খেলাধুলা

মিরপুরে টিকিট কালোবাজারিরা আরও বেপরোয়া, প্রতারিত হচ্ছেন দর্শক

মিরপুরে টিকিট কালোবাজারিরা আরও বেপরোয়া, প্রতারিত হচ্ছেন দর্শক

লোকটা একবার তার নাম বলছিল রাসেল, আরেকবার সোহেল। সঙ্গী ছিল পাশে। নাম বললো জসিম। চেহারায় বেশ উগ্র-উদ্ধত ভাব। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের এক নম্বরে গেটের উল্টো পাশেই কালোবাজারি করছিলো। তার হাতে টিকিটের কয়েকটি প্রিন্ট কপি। সামনে বেশ কয়েকজন ক্রেতা। গ্যালারির টিকিট চাচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। ৮০০ টাকার টিকিট চাচ্ছিল ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা।

Advertisement

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড লুকিয়ে ক্রেতা সেজে তার সাথে টিকিটের দরদাম করলাম কিছুক্ষণ। কীভাবে টিকিট বিক্রি করছে, অরিজিনাল কপি নাকি ফটোকপি- নানান বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হলো। এক পর্যায়ে নাম জিজ্ঞাসা করলাম। পরে যখন বুঝলো আমি টিকিট কিনবো না, এমনিতেই কথা বলেছি, তখন আবার ভিন্ন নাম উল্লেখ করলো।

ওখান থেকে সরে আসলাম। একটু সামনে এগিয়ে যেতেই লোকটি পেছনে থেকে এসে চড়াও হলো এ প্রতিবেদকের ওপর। হাতে থাকা প্যাড, কার্ড, মোবাইল কেড়ে নিতে চাইলো। উল্টো প্রশ্নের পর প্রশ্ন- আপনি আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন কেন? এতকথা জানতে চাইলেন কেন? আপনি কে?

যখন বললাম, আমি সাংবাদিক। তখন আরও বেপরোয়া হয়ে সে এই প্রতিবেদককে জাপটে ধরলো। কেড়ে নিতে চাইলে লেখার সরঞ্জাম এবং মোবাইল। ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছিল। স্থানীয় এক বিএনপি নেতার নাম বলে হুমকিও দিতে শুরু করলো। বললো, ‘আমি এখানকার স্থানীয়, অমুক ভাইয়ের লোক। এখানে আমাদের কথাই সব। আপনি কে, আমার নাম জিজ্ঞাসা করেন?’

Advertisement

এক পর্যায়ে তাকে টেনে নিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক বাহিনীর সদস্যের কাছে অভিযোগ করলাম। বললাম, ‘আমি সাংবাদিক, এই লোক আমার লেখার সরঞ্জাম ও মোবাইল কেড়ে নিতে চাইছে।’ সেই সদস্য তখন গেটে প্রবেশ করতে থাকা দর্শকদের সিরিয়াল মেইনটেইন করতে ব্যস্ত। তিনি কোনো ভ্রুক্ষেপই করলেন না। উল্টো বললেন, আপনারা সরেন-সরেন এখান থেকে। আমাদের কাজ করতে দেন।’

এরপরও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বেশ জোরাজুরি করলো সেই টিকিট কালোবাজারি। তার একটাই দাবি, ‘আপনি আমার নাম কেটে দেন।’ বেগতিক অবস্থা দেখে নোটপ্যাডে লেখা তার নাম কাটতে বাধ্য হলাম। যদিও বলে দিলাম, তোমার নাম নোটপ্যাডে কেটে দিলেও, মনে তো আছে। সে দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়ে আপাতত সরে দাঁড়াল।

এক সহকর্মীকে ফোন করে ডেকে আনলাম। অন্য মিডিয়া হাউজের আরও একজন ছিল। এবার একটু সাহস হলো। এগিযে গেলাম সেই লোকের দিকে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তখনও টিকিট বিক্রি করার চেষ্টা করছিল। দেখতে পেয়ে আবারও তেড়ে এলো। বললো, ‘আপনি আবারও এসেছেন। আপনার তো সাহস কম নয়!’ সহকর্মীকে বললাম, এই লোকের ছবি তোলেন। আমার সঙ্গে লোকজন দেখে এবার সে একটু রুখলো। আরেকজন তার পাশে এসে বললো, এরা তো সাংবাদিক। এদের সঙ্গে ঝামেলা করছিস কেন?

সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম, তার পাশে আরও কয়েকজন যুক্ত হয়ে গেলো। একটু বয়স্ক টাইপের একজন এসে সেই কালোবাজারিকে বললেন, তুমি তো ভুল করেছো। সাংবাদিকের সঙ্গে লাগতে গেলা! এখনই ক্ষমা চাও ওনাদের কাছে! বোঝা গেলো, সেই লোকটা হয়তো এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ। এ কারণে ঘটনা বড় হোক, তা সে চাচ্ছে না। হঠাৎ, সেই কালোবাজারি জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, ভাই আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি ভুল করেছি। এই হলো মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের বাইরে টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য।

Advertisement

প্রথম টি-টোয়েন্টির দিনই জাগো নিউজে প্রকাশিত হয়েছে, ‘মিরপুরে টিকিটের কালোবাজারী, প্রতারনার শিকার দর্শকরা’। অনলাইনে কেনা টিকিটের প্রিন্ট কপি বের করা হয় কয়েক কপি। এমনকি ফটোকপিও করা হয়। এসব প্রিন্ট কিংবা ফটোকপিই চড়া দামে বিক্রি করা হয় কালোবাজার থেকে টিকিট কিনতে আসা সহজ-সরল দর্শকদের কাছে। সেই টিকিট কিনে গ্যালারিতে প্রবেশ করতে গিয়ে দর্শকরা দেখছেন, এরই মধ্যে ওই টিকিটের নির্দিষ্ট ব্যক্তি মাঠে প্রবেশ করে ফেলেছেন। যারা কালোবাজারে টিকিট কিনে আসতেছে, তারা মাঠে প্রবেশ করতে পারছে না।

ওই রিপোর্ট প্রকাশের পর আজ (মঙ্গলবার) দ্বিতীয় ম্যাচে লক্ষ্য ছিল, সরাসরি কালোবাজারি যারা করে তাদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করা। সেটা করতে গিয়েই উপরোক্ত ঘটনার মুখোমুখি হতে হলো। প্রবেশপথে টিকিট চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকা একজন নাম প্রকাশ না করে বলেন, টিকিটের প্রিন্ট নেয়া প্রয়োজন নেই। মোবাইলে ডাউনলোড কপি নিয়ে আসলেই সেটা স্ক্যান করা সম্ভব। দর্শকরা না বুঝে প্রিন্ট করতে যায় এবং কালোবাজারীরা এ সুযোগটা গ্রহণ করছে।

গাজীপুর থেকে খেলা দেখতে আসা মাজেদ এবং টঙ্গী থেকে দেখতে আসা ওমর ফারুক জানালেন, তারা খেলা দেখতে এসেছেন টিকিট না কেটেই। আশা, স্টেডিয়ামের সামনে এসে কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট কিনবেন। কিন্তু কয়েকজনের কাছে টিকিট পেলেও দাম বেশি হওয়ায় কিনতে পারেনি। এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে যখন শুনলো যে, তারা প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে বেঁচে গেলেন। শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা গেলো তাদের।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি সিরিজের টিকিট ব্যবস্থাপনা কমিটির সিনিয়র সদস্য সাব্বির আহমেদ রুবেল জাগোনিউজকে জানালেন, তারা প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই টের পেয়েছেন টিকিট কালোবাজারি হচ্ছে। প্রতারণার শিকারও হচ্ছেন দর্শকরা। বিষয়টা জানতে পেরে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচের দিনই অভিযান পরিচালনা করেছেন। কয়েকজন কালোবাজারিকে ধরেছেনও। একজনের কাছে ৯টি টিকিট (সর্বোচ্চ চারটির বেশি টিকিট একজনের কাছে থাকার নিয়ম নেই) পাওয়া গেছে। স্টেডিয়ামের পাশে একটি লন্ড্রির দোকানেও কালোবাজারের টিকিট পাওয়া গেছে।

রুবেল বললেন, ‘আমরা জানতাম না দর্শকরা এতটা প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এখন যেহেতু জানলাম, আরও ভালোভাবে টিকিট কালোবাজারিদের বিপক্ষে অভিযান পরিচালনা করবো। যাতে এসব কালোবাজারির দৌরাত্ম্য কমে।’

সাব্বির আহমেদ রুবেল দর্শকদের আরেকটু সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এখন তো অনলাইনে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। কালোবাজারের কোনো সুযোগই নেই। আর টিকিট অনলাইনে কাটার পর ডাইনলোড কপি প্রিন্ট করারও প্রয়োজন নেই। প্রবেশপথে মোবাইলে ডাউনলোড কপি স্ক্যান করা যায়। প্রিন্ট করতে গেলেই কালোবাজারিদের প্রতারণার সুযোগ তৈরি হয় বেশি।’

আইএইচএস/এমএমআর/এএসএম