খেলাধুলা

টি-টোয়োন্টিতে বাংলাদেশকে জেতাচ্ছে ব্যাটাররা নাকি বোলাররা?

টি-টোয়োন্টিতে বাংলাদেশকে জেতাচ্ছে ব্যাটাররা নাকি বোলাররা?

মিরপুর শেরে বাংরা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রোববার পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে। ১১০ রান তাড়া করতে নেমে ২৭ বল হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছায় টিম বাংলাদেশ।

Advertisement

অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ এই ম্যাচটি জিতেছে ব্যাটারদের ছক্কা হাঁকানোর দক্ষতা বাড়ার কারণে। পাকিস্তানের চেয়ে এই ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটাররাই ছক্কা হাঁকিয়েছেন বেশি। পাকিস্তানি ব্যাটাররা পুরো ইনিংসে মোটে ছক্কা হাঁকালেন ৫টি। আর বাংলাদেশের পারভেজ হোসেন ইমন একাই ৫টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। এছাড়া তাওহিদ হৃদয় ২টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। ছক্কা মারার এ বিষয়টাও পার্থক্য গড়ে দিয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করছেন।

কিন্তু সত্যিই কী টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে জেতাচ্ছে ব্যাটাররা নাকি বোলাররা? পাকিস্তানের বিপক্ষে এই ম্যাচটির দিকে তাকালেই এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নামা পাকিস্তানি ব্যাটারদের খুব কম রানে বেধে ফেলার কৃতিত্ব অবশ্যই বোলারদের। মোস্তাফিজুর রহমানের ৪ ওভারে ৬ রান দিয়ে ২ উইকেট, তাসকিনের ৩ উইকেটই পাকিস্তানকে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের টি-২০ ইতিহাসে সবচেয়ে কম রানে অলআউট হতে বাধ্য করেছে।

২০২৪ বিশ্বকাপের পর থেকে এ নিয়ে ৬ষ্ঠ টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটি অ্যাওয়ে সিরিজ জিতেছে টাইগাররা। হেরেছে ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে আরব আমিরাতের কাছেও। যে তিনটি সিরিজে হেরেছে বাংলাদেশ, তিনটিতেই বোলারদের বাজে বোলিং ছিল পরাজয়ের জন্য দায়ী। সঙ্গে ব্যাটারদের ব্যাটিং দৈন্যদশা তো ছিলই।

Advertisement

আরব আমিরাতের বিপক্ষে সিরিজের কথাই ধরুন! সেখানে ব্যাটাররা কিন্তু খারাপ করেনি। প্রথম ম্যাচটি প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ২৭ রানের ব্যবধানে। পারভেজ হোসেন ইমন ৫৪ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন ৯টি ছক্কা মেরে। ৫টি বাউন্ডারিও ছিল তার ইনিংসে। দেশের হয়ে এক ইনিংসে রেকর্ড ছক্কার মার মেরেছিলেন ইমন। এই ওপেনার ছাড়া ওই ম্যাচে আর কেউ দাঁড়াতেই পারেনি।

পারভেজ ইমনের সেঞ্চুরিতে ১৯১ রান করার পরও আরব আমিরাতের ব্যাটাররা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে মোহাম্মদ ওয়াসিম ও আসিফ খান; কিন্তু ডেথ ওভারে মোস্তাফিজুর রহমান সেদিন নিজের আসল চরিত্র দেখাতে পেরেছিলেন। ৪ওভারে মাত্র ১৭ রান দিলেন। ২টি উইকেট নিলেও আরব আমিরাতের মনোবল ভেঙে রানরেট বাড়িয়ে দেন। যার ফলে ১৬৪ রান করতে সক্ষম হয় আরব আমিরাত।

কিন্তু পরের তুই ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটাররা দুর্দান্ত ব্যাটিং করলেও বোলারদের দৈন্যতা বাংলাদেশকে আর সিরিজ জিততে দেয়নি। পরের দুই ম্যাচেই হেরে যায়। মূলতঃ মোস্তাফিজুর রহমানকে আইপিএলের জন্য ছেড়ে দিলে এর দারুণ প্রভাব পড়ে দলের ওপর। বিশেষ করে ডেথ ওভারে বাংলাদেশের শক্তি কমে যায়। ফলে দেখা গেলো, দ্বিতীয় ম্যাচে ২০৫ রানের বিশাল স্কোর করেও বাংলাদেশকে হারতে হয়েছে ২ উইকেটের ব্যবধানে। শরিফুল ইসলাম, নাহিদ রানা, তানজিম সাকিব কিংবা রিশাদ হোসেনরা পারেনি আরব আমিরাতের রান আটকাতে।

