প্রথম টি-টোয়েন্টি শেষে পাকিস্তান হেড কোচ মাইক হেসন দায় চাপিয়েছেন উইকেটের ওপর। গেল রোববার রাতে খেলা শেষে ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’ দেখিয়ে পরাজয়কে স্বাভাবিকভাবে মেনে না নিয়ে উল্টো শেরে বাংলার উইকেটের ওপর দোষ চাপিয়েছেন তিনি।
Advertisement
মাইক হেসন বলেছেন, যে পিচে খেলা হয়েছে সেটা একদমই অগ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানের নয়। ভাবটা এমন, যেন বাংলাদেশের কাছে হারেনি, পাকিস্তান হেরেছে বাজে উইকেটের কাছে। একই উইকেটে যে বাংলাদেশও খেলেছে, এমনকি যেসব বোলার ও ব্যাটাররা অন্য পিচে পারফর্ম করেননি, একই পিচে তার দলের চেয়ে ভালো পারফর্ম করেছে, সে সত্যটা বেমালুম চেপে গেছেন এই কিউই কোচ। পাকিস্তান ম্যানেজমেন্ট যা কিছুই ভাবুক আর যাই বলুক না কেন, যারা খেলা দেখেছেন তারা সবাই একবাক্যে মানছেন প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ ছিল ভালো দল। বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং ও রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো পারফর্ম করেই সহজে জিতেছে বাংলাদেশ।
প্রথম ম্যাচে দু'দলের অ্যাপ্রোচ, পারফরম্যান্স বলে দিয়েছে শেরে বাংলার যে পিচে খেলা হয়েছে, সে কন্ডিশনে টাইগাররা পাকিস্তানিদের চেয়ে ভালো দল ও ফেবারিট। উইকেট যদি প্রথম দিনের মতো থাকে, তাহলে আজকের ম্যাচেও ফেবারিট বাংলাদেশ। লিটন দাসের দলেরই জেতার সম্ভাবনা বেশি। প্রথম ম্যাচে শেরে বাংলার তুলনামূলক স্লো গতির উইকেটে ভুল পথে হেঁটেই সর্বনাশ ডেকে এনেছে সালমান আলি আগার দল। বল স্বাভাবিকের চেয়ে একটু থেমে আসছে। গতি ও বাউন্স বেশি না। এই কন্ডিশনে একটু দেখে খেলতে হবে। বিশেষ করে প্রতিপক্ষ দলে যদি মোস্তাফিজুর রহমানের মতো কাটারমাস্টার থাকেন।
এ উইকেট আদর্শ ভেন্যু মোস্তাফিজের, কাটার ও স্লোয়ার যার প্রধান অস্ত্র। সেই মোস্তাফিজ স্লো ও একটু থেমে আসা পিচে রীতিমত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন। এই ধরনের কন্ডিশনে মোস্তাফিজকে খেলতে গিয়ে অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটারেরও নাস্তানাবুদ হওয়ার নজির আছে।
Advertisement
আইপিএলের মতো আসরেও স্লো, স্যাঁতস্যাঁতে ও নরম পিচে মোস্তাফিজের অনেক কার্যকর বোলিংয়ের রেকর্ড আছে। সেখানে ফখর জামান, সাইম আইয়ুব, মোহাম্মদ হারিস, আগা সালমান ও হাসান নওয়াজরা বলের পেস ও বাউন্স স্বাভাবিক ধরে ফ্রি স্ট্রোক খেলতে গিয়েই বিপদ ডেকে এনেছেন। বেশির ভাগ শট মিসটাইমড হয়েছে। পাকিস্তানিদের অ্যাপ্রোচ ও ব্যাট চালনা দেখে পরিষ্কার বোঝা গেছে, তাদের মাথায় উইকেটের গতি-প্রকৃতি জানা ছিল না।
পাকিস্তানের পরিকল্পনা ছিল, উইকেট যেমনই হোক, বাংলাদেশের বোলিং যাই হোক না কেন, আমরা শুরু থেকে মেরে খেলবো। চালিয়ে খেলবো। আর তাতেই বাংলাদেশের বোলিং খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। তাই পাকিস্তানিরা প্রথম বল থেকে তেড়েফুড়ে তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজ, তানজিম হাসান সাকিব ও শেখ মেহেদীর ওপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশিদের বলের লাইন-লেন্থ না ঠাউরে আক্রমণাত্মক মেজাজে আগ্রাসী ব্যাট চালাতে গেছেন পাকিস্তানিরা। যার অনিবার্য পরিণতি যে বিপর্যয়, সেটাই ঘটেছে। বাংলাদেশের মাপা লাইন ও লেন্থের বোলিংয়ের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি পাকিস্তানিরা। ইচ্ছেমতো আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে গিয়ে মাত্র ১১০ রানে গুটিয়ে যায় সালমান আগারা।
