর শুধু প্রবীণদের রোগ নয়। তরুণদের মধ্যেও এটি এক নীরব ঘাতক হয়ে উঠছে। সঠিক জীবনধারা, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিলে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।

সূত্র: ইউএনবি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ্, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, মায়ো ক্লিনিক, স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন ইউকে, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক

এএমপি/এমএস