শেষ ম্যাচে ব্যাটাররা খুব বেশি কিছু করতে পারেননি। ৯ উইকেটে ১৯২ রান করেছিলো টাইগাররা। বোলারদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের ওপর চড়াও হয় আলিশান শরাফু। ফলে ১৯.১ ওভারেই ম্যাচ জিতে নেয় আরব আমিরাত। সিরিজ হারের লজ্জায় পড়তে হয় বাংলাদেশকে।

Advertisement

পাকিস্তান সিরিজে ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। নাহিদ রানার পরিবর্তে দলে যুক্ত হলেন হাসান মাহমুদ। তিন পেসার শরিফুল, তানজিম সাকিব এবং হাসান মাহমুদের সঙ্গে স্পিনার হিসেবে ছিলেন শেখ মেহেদী, রিশাদ হোসেন ও শামীম হোসেন পাটোয়ারী। ঘরের মাঠে, লাহোরের গাদ্দাফী স্টেডিয়ামে পাকিস্তানি ব্যাটারদের আটকাতে পারেনি বাংলাদেশের বোলাররা। তার সংগ্রহ করেছিল ২০১ রান। বাংলাদেশের ব্যাটাররা পারেনি এই রানের ধারেকাছেও যেতে। ১৯.২ ওভারে ১৬৪ রানে অলআউট। হারলো ৩৭ রানে।

দ্বিতীয় ম্যাচে শেখ মেহেদীর পরিবর্তে দলে এলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। হাসান মাহমুদ ও তানজিম সাকিব ২টি করে উইকেট নিলেও পাকিস্তানের স্কোর আটকাতে পারেনি। সেই ২০১-ই হলো স্কোর। এই ম্যাচে ব্যাটিংয়ে আরও করুন দশা। ১৪৪ রানে অলআউট। হারলো ৫৭ রানে।

শেষ ম্যাচে শরিফুলের পরিবর্তে এলেন খালেদ আহমেদ। কোনো পরিবর্তন কিন্তু হলো না। প্রথমে ব্যাট করে ব্যাটাররা কিছুটা সাহস দেখিয়েছেন। ভালো ব্যাটিং করে ৬ উইকেটে তোলেন ১৯৬ রান। পারভেজ ইমন ৬২ এবং তানজিদ তামিম করেন ৪২ রান। ওপেনিংয়ে ১০.৪ ওভারে উঠেছিল ১১০ রান। কিন্তু বোলাররা পারেনি এই পুঁজিকে রক্ষা করতে। মোহাম্মদ হারিস ৪৬ বলে ১০৭ রান করে ১৭.২ ওভারেই (১৬ বল হাতে রেখে) পাকিস্তানকে ৭ উইকেটে জয় এনে দেন।

এখানেও প্রমাণ হলো, ব্যাটাররা ভালো করলেও বোলারদের অবদান না থাকলে ম্যাচ জেতা সম্ভব নয়। বিশেষ করে মোস্তাফিজুর রহমান যদি থাকতেন, তাহলে ডেথ ওভারে তিনি রান আটকাতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে অন্তত শেষ ম্যাচে হলেও জিততে পারতো বাংলাদেশ; কিন্তু মোস্তাফিজের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে ৩-০ তে সিরিজ হারতে হলো টাইগারদের।

২০২৪ বিশ্বকাপের পরপর, গত বছর অক্টোবরে ভারত সফরে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। কোনো জয়ই নাই যেখানে, সেখানে ব্যাটিং-বোলিংয়ে কে ভালো করেছে সে তুলনায় গেলেই বা কি, না গেলেই বা কি!

তবুও একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ তো করা যায়। ওই সিরিজে দলের সঙ্গে ছিলেন কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমানও। কিন্তু ভারতের মাটিতে ফিজের কোনো ক্যারিশমাও কাজে লাগেনি। প্রথম ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ১২৭ রানে অলআউট। ভারত জিতেছে ১১.৫ ওভারে ৭ উইকেটের ব্যবধানে। দ্বিতীয় ম্যাচে ভারত করেছিল ২২১, বাংলাদেশ ১৩৫ রান করে ৮৬ রানে হেরেছিল। শেষ ম্যাচে ভারত রেকর্ড ২৯৭ রান সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ ৭ উইকেটে করে ১৬৪ রান। অর্থ্যাৎ, এই সিরিজে ব্যাটিং-বোলিং দু’বিভাগেই যারপরনাই ব্যর্থ বাংলাদেশ।

