মানুষের জীবনে নিজের সন্তানের মৃত্যুর চেয়ে বেশি কষ্টের ঘটনা সম্ভবত আর নেই। সন্তানের মৃত্যুর শোকে নিজেকে সংযত রাখা, ধৈর্য ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্য ধারণের ফজিলত ও সওয়াবও অনেক বেশি। বিভিন্ন হাদিসে নবিজি (সা.) সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণের অপরিসীম প্রতিদানের কথা বলেছেন যা শোকার্ত বাবা-মায়ের জন্য সান্ত্বনা পাওয়ার মাধ্যম হতে পারে।
Advertisement
আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার মুমিন বান্দার জন্য দুনিয়া থেকে তার প্রিয়জনকে আমি যদি নিয়ে নিই, আর সে যদি তা ধৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করে ও প্রতিদান প্রত্যাশা করে, তবে তার জন্য আমার কাছে একমাত্র প্রতিদান হলো—জান্নাত। (সহিহ বুখারি: ৬৪২৪)
হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন কারো সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করে ফেলেছ? তারা বলেন, হ্যাঁ। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা কী বলেছে? তারা বলেন, আপনার বান্দা ধৈর্য ধারণ করে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েছে। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আমার এই বান্দার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ কর এবং তার নামকরণ কর ‘বাইতুল হামদ’, অর্থাৎ, প্রশংসার ঘর। (সুনানে তিরমিজি: ১৩৯৫)
আরেকটি হাদিসে শিশু বয়সে মৃত্যুবরণকারী সন্তানদের জান্নাতের প্রজাপতির সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, শিশু সন্তানরা আখেরাতে তাদের মা-বাবার জন্য সুপারিশ করবে। তারা জান্নাতের দরজায় অপেক্ষা করবে এবং হাত ধরে মা-বাবাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আবু হাসসান (রহ.) বলেন, আমি আবু হুরায়রাকে (রা.) বললাম, আমার দুটি সন্তান মারা গেছে, আমাকে এমন কোনো হাদিস বলুন যা আমাদের মনকে শান্ত করবে। তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শিশু বয়সে মৃত্যুবরণকারী সন্তানেরা জান্নাতের প্রজাপতির মতো। তাদের কেউ যখন তাদের বাবা বা তাদের বাবা-মাকে দেখবে, তখন তার পরিধানের কাপড় কিংবা হাত ধরবে। এরপর সেই কাপড় কিংবা হাত আর ছাড়বে না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাকে তার মা-বাবাসহ জান্নাতে প্রবেশ না করাবেন। (সহিহ মুসলিম: ৬৩৭০)
Advertisement
হজরত কুররা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে এসেছে, একবার একজন সাহাবির শিশু-সন্তানের মৃত্যু হলে তিনি তার শোকে নবিজির (সা.) মজলিসে আসা বন্ধ করে দেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তোমার সন্তানের সঙ্গে তোমার দুনিয়ার জীবন সুখের হওয়া ভালো নাকি আখেরাতে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে তুমি প্রবেশ করতে চাইবে তাকে সেখানেই পাবে এবং সে তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেবে—এটা বেশি ভালো? (সুনানে নাসাঈ: ২০৯০)
অর্থাৎ নবিজি (সা.) সাহাবিকে বোঝান যে, দুনিয়ায় তুমি তাকে হারালেও আখেরাতের অনন্ত জীবনে তাকে পাবে, সে তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেবে। তাই দুনিয়ায় সাময়িক এই বিপদে ধৈর্য ধারণ করে আখেরাতের পুরস্কারের জন্য তৈরি হও।
শিশুরা নিষ্পাপ। শিশু অবস্থায় যারা মারা যায়, তারা নিষ্পাপ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে। তাই তারা মৃত্যুর পরপরই জান্নাতে প্রবেশ করে। জান্নাতের বাগানে তারা খেলাধুলা করে এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষা করে। হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের স্বপ্নের বর্ণনায় বলেন, আমরা চলতে চলতে একটা সবুজ বাগানে পৌঁছলাম, যেখানে বসন্তের বিচিত্র রকম ফুল ফুটেছে। ওই বাগানের মাঝে দীর্ঘকায় একজন পুরুষকে দেখলাম। তবে তার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম না। তার চারপাশে এত বিপুল সংখ্যক বালক-বালিকা দেখলাম যে এত বেশি সংখ্যক বালক-বালিকা আমি কখনও একসাথে দেখিনি। আমি ফেরেশতাদের বললাম, এই ব্যক্তি কে? আমাকে বলা হলো, ইনি ইবরাহিম (আ.) আর তার আশপাশের বালক-বালিকারা হলো ওই সব শিশু যারা শৈশবে নিষ্পাপ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। (সহিহ বুখারি: ৪২৯)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সন্তানদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন। যাদের সন্তান আল্লাহর কাছে চলে গেছে তাদের ধৈর্য ধারণ করার তওফিক দান করুন এবং আখেরাতের জীবনে জান্নাতে সন্তানদের সঙ্গে মিলিত করার ফয়সালা করুন। আমিন।
Advertisement
ওএফএফ/জিকেএস