এই উইকেটে বল একটু থেমে ব্যাটে যাবে। শর্ট বল করলে ব্যাটসম্যান সময় পাবেন পিছনের পায়ে গিয়ে খেলতে। তাই বাংলাদেশের বোলাররা খাট লেন্থ সযত্নে এড়িয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন যতটা সম্ভব ওপরে বল করতে। আর সেই সব বলে ফ্লিক, পুল ও রিভার্স সুইপের মতো ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলতে গিয়েই বিপদ ডেকে এনেছেন পাকিস্তানি ব্যাটাররা।
Advertisement
দ্বিতীয় সেশনে খানিক সহজ হয়ে যাওয়া পিচে তরুণ ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমনের ঝোড়ো ব্যাটিং ও তাওহিদ হৃদয়ের দায়িত্বসচেতন উইলোবাজিতে ২৭ বল আগে পাকিস্তানের রান টপকে টাইগাররা জানিয়ে দিয়েছেন, শেরে বাংলার পিচে কখন কী করণীয়, তা আমরা ভালোই জানি ও বুঝি। এই কন্ডিশনে আমাদের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। আজ মঙ্গলবারও যদি উইকেটের চরিত্র এক থাকে আর পাকিস্তানিরা রয়েসয়ে না খেলেন, তাহলে বাংলাদেশের সাথে পেরে ওঠা কঠিন হবে।
পাকিস্তান অধিনায়ক আগা সালমান সিরিজ শুরুর আগে খুব বড় গলায় বলেই ফেলেছিলেন, তারা এখন যে ‘ব্র্যান্ডের ক্রিকেট’ (আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক) খেলেন, তাতে প্রথাগত ব্যাটারদের জায়গা পাওয়া কঠিন। বোঝাই গেছে, দুই পূর্বসুরী বাবর আজম ও মোহাম্মদ রিজওয়ানের দিকেই ছিল তার ইঙ্গিত।
মানা যাচ্ছে, ফখর, সাইম, হারিস, আগা সালমান ও হাসান নওয়াজরা সবাই হাত খুলে খেলতে পারেন। সবাই আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে অভ্যস্ত। এটাই তাদের এখনকার খেলার ধরন। কিন্তু সব জায়গায়, সব কন্ডিশনে কি সেই আগ্রাসী ও অতি আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে সফল হওয়া সম্ভব? সব উইকেটে কি এমন হাত খুলে খেলা যাবে? সম্ভবত সেটা আগা সালমান আগার দলের কারোই মাথায় আসেনি। সে চিন্তা থাকলে অবশ্যই এবার শেরে বাংলার পিচে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলার আগে একটু ভেবেচিন্তে দল গড়তেন।
রয়েসয়ে খেলতে পারেন, ব্যাটিং টেকনিকটা ‘সলিড’, ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি ঠাউরে খেলতে পারেন; শেরে বাংলায় এমন ব্যাটাররাই হন সফল। সম্ভবত তা মাথায় ছিল না পাকিস্তানিদের। অথচ একটু পিছন ফিরে তাকালেই তারা দেখতে পেতেন ৪ বছর আগে এই শেরে বাংলার স্লো পিচে তিন ম্যাচ সিরিজের সবকটায় পাকিস্তানের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের হয়ে সিরিজসেরা হয়েছিলেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। বাবর আজমের মতো পরিপাটি, টেকনিক্যাল ও ঠান্ডা মাথায় ক্রিকেট ব্যাকরণ মেনে খেলা ব্যাটারও ওই সিরিজে রান (৭, ১, ১৯) পাননি। সেখানে ফখর, সাইম, হারিস ও সালমান আগা ও হাসান নওয়াজরা হাত খুলে খেলতে গিয়ে কতটা সফল হবেন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। শাহিন শাহ আফ্রিদি, হাসান আলি, মোহাম্মদ ওয়াসিমের মতো কোয়ালিটি ফাস্টবোলারও ছিলেন সেই পাকিস্তান স্কোয়াডে। এবার তাদের কেউ নেই। শাহিন আফ্রিদিকে টি-টোয়েন্টি দলের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। হাসান আলি ও মোহাম্মদ ওয়াসিমের মতো সুইং বোলারও দলে নেই। বাড়তি গতি দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটিংলাইন আপে কাঁপন ধরাতে পারেন যিনি, সেই হারিস রউফও দলের বাইরে।
সব মিলিয়ে শেরে বাংলার এই পিচে যারা হতে পারেন পাকিস্তানের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র, তাদের বড় অংশই নেই। সালমান মির্জা, আব্বাস আফ্রিদি ও আবরার আহমেদের কেউই কিন্তু ওই মানের নয়। তাদের দিয়ে টাইগার ব্যাটারদের বধ করা কঠিন। ফখর, সাইম, হারিস ও সালমান আগারা হয়তো লাহোর, রাওয়ালপিণ্ডির ব্যাটিং স্বর্গে অনেক কিছুই করতে পারেন। কিন্তু শেরে বাংলার তুলনামূলক স্লো গতির ও একটা নিচু বাউন্সি পিচে কি আদৌ কিছু করতে পারবেন, সেটাই দেখার।
এআরবি/এমএইচ/এমএস