সর্বশেষ শ্রীলঙ্কার সফর। টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে হারের পর টি-টোয়েন্টি সিরিজেও প্রথম ম্যাচে হেরে বসেছে বাংলাদেশ। এই ম্যাচে ব্যাটাররা খুব বেশি সুবিধা করতে পারলেন না। ৫ উইকেটে করেছিল ১৫৪ রান। এই পুঁজি রক্ষা করার জন্য বোলারদের শক্তি নখ-দন্তহীন প্রমাণিত হলো। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, তাসকিন আহমেদ ফিরে এলেন একাদশে। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। শ্রীলঙ্কা ম্যাচ জিতে নিলো ৭ উইকেটে।

পরের দুই ম্যাচেই দলের সঙ্গে ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। টস হারলেও প্রথমে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে প্রথম ম্যাচের তুলনায় কিছুটা ভালো ব্যাটিং করেছিল। অধিনায়ক লিটন দাস করেন ৭৬ রান। ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন ৫টি। কিন্তু ১৭৭ রান কি যথেষ্ট? আরব আমিরাতের বিপক্ষে তো ২০৫ রান করেও হারতে হয়েছিল? পাকিস্তানের বিপক্ষে হারতে হয়েছিল ১৯৬ রান করেও।

তবে, ১৭৭ রানের পুঁজিকে বাঁচাতে বোলাররা নিজেদের উজাড় করে দিলেন। রিশাদ হোসেনের অবদান বেশি। ৩.২ ওভারে ১৮ রান দিয়ে নেন ৩ উইকটে। কিন্তু সেই ডেথ ওভারে ‘সাইলেন্ট কিলারে’র মত আসল কাজটি করেছেন কিন্তু মোস্তাফিজই। ৩ ওভারে দিলেন ১৪ রান। উইকেট নিলেন একটি। শরিফুল ইসলাম ২টি ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ২ উইকেট নিয়ে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বোলাররা। ১৫.২ ওভারে শ্রীলঙ্কা অলআউট ৯৪ রান। বাংলাদেশের জয় ৮৩ রানের ব্যবধানে। অর্থ্যাৎ, ব্যাটাররা ভালো করলেও সেই পুঁজিকে রক্ষা করতে মূল ভূমিকাটা পালন করেছেন বোলাররাই।

শেষ ম্যাচেও একই চিত্র। শেখ মেহেদীর দুর্দান্ত ঘূর্ণিতে দিশেহারা শ্রীলঙ্কার ব্যাটাররা। ৪ ওভারে ১১ রান দিয়ে ৪ উইকেট। মোস্তাফিজ ৪ ওভারে ১৭ রান দিয়ে নেন ১ উইকেট আর শামীম হোসেন পাটোয়ারী ২ ওভারে দিলেন ১০ রান, ২ উইকেট। সবচেয়ে খরুচে ছিলেন শরিফুল ইসলাম। ৫০ রান দিয়ে বসেন তিনি। উইকেট নেন ১টি। শরিফুলের খরুচে বোলিং সত্ত্বেও ১৩২ রানে আটকে থাকে শ্রীলঙ্কা।

তানজিদ তামিমের ৪৭ বলে ৭৩ রানে ভর করে ১৬.৩ ওভারেই লক্ষ্যে পৌঁছায় বাংলাদেশ। ৬টি ছক্কা মারেন তানজিদ তামিম। দুর্দান্ত বোলিং করে ম্যাচ সেরা হলেন শেখ মেহেদী। বোলাররা জয়ের ভিত তৈরি করেছেন। লক্ষ্য কম রাখতে সহযোগিতা করেছেন বলেই তাজিদ তামিমরা হাতখুলে খেলার সুযোগ পেয়ে দলকে জিতিয়ে আনতে পেরেছেন। সে সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মাটিতে তাদের বিপক্ষে প্রথম সিরিজও জিততে পারলো বাংলাদেশ।

ক্রিকেট একটি দলীয় খেলা। দলের জয়ে যিনি ১ রান করেন, তারও ভূমিকা থাকে। যিনি রান করতে পারেননি, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ ধরেন, তারও অবদান থাকে। শুধু বোলাররাই ম্যাচ জেতান না। ব্যাটাররাও জেতান। তবে, তূলনামূলক যেদিন বোলাররা সবচেয়ে ভালো করেন, সেদিনই ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। ব্যাটাররা সবচেয়ে ভালো করলেও বোলাররা ভালো করতে না পারলে ম্যাচ জেতা সম্ভব হচ্ছে না। সেটা অন্তত ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর প্রমাণিত।

একই সঙ্গে এটাও বলতে হবে যে, টি-টোয়েন্টিতে দলের জয়ে বাঁ-হাতি কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সব ম্যাচে হয়তো তিনি সেরা হন না। কিন্তু ডেথ ওভারে প্রতিপক্ষকে যেভাবে চেপে ধরেন এবং কৃপণ বোলিং করে রান আটকে রাখেন, সেটাই বরং দলের জয়ে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।

আইএইচএস/জেআইএম